নাজমুল হুসাইন: ব্র্যান্ডের একটি টেইলার্সে স্যুট বানিয়ে মজুরি গুনতে হয় পাঁচ থেকে ছয় হাজার, যা সাধারণ টেইলার্সের মজুরির তুলনায় দ্বিগুণের বেশি। তবে এসব ব্র্যান্ডের পোশাকেই রয়েছে বড় ফাঁকি। তাদের নিজের সক্ষমতা না থাকায় ওইসব স্যুট বানাচ্ছে বেনামি সরবরাহকারীরা। তাও মাত্র এক থেকে দেড় হাজার টাকায়। এতে অধিক টাকা ব্যয়ে প্রতারিত হচ্ছে সেবাগ্রহীতারা।
জানা গেছে, নামডাকে ব্র্যান্ড হয়ে ওঠা অধিকাংশ টেইলার্স যে পরিমাণ অর্ডার পাচ্ছে তার এক-তৃতীয়াংশও উৎপাদন সক্ষমতা তাদের নেই। ফলে এ অসাধু পন্থা অবলম্বন করছে তারা। ফলে রমনা, পল্টন, নীলক্ষেত এলাকায় দুই শতাধিক ব্র্যান্ড টেইলার্সের পোশাক সরবরাহকারী কারখানা গড়ে উঠেছে। যারাই এসব ব্র্যান্ড পোশাকের প্রকৃত কারিগর।
রেমন্ড, টপ-টেন, ফেরদৌস, সানমুন বা ফিট এলিগেন্স। যেই নামই হোক, সবই টেইলার্সের স্যুট কোট বা ব্লেজার তৈরি হয় এসব কারখানায়। এতে একদিকে মানসম্পন্ন পোশাক বানিয়ে নিতে অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে বেনামি কারখানায় পোশাক নিয়ে প্রতারিত হচ্ছে ভোক্তা। অন্যদিকে টেইলার্সগুলোর ব্যয় সংকোচন এসব সরবরাহকারীরা বাধ্য হয়েই নিম্নমানের পোশাক সরবরাহ করছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েক বছরে দেশে টেইলার্সগুলোর লক্ষণীয় পরিবর্তন এসেছে। অনেক টেইলার্সই হয়ে উঠেছে ব্র্যান্ড। চাকচিক্য এসব ব্র্যান্ডের বিস্তার এলাকার মোড়ে মোড়ে। অত্যাধুনিক ডিজাইন, উন্নত প্রযুক্তি মেশিনপত্রসহ সেরা কারিগরের তৈরি পোশাকের ঘোষণা দিয়ে তাদের প্রচারে প্রসারও বাড়ছে। আর সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে এসব ব্র্যান্ড টেইলার্সে পোশাক তৈরির মজুরিও বাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে প্রতিদিন। নামডাকের কারণে সাধারণ মানুষও ছুটছে এসব টেইলার্সে। এসব পুঁজি করে যথারীতি প্রতারণায় নেমেছে এসব ব্র্যান্ড টেইলার্স।
সরেজমিনে গতকাল রমনা, পল্টন ও নীলক্ষেত এলাকায় কয়েকটি মার্কেট ঘুরে এসব অভিযোগের প্রমাণ মেলেছে। রমনা ভবন, সিটি ভবন, পীর ইয়ামিনি মার্কেট, খদ্দর মার্কেট, পলওয়েল মার্কটের আশপাশসহ নীলক্ষেতে কয়েকটি দোকান মিলে রাজধানীজুড়ে এমন শীতের পোশাক সাপ্লায়ের প্রায় দেড় শতাধিক দোকানের সন্ধান মিলেছে। যারা শুধু রাজধানী নয়, সারা দেশের টেইলার্সগুলোর কোট, স্যুট ব্লেজার, সেরোয়ানি, কটি গোপনে বানিয়ে দেয়। এদের নিজস্ব কোনো টেইলার্স নেই; শুধু এমন অর্ডারের পোশাক বানিয়েই চলছে।
ওইসব মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, শীতের কারণে এখন ব্যস্ত এসব সাপ্লায়াররা। ফেরদৌস, রেমন্ড শপ, রিচম্যান, টপ-টেন, ব্লেজার বিডি, সিটি এলিগেন্স, ফিট এলিগেন্ট, আইকন, সানমুন, ডায়মন্ড, সেঞ্চুরিসহ প্রায় সব টেইলার্সের স্যুট কোট বানানো হচ্ছে এসব কারখানায়। তবে অল্প পারিশ্রমিকে এসব তৈরি হচ্ছে প্রচুর অযতেœ। আবার এসব স্যুট তৈরির ক্ষেত্রে নি¤œমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে।
পীর ইয়ামিনি মার্কেটের পেছনে আন্ডারগ্রাউন্ডে রফিক হোসেন নামের এক কাটিং মাস্টারের কাছে কোনো টেইলার্সের পোশাক কাটছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব তথ্য আমরা গোপন রাখি। এতে যে টেইলার্সের কাজ করি তাদের নাকি সুনাম নষ্ট হয়। আমরা কাউকে বলি না।
এসব সাপ্লায়ারের সঙ্গে কথা বলে উঠে আসে বড় টেইলার্সগুলোর মুনাফা প্রবণতার তথ্য। এসব সাপ্লায়ার বলেন, বড় টেইলার্সে একটি স্যুটের মজুরি পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। সেটা সেলাইয়ের জন্য এসব সাপ্লায়ার পাচ্ছেন মাত্র এক হাজার ২০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। প্রায় সব বড় টেইলার্সই একই পরিমাণে বিল দেয়। তারা যখন নিজেদের কাজ সামলাতে পারে না, তখন কাপড় নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে এসব মার্কেটে। অনেক ক্ষেত্রে তারাই উপকরণ দিয়ে হাজার টাকার মধ্যেও স্যুট কোট সেলাই করে নেয়।
