ব্লু হোয়েল: সতর্ক করছি নাকি উসকে দিচ্ছি

সীমান্ত প্রধান: প্রযুক্তির এ যুগে কোনো খবর ছড়াতে তেমন সময়ের দরকার হয় না। সুসংবাদ, দুঃসংবাদ, আবিষ্কার, ঘোষণা কিংবা যে-কোনো তথ্য-উপাত্ত যাহোক না কেন, মুহূর্তেই সবকিছু পৌঁছে যাচ্ছে কোটি কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর কাছে। সেসব নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনাসহ সৃষ্টি হয় নানা তর্কের। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ফেসবুকজুড়ে ভাসছে ‘ ব্লু হোয়েল’! বলা চলে, বর্তমানে এটিই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।

বাংলাদেশের প্রায় সব ফেসবুক ব্যবহারকারীর ওয়ালে এ-সংক্রান্ত নানা পোস্ট ঘুরে বেড়াচ্ছে! অধিকাংশই সতর্কতামূলক। এসব পোস্টে তুলে ধরা হচ্ছে ‘ব্রু হোয়েল’-এর নানা দিক। বলা চলে, পুরো বাংলাদেশ এখন ব্লু হোয়েল-জ্বরে আক্রান্ত, আতঙ্কিত; অভিভাবকরা নিজ সন্তানের নিরাপত্তা-চিন্তায় যারপরনাই উদ্বিগ্ন।

গত ক’দিনে ফেসবুকের কল্যাণে বাংলাদেশের প্রত্যেক স্তরে ব্লু হোয়েলের খবর বিদ্যুৎগতিতে পৌঁছে গেছে। ইতোমধ্যে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষই জেনে গেছে ব্লু হোয়েল কী ও এর প্রভাবে কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে। কেউ কেউ হয়তো অধিক কৌত‚হলী হয়ে ইতোমধ্যে গেমসটি খুঁজতেও শুরু করেছেন! সোশ্যাল মিডিয়ার আলোচনা থেকে দেশের প্রতিটি সংবাদপত্রও ব্লু হোয়েল-সংক্রান্ত সংবাদ বেশ গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করছে। সে সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজধানীর হলিক্রস স্কুলের ছাত্রী অপূর্বা বর্ধন স্বর্ণার আত্মহত্যা।

বলা হচ্ছে, অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া এ কিশোরী ‘ব্লু হোয়েল’ গেমসে আসক্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছে। রাজধানীর ধানমন্ডির সেন্ট্রাল রোডের ৪৪ নম্বর বাসার ৫বি ফ্ল্যাট থেকে ৬ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৬টার দিকে তার ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। পরিবার সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছে, তাদের মেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ানির্ভর ব্লু হোয়েল গেমসে আসক্ত হয়ে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে।

ব্লু হোয়েল নিয়ে যখন সোশ্যাল মিডিয়া সরগরম, ঠিক তখন এ গেমসে আসক্ত হয়ে কিশোরী স্বর্ণার আত্মহত্যার খবরটি তোলপাড় সৃষ্টি করে। দেশের প্রায় সবক’টি সংবাদমাধ্যমও বলেছে, ব্লু হোয়েল গেমসে আসক্ত হয়ে স্বর্ণা আত্মহত্যা করেছে। যদিও এ আত্মহত্যার সঙ্গে ব্লু হোয়েলের সম্পৃক্ততার কোনো ভিত্তি পাওয়া যায়নি। ফলে এ গেমসে আসক্ত হয়ে স্বর্ণার আত্মহত্যার যে খবর চাউর হয়েছে, তা গুঞ্জন বলে মনে করছেন অনেকে। কেননা এতে আসক্ত হয়ে ইতিপূর্বে যারা আত্মহত্যা করেছে, তাদের শরীরে ‘ ব্লু হোয়েল’-এর চিহ্ন ছিল বলে বিভিন্ন খবরে উঠে এসেছে। কিন্তু স্বর্ণার ক্ষেত্রে সেটি অনুপস্থিত। তাই এ আত্মহত্যার ধরনটি আর আট-দশটি আত্মহত্যার মতো বলে ধরে নিচ্ছেন অনেকে।

তবে সে যাহোক, ব্লু হোয়েল গেমস যে মরণঘাতী, তা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে পাওয়া তথ্য থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে এ গেমস সম্পর্কে ইতোমধ্যে যে সতর্কবার্তা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তাতে এর প্রতি মানুষের কৌত‚হল আরও বেড়ে যাচ্ছে। অনেকেই নানাভাবে জানার চেষ্টা করছেন ব্লু হোয়েল আসলে কী। ফলে সাবধান করতে গিয়ে সতর্কবার্তা প্রেরণের ব্যাপারটি এ গেমসের প্রচারে বিশেষ ভূমিকা রাখছে যা হিতে বিপরীত হচ্ছে।

