নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশে ২০০৯ সালের ১২ মার্চ এক পাউন্ডের বিনিময় হার ছিল ৯৫ টাকা ৮২ পয়সা। ক্রমে এটা বাড়তে বাড়তে ২০১৪ সালের ২ জুলাই ১৩৩ টাকা ২৮ পয়সায় গিয়ে দাঁড়ায়। এর পর শুরু হয় পাউন্ডের বিনিময় হারে পতন। গত জুনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে আসার পক্ষে (বেক্সিট) গণভোটের রায় যাওয়ার পর পাউন্ড বড় ধরনের ধাক্কা খায়। সর্বশেষ গত অক্টোবরে পাউন্ডের বিনিময় হার ৯৬ টাকার নিচে নেমে যায়। অর্থাৎ বাংলাদেশে পাউন্ডের বিনিময় হার কমে সাত বছর আগের জায়গায় পৌঁছেছে।
জানা যায়, গত ৩০ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রা বিনিময় হারের তালিকায় পাউন্ডের ক্রয়মূল্য দেওয়া ছিল ৯৫ টাকা ৫০ পয়সা এবং বিক্রয়মূল্য ছিল ৯৫ টাকা ৫৯ পয়সা। টাকা-পাউন্ডের এ বিনিময় হার গত সাত বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ২১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রা বিনিময় হারের তালিকায় পাউন্ডের ক্রয়মূল্য দেওয়া ছিল ৯৭ টাকা ৩৩ পয়সা এবং বিক্রয়মূল্য ছিল ৯৭ টাকা ৪২ পয়সা। কেবল বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বেই পাউন্ডের এখন বেহাল দশা। গত ৩১ অক্টোবর বিশ্ববাজারে পাউন্ডের বিনিময় মূল্য নেমে আসে ১ দশমিক ২১ ডলারে। বর্তমানে সেটা একটু বেড়ে ১ দশমিক ২৩ ডলার হয়েছে।
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে গত অক্টোবরে ব্রেক্সিট কার্যকর করার প্রক্রিয়া শিগগিরই শুরু হবেÑএমন ঘোষণা দেওয়ার পরেই পাউন্ডের বিনিময় মূল্যে এ নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দেয়। তবে থেরেসার ঘোষণা অনুযায়ী আগামী বছরের মার্চে আর্টিকেল ফিফটি সক্রিয় করার কথা। কিন্তু এ ব্যাপারে দায়ের করা এক মামলায় গত মাসে ব্রিটেনের হাইকোর্ট রুল দেন, শুধু পার্লামেন্টের অনুমোদন সাপেক্ষেই আর্টিকেল ফিফটি সক্রিয় করা যাবে। এরপর সরকারপক্ষ আপিল করে। শুনানির শুরু থেকে পাউন্ডের বিনিময় হার একটু বাড়লেও তা এখনও ১০০ টাকার নিচেই রয়েছে।
গত জুনে ব্রেক্সিটের ভোটের পর থেকে এখন পর্যন্ত টাকার বিপরীতে পাউন্ডের বিনিময় হার কমেছে প্রায় ২০ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত ২০ জুন এক পাউন্ডের বিনিময় মূল্য ছিল ১১৫ টাকা ২০ পয়সা।
একসময় বিনিময় হার নির্ধারণে ভিত্তি মুদ্রা হিসেবে ‘পাউন্ড’কেই বেছে নিয়েছিল বাংলাদেশ। ব্রিটেনের সঙ্গে ঐতিহ্যগত সম্পর্কের কারণেই ১৯৭২ সালে এ ব্যবস্থা করা হয়। বাংলাদেশে পাউন্ডের একক রাজত্ব চলে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত। কিন্তু তত দিনে বিশ্বে পাউন্ডকে পেছনে ফেলে ‘ডলার’ সবচেয়ে ব্যবহৃত মুদ্রায় পরিণত হয়। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের গুরুত্ব বাড়তে থাকলে বিনিময় হার নির্ধারণে ডলারকে বেছে নেওয়া হয়। এরপরও পাউন্ডের অব্যাহত দরপতনে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