ঢাকা দর্জি শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাবেক কার্যকরী সভাপতির তাজুল ইসলাম মাইজভাণ্ডারী বলেন, এতে তাদের খরচ অনেক কম হয়। কারণ ব্লেজার কোট শীতেই চলে। তা তৈরির জন্য অনেক কারিগর নিলে বাকি সময় বসে বেতন দিতে হবে। উল্টো দিকে তাদের কাজখানায় আরও বিনিয়োগের প্রয়োজন। আর এভাবে বানিয়ে নিলে সেই বিনিয়োগও করতে হয় না।
এসব মার্কেটে যারা স্যুট ব্লেজার বানাচ্ছেন তারা অদক্ষ নন। অনেকেই আগে বড় বড় টেইলার্সে কাজ করেছেন। এখন নিজের উদ্যোগে এসব প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন। তবে বড় টেইলার্সগুলোর কম পারিশ্রমিক দেওয়ার কারণে পণ্যের মান অনেক সময় খারাপ হচ্ছে। বাধ্য হয়ে অনেকে নি¤œমানের উপকরণে ব্যবহার করে মুনাফা করার চেষ্টা করছে। কারণ কিছু টেইলার্স থেকে উপকরণ সরবরাহ হলেও তা ব্যবহার হচ্ছে কি না, তা তদারক হয় না। বিশেষ করে স্যুটের ক্ষেত্রে উপকরণে নি¤œমানের হলেও তা বোঝার উপায় নেই। এতে করে কম খরচে তা তৈরি করা সম্ভব।
এসএ ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী সুমন আহম্মেদ বলেন, একটি কোট বানাতে কাপড় ছাড়াও আরও সাত উপকরণ লাগে। যেগুলোর মানের কারণে দাম ভিন্ন। একটি কোট বানাতে দুই গজের মতো ফিউজিং ও লাইনিংয়ের কাপড় লাগে। এগুলো প্রতি গজ ৬০ টাকা দামেও পাওয়া যায়, আবার ১৫০ টাকাও পাওয়া যায়। এ দুই কাপড়ই নি¤œমানের ব্যবহার করলে ২০০ টাকা বাঁচে।
তিনি বলেন, পারিশ্রমিকে পর্তা না হলে এমন নি¤œমানের উপকরণ ব্যবহার হতেই পারে। এছাড়া বোতাম, সুতা, বখরম, সোল্ডার প্যাড, কলারের ফেল সব কিছুরই ভালোমন্দ রয়েছে। এসবের মান সম্পর্কে ব্যবহারকারী জানে না।
বর্তমানে রাজধানীসহ সারা দেশে প্রচুর টেইলার্স এভাবে পোশাক তৈরি করাচ্ছে। কারণ বড় অনেক টেইলার্স রয়েছে যাদের সক্ষমতা অর্ডারের এক-তৃতীয়াংশও নয়। এছাড়া একেবারেই কারখানা নেই এমন টেইলার্সও রয়েছে। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে এসব টেইলার্সের সংখ্যা বেশি। যারা স্যুট কোট অর্ডার নিলেও তাদের নিজস্ব কোনো কারিগর নেই। তারা কুরিয়ারের মাধ্যমে এসব সাপ্লায়ারের কাপড় মাপ পাঠাচ্ছে। আবার অনেক টেইলার্স শুধু শীতে স্যুট কোটের কাজ হয় বলে ওই ধরনের পোশাকের জন্য কারিগর রাখে না। তারাও এদের ওপর নির্ভর করে।
মাইজভাণ্ডারী আক্ষেপ করে বলেন, নিজেই দেখেছি অনেক বড় টেইলার্স হয়েছে, যারা আগে কাপড়ের ব্যবসায়ী ছিল। পড়ে পাশাপাশি তারা টেইলার্স চালু করে। তাদের টেইলার্স আছে তবে কোনো কারিগর নেই। অর্ডার নিয়ে এসব মার্কেট থেকে কাপড় বানিয়ে নেয়। তারাই এ ব্যবসার প্রসার ঘটিয়েছে।
দেশে কী পরিমাণ টেইলার্স রয়েছে তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। এছাড়া টেইলার্সগুলোর নেই কোনো সেবার নির্ধারিত ফিও। তবে টেইলার্সগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ড্রেসমেকার অ্যাসোসিয়েশনের বলছে, সারা দেশে লক্ষাধিক টেইলার্স রয়েছে। তবে ভালো মানের টেইলার্সের সংখ্যা হবে হাজারের মতো। ৭৫ হাজার টেইলার্স অতি সাধারণ মানের এবং ছোট পরিসরের ধরা হয়। আর রাজধানীতে বড় টেইলার্স, যাদের একাধিক শাখা রয়েছে এমন টেইলার্সের সংখ্যা প্রায় অর্ধশত।
এদিকে টেইলার্সগুলোর প্রতারণা সম্পর্কে জানতে চাইলে ওই সংগঠনের মহাসচিব হারুন-উর-রশিদ বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা অবগত রয়েছি। এটা প্রতারণা, সেই বিষয়ে আমরা একমত। এতে যেমন প্রতারিত হচ্ছে সেবাগ্রহীতা, তেমন ছোট ও মাঝারি টেইলার্সগুলোর কাজের সুযোগ কমছে।
তিনি বলেন, আমরা বড় টেইলার্সের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। সাপ্লায়ারদেরও অন্যের অর্ডারে কাজ না করে নিজে অর্ডার নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। তবে তা বন্ধ হয়নি। ব্র্যান্ডগুলো অনেক শক্তিশালী হওয়াতে এখন আর কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া যায় না।