দেশীয় রুই প্রজাতির মাছের মানসম্মত ব্রুড প্রতিপালনে সফলতার দেখা পেয়েছেন যশোরের হ্যাচারি মালিকরা। কয়েক বছর আগেও ব্যবসায়ীরা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্রুড মাছ সংগ্রহ করে প্রজননের মাধ্যমে রেণু ও পোনা উৎপাদন করলেও এখন নিজেদের পুকুর ও জলাশয়ে মা মাছ লালন-পালন করে সে চাহিদা পূরণ করতে পারছে। ফলে একদিকে মানসম্মত রেণু ও পোনা উৎপাদন করে যেমন লাভবান হচ্ছেন, তেমনি বড় মাছ বাজারজাত করে তারা বাড়তি আয় করছেন।
সাধারণত রুই-জাতীয় মাছের হ্যাচারি মালিকরা প্রতিবছর ব্রুড পুকুরের পূর্ণ ব্যবস্থাপনা করে থাকে। এতে ব্রুড মাছ যথাযথভাবে প্রস্তুত হয় এবং মাছ থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ ডিম উৎপাদন করা যায়। যেসব হ্যাচারির মালিক দ্রুত ব্রুড মাছ ব্যবস্থাপনা করেন, সেসব হ্যাচারিতে আগাম রেণু পোনা উৎপাদন ও অধিক মূল্য প্রাপ্তি হয়।
আশির দশকে যশোরের চাঁচড়া এলাকায় প্রথম মাছের রেণু পোনা উৎপাদন শুরু হয়। সেই থেকে এ অঞ্চলে রেণু উৎপাদন দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। সারা দেশের উৎপাদিত রেণু পোনার অর্ধেকই যশোরের। এখানকার গড়ে ওঠা লাভজনক মৎস্য প্রজনন খামারগুলো কয়েক দশকের মধ্যে বিকশিত হলেও পরবর্তী সময়ে তারা সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকে। বিশেষ করে ব্রুড ফিশের জোগানস্বল্পতা এর অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দেখা দেয়। পোনা উৎপাদনের ভরা মৌসুমে ব্রুড মাছের অভাবে হ্যাচারি মালিকদের হালদা-মেঘনাসহ বিভিন্ন এলাকায় ছুটতে হতো। অনেক সময় মানসম্মত ব্রুড না পাওয়ায় রেণু ও উৎপাদনে চরম সংকটে পড়তেন হ্যাচারি মালিকরা। এ সংকট উত্তরণে অবশেষে যশোরের চাঁচড়ার হ্যাচারি মালিকরা ব্রুড মাছ চাষে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তারা প্রাকৃতিক উৎস থেকে মানসম্মত রুই-জাতীয় মাছের পোনা সংগ্রহ করে নিজেদের পুকুর ও জলাশয়ে লালন-পালন করতে থাকেন। এভাবেই এখন মাছের প্রজননে বড় ভূমিকা রাখছেন যশোরের হ্যাচারি মালিকরা।
বর্তমান চাঁচড়ার মাতৃফিশ হ্যাচারি, মা ফাতেমা ফিশ হ্যাচারি, মুক্তেশ্বরী ফিশ হ্যাচারি, লুলু ফিশ হ্যাচারিসহ বিভিন্ন হ্যাচারি ব্রুড পুকুরের পূর্ণ ব্যবস্থাপনা করে ব্রুড মাছ চাষ করছে।
যশোর জেলা মৎস্যচাষি ও হ্যাচারি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাতৃফিশ হ্যাচারির স্বত্বাধিকারী জাহিদুর রহমান গোলদার জানান, যশোরে ৩২ লাখের বেশি মানুষ প্রত্যক্ষভাবে মাছ চাষের সঙ্গে জড়িত। এ জেলায় ১৩ হাজার ৬২৬ হেক্টর জলাশয় রয়েছে। বাঁওড় রয়েছে ১৩ হাজার ৩৯১ হেক্টর। সদর উপজেলায় সাদা মাছ ও পাঙ্গাশ রেণু উৎপাদন করছে ৩৪টি হ্যাচারি। আর পুরো জেলাজুড়ে এমন হ্যাচারির সংখ্যা ৫২। এসব খামারে রেণু উৎপাদন হয় ৫৪ হাজার ২০০ কেজি, যা থেকে পোনা উৎপাদন হয় প্রায় ৪৮ কোটি ৩৭ লাখ। এসব রেণু ও পোনা উৎপাদনে জেলার পুকুর-জলাশয়ে লালন-পালন করা ব্রুড মাছ বিশেষ ভূমিকা রাখছে। তিনি আরও বলেন, ব্রুড মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ বিশেষ ভূমিকা রাখছে। তারা গত দুবছর ধরে যশোরের হ্যাচারিগুলোয় নানা প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষতা অর্জনে সহযোগিতা করছে মাছ চাষিদের।
জেলা মৎস্যচাষি ও হ্যাচারি মালিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক লুলু হ্যাচারি ফিশের স্বত্বাধিকারী অহিদুল্লাহ লুলু বলেন, ব্রুড ফিশের জোগানস্বল্পতার কারণে আমাদের খামারগুলো হুমকির মুখে পড়ে। এক সময় ব্রুড ফিশ গোগাড় করতে হিমশিম খেতে হতো। কিন্তু চাঁচড়ার মৎস্যপল্লির হ্যাচারি মালিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সে সংকট অনেকটা কাটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি।
বর্তমানে যশোরের হ্যাচারিগুলোয় প্রায় ৫০ হাজার ব্রুড মাছ সংরক্ষিত রয়েছে। প্রজননের পর আগামী বছরের জন্য আরও প্রায় ৫০ হাজার পিশ প্রস্তুত রাখা হয়। ব্রুড মাছ চাষের কারণে রেণু ও পোনা উৎপাদন করে প্রচুর টাকা আয় করতে সক্ষম হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
যশোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান বলেন, উন্নত মানের পোনা উৎপাদনের জন্য এরই মধ্যে ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে একটি সরকারি হ্যাচারিতে প্রাকৃতিক মাছ লালন-পালন করে মানসম্মত ব্রুড মাছ উৎপাদন করে যশোরসহ দেশের বিভিন্ন জেলার হ্যাচারিতে সরবরাহ করা হয়েছে। পাশাপাশি বাড়তি চাহিদা পূরণে যশোরের হ্যাচারি মালিকদের কেউ কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রাকৃতিক উৎসের মাছ সংগ্রহ করে ব্রুড চাষ করছে। এছাড়া বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ দুবছর ধরে ব্রুড মাছ উৎপাদনের ব্যাপারে এ অঞ্চলে কাজ করছে। আশা করা যায়, আগামী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে
রুই-জাতীয় মাছের ব্রুড উৎপাদনে শতভাগ সফলতা অর্জন করবে যশোর। রুই-জাতীয় মাছের হ্যাচারির আদর্শ মালিকরা প্রতিবছর ব্রুড পুকুরের পূর্ণ ব্যবস্থাপনা করে থাকে।
মীর কামরুজ্জামান মনি, যশোর