গেমসটি সম্পর্কে আমারও জানা ছিল না। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া সতর্কবার্তার কারণে কৌত‚হলী হয়ে এ সম্পর্কে জেনেছি। আমার মতো আরও অনেকেই এভাবে গেমসটি সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছেন। কেউ হয়তো কৌত‚হলপ্রবণ হয়ে এর প্রতি আসক্তও হচ্ছেন বা হয়ে উঠতে পারেন। তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? যে সতর্কবার্তা ছড়ানো হচ্ছে, তার মাধ্যমে মানুষ এ গেমসের ব্যাপারে উৎসাহিত হচ্ছে! সে মতে সতর্কবার্তার মাধ্যমে আমরা নিজেরাই নিজেদের অজান্তে ‘ব্লু হোয়েল’ গেমসের প্রচার চালাচ্ছি!

কৌত‚হলের কারণে ব্লু হোয়েল সম্পর্কে জানতে দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমের আশ্রয় নিয়ে জানতে পারি গেমসটি সত্যিকার অর্থে প্রাণঘাতী। এটি মূলত অ্যাপসভিত্তিক কোনো গেমস নয়। গুগল বা প্লে-স্টোরেও এর কোনো অস্তিত্ব নেই। এটি একটি লিংকের মাধ্যমে স্মার্টফোনে ব্যবহৃত বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এসে যায়। যেমন ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ উল্লেখযোগ্য।

ব্লু হোয়েল মূলত এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। এর নেপথ্যে থাকেন একজন ক্যাপটেন। এখানে রয়েছে এক থেকে ৫০টি ধাপ। প্রতিটি ধাপই রোমাঞ্চকর, চ্যালেঞ্জনির্ভর। যারা এ চ্যালেঞ্জ একবার গ্রহণ করেন, তারা এতে আসক্ত হয়ে পড়েন। মূলত এ কারণেই বলা হয়ে থাকে ব্লু হোয়েলে ঢোকা যায়; কিন্তু বের হওয়া যায় না! এর প্রথম ধাপগুলো খুব সহজ ও দারুণ মজার। তবে সবার ক্ষেত্রে ধাপগুলো এক হবে তা কিন্তু নয়। একেকজনের মানসিকতার ওপর নির্ভর করে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হয়। এ জন্য চ্যালেঞ্জারের সঙ্গে গেমস প্ল্যানার নানাভাবে কথা বলে তার মানসিকতা সম্পর্কে জেনে নেন। এরপর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে কিছু ধাপ সহজে অতিক্রমের ফলে এর প্রতি আসক্তি বাড়তে থাকে।

তবে গেমসটির ২৭তম ধাপ থেকে শুরু হয় মূল টার্নিং পয়েন্ট। এ ধাপগুলোয় এসে গেমস চ্যালেঞ্জাররা এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েন যা ভয়ানক ড্রাগসের নেশাকেও হার মানিয়ে দেয়। আর এ গেমসের ৫০তম ধাপে রয়েছে আত্মহত্যার চ্যালেঞ্জ, যা ইতোমধ্যে অনেকেই গ্রহণ করেছেন বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে জানা গেছে। এ গেমসের দু-তিন ধাপ পেরোনোর পর চ্যালেঞ্জারকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। এদের প্রতি গেম প্ল্যানারের নির্দেশই থাকে একা থাকতে হবে এবং তার নির্দেশনা ঠিকঠাকভাবে মেনে চলতে হবে।

কারও কারও মতে, কোনো একটি দুষ্টুচক্র দুর্বল চিত্তের কিশোর-কিশোরীকে টার্গেট করে এ গেমসের মাধ্যমে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে, যা অনেকটা ব্রেন ওয়াশের মতো। যেমন জঙ্গিরা ব্রেন ওয়াশের মাধ্যমে ‘মৃত্যুর পর সুন্দর একটি জীবন রয়েছে’ বুঝিয়ে আত্মঘাতী জঙ্গি তৈরি করে, তেমনিভাবে ব্লু হোয়েল গেম প্ল্যানারও বলে থাকে ‘৫০তম ধাপে তোমাকে আত্মহত্যা করতে হবে ৫১তম ধাপে যেতে হলে’। এভাবে হয়তো ব্লু হোয়েল-আসক্তরা চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেন।