একক দেশ হিসেবে ব্রিটেন বাংলাদেশের রফতানির দ্বিতীয় বৃহত্তম গন্তব্যস্থল। প্রবাসী আয়েরও একটি বড় বাজার। পাউন্ডের অবমূল্যায়নের ফলে একদিকে যেমন রফতানিকারকরা তাদের হিস্যা হারাচ্ছেন, অন্যদিকে প্রবাসী আয় কমে যাচ্ছে।
রফতানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, ‘ব্রিটেন আমাদের পণ্য রফতানির একটি বড় বাজার। এখানে শুধু তৈরি পোশাকই যায় প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি ডলারের। তাছাড়া ওই দেশটিতে সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশিরা থাকেন। যে কারণে বাংলাদেশ থেকে আতপ চাল, শুঁটকি, পান-সুপারিসহ অনেক ধরনের ঐতিহ্যবাহী পণ্য ব্রিটেনে রফতানি হয়। আমরা রফতানিকারকরা ব্রেক্সিটের আগে যেখানে এক পাউন্ডের বিপরীতে ১১৫ থেকে ১২০ টাকা পেতাম, এখন সেখানে পাচ্ছি ৯৬ থেকে ৯৭ টাকা। এতে রফতানিকারকরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে ওই দেশটিতে পণ্য রফতানিতে আমরা হিস্যা বা অংশীদারত্ব হারাবো। অন্যান্য দেশ আমাদের জায়গা দখল করে নেবে।’
সালাম মুর্শেদী বলেন, ‘এ ধরনের আশঙ্কা থেকে রফতানিকারকদের রক্ষা করতে আমরা সরকারের কাছে ওই দেশে পণ্য রফতানিতে একটি বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ার দাবি জানাবো। যত দিন পর্যন্ত না পাউন্ডের ওপর থেকে ব্রেক্সিটের প্রভাব কমে গিয়ে স্বাভাবিক না হয় তত দিন এ প্রণোদনা দেওয়া প্রয়োজন।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে ব্রিটেন থেকে রেমিট্যান্স আসাও কমে যাচ্ছে। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ব্রিটেন থেকে এসেছে মাত্র ১৬ কোটি ৮৮ লাখ ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে এসেছিল ২৩ কোটি ২৪ লাখ ডলার। আর ওই অর্থবছরের পুরো সময় এসেছিল ৮৬ কোটি ডলার।
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বলেন, ‘ইউএস ডলারের সমপরিমাণ না হলেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ট্রেড হয় পাউন্ডে। ওই দেশটিতে পোশাক ছাড়াও বেশ কিছু খাদ্যপণ্য রফতানি হয়। যেসব রফতানি আদেশে পাউন্ডে মূল্য পরিশোধের কথা থাকে সেগুলো পাউন্ডেই পরিশোধ করা হয়।’
আনিস এ খান আরও বলেন, ‘ব্রিটেন থেকে রেমিট্যান্স আসাও এখন অনেক কমে যাচ্ছে। আগে আমাদের এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো থেকে যেখানে ৪০০ থেকে ৫০০ ডলার আয় হতো এখন সেখান থেকে ১০০ ডলারও আয় হয় না। এভাবে চলতে থাকলে এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো বন্ধ করে দিতে হবে।’
বিনিময় হারে পতনের ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে থাকা পাউন্ডও মূল্য হারিয়ে পুনর্মূল্যায়ন-সংক্রান্ত লোকসান (রিভ্যালুয়েশন লস) বাড়িয়ে তুলছে। গত জুন থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১০ কোটি ডলারের মতো লোকসান হয়েছে সংস্থাটির। এ লোকসান না হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ আরও বড় হতো বলে জানিয়েছেন ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের কর্মকর্তারা। তাছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছেও এখন কিছু পরিমাণ পাউন্ড রয়েছে। পাউন্ডের দরপতনে এ ব্যাংকগুলোকেও লোকসান গুনতে হচ্ছে।