নিজস্ব প্রতিবেদক: ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা ছাড়া দেশের সব নদ-নদীর পানি বাড়ছে। এতে চলতি বছর আরেক দফা বন্যার আশঙ্কা করছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। ভারি বর্ষণ ও উজানের পানির ঢলে ইতোমধ্যে ছয়টি পয়েন্টে নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এর আগে গত জুনে একদফা বন্যায় দেশের ২৮টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এদিকে গঙ্গা-পদ্মার পানি বৃদ্ধির প্রবণতা আগামী ৪৮ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান।
এর ফলে গঙ্গা-পদ্মা ও গড়াই নদীসংলগ্ন পাবনা, কুষ্টিয়া, মাগুরা, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও মুন্সীগঞ্জ জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যাপরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও সুরমা-কুশিয়ারার পানি আগামী ৪৮ ঘণ্টা কমতে পারে বলেও জানান আরিফুজ্জামান।
পানি উন্নয়ন বোর্ড যে ৯৩টি পয়েন্টে নদ-নদীর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে, তার মধ্যে ৫৬টি পয়েন্টে পানি বাড়ছে, কমছে ৩৭টি পয়েন্টে। আর ছয়টি পয়েন্টে নদী বইছে বিপদসীমার ওপর দিয়ে।
গতকাল বুধবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের চেরাপুঞ্জিতে ৯০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আর দেশের ভেতরে সুনামগঞ্জে ২৪৫ মিলিমিটার, জাফলংয়ে ১৩৭, কানাইঘাটে ১১৩, ঢাকায় ৭৫, ছাতকে ১৯৯, পাবনায় ৮১ ও বরিশাল পয়েন্টে ৭৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
সেপ্টেম্বরের শেষে ভারতের বিহার ও পশ্চিবঙ্গের অনেক জায়গায় মাঝারি থেকে ভারি বর্ষণের প্রভাবে দেশে নদ-নদীর পানি বাড়তে শুরু করে। এর মধ্যে বন্যার কারণে ফারাক্কা বাঁধের ১১৯টি গেটের সবগুলোই সোমবার খুলে দেয় ভারত। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড বলেছে, দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে নদীর পানি বেড়ে যে বন্যাপরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে, তার মূল কারণ অতিবর্ষণ; ফারাক্কা বাঁধ নয়।
এর মধ্যে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী ও মাগুরা জেলার কিছু স্থানে স্বল্প থেকে মধ্যমেয়াদি বন্যা দেখা দেয়। প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান আরও বলেন, উজানে বৃষ্টিপাত কমে এলে চলতি সপ্তাহের শেষার্ধ থেকে গঙ্গা নদীর পানি কমতে পারে, তখন বন্যা পরিস্থিতিরও উন্নতি হবে।
এদিকে আকস্মিকভাবে পানি বেড়ে সৃষ্ট বন্যায় পাবনার পদ্মা তীরের ৩০টি গ্রামের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। পাবনার সদর, ঈশ্বরদী ও সুজানগর উপজেলার ৩০টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ।
টানা বৃষ্টি এবং উজানে পানি বাড়ায় দেশের পশ্চিমাঞ্চলে, বিশেষ করে পদ্মা অববাহিকার রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া ও নাটোর অঞ্চলে স্বল্পকালীন বন্যা হতে পারে বলে আগেই আভাস দিয়েছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরা।
শেয়ার বিজের প্রতিনিধিরা জানান, ক্রমাগত পানি বৃদ্ধির কারণে সদর, ঈশ্বরদী ও সুজানগর উপজেলার পদ্মাপাড়ের অনেক গ্রামের বসতবাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন ওইসব কয়েক শতাধিক পরিবার। খাবার, পানীয় জল ও গো-খাদ্য সংকটে গবাদি পশু ও পরিবার-পরিজন নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তারা।
দোগাছি ইউনিয়নের চরকোমরপুর এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বন্যায় কৃষকদের ধান, মাষকলাই ও সবজি ক্ষেত তলিয়ে গেছে। কৃষকরা কাঁচা ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছেন। হু হু করে পানি ঢুকেছে বসতবাড়িতে। রান্নার ব্যবস্থা না থাকায় দূর-দূরান্তের স্বজনদের বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসছেন।
কৃষকরা জানান, বন্যায় সব ফসল নষ্ট হয়েছে, এখন গো-খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের জন্য কাঁচা ধানই কেটে আনছেন তারা। এ ইউনিয়নের চর কোষাখালী গ্রামের কৃষক সোলায়মান জানালেন, বন্যার পানিতে তার ৮-৯ বিঘা মাষকলাই এবং তিন থেকে চার বিঘা কাঁচামরিচের ক্ষেত তলিয়ে গেছে।
এদিকে ঈশ্বরদী উপজেলার সাড়া, পাকশি ও লক্ষ্মীকুণ্ডা ইউনিয়নের চরের গাজর, শিম, করলা, মূলাসহ আগাম শীতের সবজির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পদ্মার এসব চরের ঊর্বর জমিতে সবজি ভালো উৎপাদন ও সচরাচর বন্যায় প্লাবিত না হওয়ায়, বর্গাচাষিরা এসব জমিতে চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদ করেন।
লক্ষ্মীকুণ্ডা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান শরীফ বলেন, তার ইউনিয়নের প্রায় ১৫ হাজার একর জমির সবজি ও আখক্ষেত পদ্মার পানিতে তলিয়ে গেছে। যার অধিকাংশই আগাম শীতের সবজি।
বাজার মূল্য বেশি হওয়ায় এসব ফসলে কৃষকের বিনিয়োগও বেশি থাকে। টাকার অঙ্কে কমপক্ষে কয়েকশ’ কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়েছে। লক্ষ্মীকুণ্ডা ইউনিয়নের মেম্বর দাদাপুর চরের জিয়াউল হক জিয়া জানালেন, তার ভাইয়ের ৫০ বিঘা গাজরের ক্ষেত তলিয়ে গেছে। প্রতি বিঘাতে গাজরের বীজ বুনতেই তার খরচ হয়েছে ১৫ হাজার টাকা।
এ ইউনিয়নের চর কুরুরিয়া গ্রামে জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘তার ১০ বিঘা কফি, চার বিঘা বরবটি, আর দুই বিঘা মুলার ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে।’
আকস্মিক বন্যায় সব ফসল নষ্ট হওয়ায় চাষিরা দিশেহারা। এদিকে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৮ সালের পর পদ্মায় এমন পানি বৃদ্ধি হয়নি। আগাম প্রস্তুতি না থাকায় ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে বেশি। ‘আরও কয়েকদিন পদ্মার পানি প্রতিদিন ১০ সেন্টিমিটার করে বাড়তে পারে’ বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
তবে পরিস্থিতি মোকাবিলায় ‘পর্যাপ্ত’ প্রস্তুতি রয়েছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ বলেন, ‘তিন উপজেলার বন্যাদুর্গত মানুষদের সহায়তায় তারা সর্বাত্মকভাবে কাজ করছেন। পরিস্থিতি মোকাবিলায় উপজেলাভিত্তিক টিম করে প্রয়োজনীয় ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।’
কৃষকের ক্ষতির বিষয়টি তদারকি করছে জেলার কৃষি বিভাগ। তাদের সহযোগিতার বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে।

Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 10:39 pm
ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ছাড়া সব নদীর পানি বাড়ছে
শেষ পাতা ♦ প্রকাশ: