নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) আওতাধীন বিমানবন্দর থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত সড়কের দূরত্ব ২৬ কিলোমিটার। অপেক্ষাকৃত কম ব্যস্ত সময়ে (অফ পিক) এ সড়কে গাড়ির গতিসীমা ২২ কিলোমিটার। আর ব্যস্ত সময় (পিক) গতিসীমা প্রতি ঘণ্টায় ৯ কিলোমিটারের নিচে নেমে যায়। ধীরগতির কারণে প্রতি মাসে এই ২৬ কিলোমিটার সড়কে আর্থিক ক্ষতি হয় ২২৭ কোটি টাকা। আর এ সড়কে প্রতিবার যাতায়াত করতে একজন যাত্রীকে বাড়তি যে সময় ব্যয় করতে হয়, তার আর্থিক মূল্য গড়ে জনপ্রতি ৫৩ টাকা।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নগর পরিস্থিতি ২০১৬: ঢাকা মহানগরে যানজটÑশাসনব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। এটি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) নগর পরিস্থিতিবিষয়ক সিরিজ গবেষণার পঞ্চম প্রতিবেদন। গতকাল মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে এই গবেষণা প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়।
এতে বলা হয়, যানজটের কারণে মাসিক আর্থিক ক্ষতির মধ্যে অতিরিক্ত সময়ের জন্য ২০৪ কোটি টাকা এবং জ্বালানি বাবদ ২৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। আর বছরে ক্ষতির পরিমাণ দুই হাজার ৭২৬ কোটি টাকা। তবে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলোকে শক্তিশালীকরণে এবং ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের মাধ্যমে ঢাকার যানজট ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমানো সম্ভব বলে প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়।
যানজটে পড়ে যে সময় নষ্ট হচ্ছে, তার আর্থিক মূল্য পরিবহন ব্যয় ও জ্বালানি খরচ বিবেচনায় নিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া গবেষণায় যানজটের ফলে ক্ষয়ক্ষতি ও অস্বস্তি, মানসিক চাপ ও আচরণের পরিবর্তনসহ নাগরিক জীবনের ওপর প্রভাবও আলোচনা করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যানজটের কারণে চাকরিজীবী এবং শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। কারণ নগরীর জনগোষ্ঠীর প্রায় ৯৮ শতাংশ দিনে দুটি ট্রিপ ব্যবহার করে। এদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ ট্রিপ ব্যবহার হয় কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতের জন্য আর ২৯ শতাংশ ট্রিপে শিক্ষার্থীরা যাতায়াত করেন। এই যাতায়াতের জন্য বাস সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়। তারপরই রয়েছে রিকশার ব্যবহার।
চারটি প্রধান সমস্যার কারণে বর্তমানে এ যানজট হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। এর মধ্যে যত্রতত্র পার্কিংয়ের কারণে ২৩ শতাংশ, ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য ২১ শতাংশ, ট্রাফিক আইন ভঙ্গের কারণে ২০ শতাংশ এবং রাস্তা মেরামতের কারণে ৯ শতাংশ যানজট সৃষ্টি হয়। এছাড়া ফুটপাতের বাজে ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবও যানজটের অন্যতম কারণ।
ট্রাফিক আইন কার্যকর ও মেনে চলার হারও অত্যন্ত নাজুক। প্রতিবেদনে দেখা যায়, মাত্র দুই শতাংশ গণপরিবহন সব সময় ট্রাফিক আইন মেনে চলে। আর বাকি ৯৮ শতাংশ সব সময় কিংবা প্রায়ই ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে। অন্যদিকে ৬৮ শতাংশ ব্যক্তিগত গাড়ি বিভিন্নভাবে ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে। এছাড়া রাস্তার ওপর গাড়ি থামিয়ে ট্রাফিক পুলিশের এলোমেলো কাগজপত্র যাচাই করা যানজটের আরেকটি কারণ। এ ধরনের তল্লাশির ফলে মাসে প্রতিটি গাড়ির নামে প্রায় ১৫টি মামলা হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
অপ্রাতিষ্ঠানিক চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে মানসম্পন্ন গাড়ির সেবা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। আর নি¤œসক্ষমতার গাড়ি রাস্তায় নামার ফলে গাড়ির সংকট দিন দিন বেড়ে চলেছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাস কোম্পানিকে প্রতিদিন ঢাকা ট্রান্সফোর্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং সড়ক পরিবহন ওয়ার্কার্স ফেডারেশনকে গাড়িপ্রতি ৪০ টাকা এবং ৩০ টাকা করে দিতে হয়। মাসে মোট তিন হাজার গাড়ি থেকে দেওয়া এই চাঁদার পরিমাণ প্রায় ৬৩ লাখ টাকা।
রাস্তার পাশে হকারদের ব্যবসার কারণে যানজট তীব্র হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। ঢাকার সড়কে প্রায় ২৬ লাখ হকার ব্যবসা করে। যারা ডিএমপি এলাকার প্রায় ৭৮ শতাংশ সাইডওয়াক দখল করে আছে। ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার জন্য এজন্য নিয়মিতভাবে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ ও গ্রুপকে নির্দিষ্ট হারে অবৈধ অর্থ দিয়ে থাকে তারা। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, বছরে হকারদের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থের পরিমাণ প্রায় এক হাজার ৮২৫ কোটি টাকা, যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মোট বাজেটের কাছাকাছি। ঢাকার ফুটপাতের এ অনানুষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার ভুক্তভোগী কম-বেশি সবাই। সাধারণ জনগণ জনবহুল ফুটপাতে হাঁটার ক্ষেত্রে চরম ভোগান্তির শিকার হন। একইসঙ্গে তা যানজটও বাড়ায়।
গবেষণায় প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যবস্থাপনাগত সমস্যা যানজটের অন্তর্নিহিত কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন সিটির সড়ক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে ৩০টিরও বেশি সংস্থা সম্পৃক্ত, যা সমন্বয় প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা (বিআরটিএ) এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ভূমিকা আলোচনা করা হয়েছে।
ঢাকার যানজট নিরসনে ও পরিবহন পরিচালন উন্নয়নের জন্য প্রধানত পাঁচটি সুপারিশ করা হয়Ñট্রাফিক ব্যবস্থাপনাকে গতিশীল করতে প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেলের সংখ্যা কমাতে হবে, অধিক ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ও মানসম্মত পাবলিক পরিবহন চালু করতে বিনিয়োগ বাড়ানো, ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সক্ষমতা বৃদ্ধি, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় জড়িত অন্যান্য সরকারি সংস্থার সক্ষমতা এবং অনানুষ্ঠানিক যে চর্চাগুলো রয়েছে, তা আইনি কাঠামোর মাধ্যমে বাধ্যবাধকতা তৈরি করা।
গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে নগর উন্নয়ন কেন্দ্রের (সিইউএস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সাঈদ সাদ্ আন্দালিব, ডিএমপির প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার নাঈম আহমেদ বক্তব্য রাখেন। বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ড. সুলতান হাফিজ রহমানের সভাপতিত্বে প্রতিষ্ঠানের রিসার্চ ফেলো ড. শাহনেওয়াজ হোসাইন প্রতিবেদনের ওপর বক্তব্য দেন।