এ গেমস-আসক্তি থেকে ফিরে আসা পশ্চিমবঙ্গের নবম শ্রেণি পড়ুয়া এক কিশোর বলেছে, যখন সে গেমসটি খেলেছে, তখন তার মস্তিষ্কে এডমিনের নির্দেশনা ছাড়া অন্য কোনো ভাবনা কাজ করেনি। এডমিনের নির্দেশে সে তার বাম হাত কেটে ইংরেজিতে ‘ব্লু হোয়েল’ও লিখেছে। এমনকি এ গেমস-আসক্তির কারণে সে তার পরিবার থেকেও আলাদা হয়ে যাচ্ছিল। একা থাকার নির্দেশনা তাকে এডমিন দিয়েছিল। তবে বিষয়টি তার পরিবার জেনে ফেলায় এখান থেকে তাকে ফেরানো সম্ভব হয়েছে।

২০১৩ সালে রাশিয়ার ২২ বছরের তরুণ ফিলিপ বুদেকিন ব্লু হোয়েল আবিষ্কার করে। এ বছর তাকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করার পরই সে এটি আবিষ্কার করে। তবে ওই সময় এ গেমস সম্পর্কে কেউই কিছু জানতেন না। ছিল না কোনো প্রচারও। মূলত ২০১৫ সালে সাইবেরিয়ার দুই স্কুলছাত্রী জুলিয়া কনস্তান্তিনোভা (১৫) ও ভেরোনিকা ভলকোভা (১৪) একটি বহুতল ভবন থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করার পরই পুলিশি তদন্তে এর রহস্য বের হয়ে আসে। ফিলিপ বুদেকিনকে গ্রেফতারের পর সে পুলিশকে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে এ গেমস আবিষ্কারের কথা বলেছে। তবে এ জন্য সে নিজেকে অপরাধী নয়Ñসমাজ সংস্কারক হিসেবে দাবি করেছিল!

তার দাবি, ‘যারা মানসিকভাবে দুর্বল, তারা এ পৃথিবীর জঞ্জাল। তাদের পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। আমি তাদের সাফ করে সমাজ সংস্কারের কাজ করছি।’

এদিকে ব্লু হোয়েল নিয়ে নানারকম বিভ্রান্তিমূলক তথ্যও পাওয়া যায়। গেমসটিতে আসক্ত হয়ে এ পর্যন্ত রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে যতসংখ্যক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করা হচ্ছে, এর কোনো ভিত্তি নেই। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে এ পরিসংখ্যানের কোনো মিল পাওয়া যায় না। কেবল রাশিয়ার দুই স্কুলছাত্রী ও ভারতে এ গেমসের কারণে একটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এসব আত্মহত্যার ঘটনা নিয়ে মামলা পর্যন্ত হয়েছে। ভারতের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রর নেতৃত্বে গঠিত সুপ্রিমকোর্টের বেঞ্চ সে মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।

৯ সেপ্টেম্বর অনলাইন ভার্সনে প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিক দাবি করেছে, ব্লু হোয়েলে বাংলাদেশেই ৬১ জনের প্রাণ গেছে। পার্শ্ববর্তী ভারতে এর সংখ্যা ১৩০। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেই মারা গেছেন ২০ জন! যদিও এ পরিসংখ্যান নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি রয়েছে, তারপরও শিশু, কিশোর ও তরুণদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রাণঘাতী এ গেমসটি বন্ধে বাংলাদেশ সরকারকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে প্রত্যেক পরিবারের বাবা-মাকে অধিক সচেতন হতে হবে সন্তানের নিরাপত্তায়। এরকম ঘৃণ্য একটি গেমসের নেশায় আমাদের সন্তানরা যেন কিছুতেই জড়িয়ে না পড়ে।

তবে এ গেমস নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় যেভাবে সতর্কবার্তা প্রেরণ করা হচ্ছে ও এ-সংক্রান্ত পোস্ট দেওয়া হচ্ছে, তা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। কেননা, বাংলাদেশে এ গেমস বন্ধে সরকার উদ্যোগ গ্রহণ না করলে এসব সতর্কবার্তা তেমন কোনো কাজে আসবে না। বরং এর মাধ্যমে মানুষ আরও বেশি কৌত‚হলী হয়ে উঠবে। কেউ কেউ কৌত‚হলবশত এ গেমসে প্রবেশও করবে। ‘ব্লু হোয়েল’ নিয়ে এখনই যারপরনাই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তবে সতর্ক থাকা অবশ্যই উচিত। বিশেষ করে উঠতি বয়সীদের দিকে নজর রাখা জরুরি। কেননা এ বয়সী ছেলেমেয়েরা সচরাচর একটু বেশি কৌত‚হলপ্রবণ হয়ে থাকে। ‘দেখি কী হয়’এমন কৌত‚হল থেকে তারা উঁকি দিতে পারে ‘ ব্লু হোয়েল’-এ। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত এ প্রাণঘাতী গেমস স্থায়ীভাবে বন্ধ না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

 

কবি ও সাংবাদিক

simantapodhan05Ñgmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০