ইসমাইল আলী: কয়লা দুর্নীতি নিয়ে সম্প্রতি আলোচনায় বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি। এক লাখ ৪০ হাজার টন কয়লা উধাও হয়ে যাওয়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত এ কোম্পানিটির অনিয়মের চিত্র সম্প্রতি সামনে আসে। এ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও পেট্রোবাংলা পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, যদিও বড়পুকুরিয়ার কয়লার দাম নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক বাজারের প্রায় দেড়গুণ দামে কয়লা বিক্রি করে কোম্পানিটি। এতে কয়েক বছর ধরেই অস্বাভাবিক মুনাফা করছে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি।
তথ্যমতে, গত মাসে কয়লার মূল্য আরেক দফা বৃদ্ধির প্রস্তাব করে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কাছে পাঠানো এ প্রস্তাবে প্রতি মেট্রিক টন কয়লার দাম প্রায় সাড়ে ৩৮ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়। এর জবাবে কোম্পানিটির অস্বাভাবিক মুনাফার তথ্য তুলে ধরে তা প্রত্যাখ্যান করে পিডিবি। কারণ হিসেবে বলা হয়, উচ্চ দরে কয়লা কেনা ও তা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করায় পিডিবির লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে।
বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে পিডিবি জানায়, ২০১২-১৩ অর্থবছরে কোম্পানিটি ৩৮ শতাংশ মুনাফা করে। সে বছর আট লাখ ৫৪ হাজার ৮০৪ মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলন করা হয়। এতে ব্যয় হয় ৫৬১ কোটি ২৮ লাখ টাকা। আর সে কয়লা বিক্রি থেকে আয় হয় ৮৯৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২০১২-১৩ অর্থবছরে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির মুনাফা দাঁড়ায় ৩৩৭ কোটি টাকার বেশি।
পরের অর্থবছর মুনাফা কিছু কমে হয় ৩৩৬ কোটি ১১ লাখ টাকা। তবে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে কোম্পানিটির মুনাফার হার বেড়ে ৪১ শতাংশে পৌঁছায়। পরের অর্থবছরে কোল মাইনিং কোম্পানির মুনাফার হারও ছিল ৪১ শতাংশ। সে বছর কোম্পানিটি মুনাফা করে ৩৭৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৪২৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। সে অর্থবছর বড়পুকুরিয়ার মুনাফার হার দাঁড়ায় ৪৪ শতাংশ। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ৪৫ শতাংশ। সে অর্থবছর কোম্পানিটির মুনাফা দাঁড়ায় ৪৮২ কোটি ১৬ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির কোনো দায়িত্বশীল কর্মকর্তা মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কোম্পানিটির একজন পরিচালক শেয়ার বিজকে বলেন, এক লাখ ৪০ হাজার টন কয়লা উধাও হওয়ায় কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হাবিব উদ্দিন আহম্মদ ও খনির সচিব (মহাব্যবস্থাপক, প্রশাসন) আবুল কাশেম প্রধানিয়াকে প্রত্যাহার করেছে পেট্রোবাংলা। একই কারণে খনি বিভাগের জিএম নুরুজ্জামান চৌধুরী ও ডিজিএম খালেদুলকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। এ নিয়ে সবাই আতঙ্কের মধ্যে আছেন। তাই মুনাফা নিয়ে মন্তব্য করে কেউ ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না।
উল্লেখ্য, ২০০৭ সাল থেকে বড়পুকুরিয়া খনি থেকে কয়লা উত্তোলন শুরু হয়। নথিপত্র অনুযায়ী, এ পর্যন্ত খনি থেকে এক কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলন করা হয়েছে। তবে এর মধ্যে এক লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন কয়লার হদিস পাওয়া যায়নি। খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সচিব ও খনির মাইনিং বিভাগ এসব কয়লা বাইরে বিক্রি করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নেমেছে দুদক ও পেট্রোবাংলা। এরই মধ্যে প্রাথমিক তদন্তে অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে দুদকের তদন্ত দল।
এদিকে বড়পুকুরিয়ার কয়লা দিয়ে দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুরে অবস্থিত দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালিত হয়। কেন্দ্রটির উৎপাদন ক্ষমতা ৫২৫ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ২৭৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি ও ১২৫ মেগাওয়াট করে দুটি ইউনিট রয়েছে। কেন্দ্রটি পূর্ণ উৎপাদনে থাকলে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ হাজার ২০০ মেট্রিক টন কয়লার প্রয়োজন হয়।
১২৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার ১নং ইউনিটটি সাধারণ মেরামতের (জেনারেল ওভারহোলিং) জন্য কয়েক মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। আর ২নং ইউনিটটি কয়লা সংকটের কারণে গত ২৯ জুন বন্ধ করে দেওয়া হয়। এছাড়া কয়লা সংকটের কারণে ২৭৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩নং ইউনিটটি কয়েক দিন ধরে খুঁড়িয়ে চলে। মজুদকৃত কয়লা ফুরিয়ে যাওয়ায় ২২ জুলাই রাতে সেটিও বন্ধ হয়ে যায়।
তথ্যমতে, খনি থেকে কয়লা উত্তোলন শুরুর আগে ২০০৬ সালে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি প্রতি মেট্রিক টন কয়লার দাম নির্ধারণ করে ৬০ ডলার। ২০০৮ সালের অক্টোবরে তা ১০ ডলার বাড়ানো হয়। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রতি মেট্রিক টন কয়লার দাম নির্ধারণ করা হয় ৮৪ ডলার। এ দাম আরও বাড়িয়ে ২০১২ সালের এপ্রিলে ১০৫ ডলার ও ২০১৫ সালের জুলাইয়ে ১৩০ ডলার করা হয়। সম্প্রতি প্রতি মেট্রিক টন কয়লার দাম ১৮০ ডলার করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। যদিও এতে আপত্তি জানায় পিডিবি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কয়লার তুলনামূলক দাম তুলে ধরে সংস্থাটি জানায়, বড়পুকুরিয়ার মানের কয়লার দাম ইন্দোনেশিয়ায় প্রতি মেট্রিক টন ৭৬ দশমিক ২৫ ডলার। একই মানের আটলান্টিকের কয়লার দাম ৮৪ দশমিক ৬০ ডলার, অস্ট্রেলিয়ার কয়লার দাম ১০১ দশমিক ৩০ ডলার, ভারতের কয়লার দাম ৯৮ দশমিক ১৫ ডলার ও চীনের কয়লার দাম ৮১ দশমিক ৫০ ডলার। এ হিসাবে বড়পুকুরিয়ার কয়লার দাম আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় প্রায় দেড়গুণ। প্রতি মেট্রিক টন ১৮০ ডলার করা হলে তা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় দ্বিগুণ পর্যায়ে পৌঁছাবে।
জানতে চাইলে পিডিবির মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক পরিচালন) কাওসার আমীর আলী বলেন, বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার বাড়ছে। এতে কোল মাইনিং কোম্পানির স্থায়ী ব্যয় কমে গেছে। আবার কোম্পানিটি অস্বাভাবিক মুনাফা করছে। অথচ পিডিবি উচ্চ দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রির ফলে নিয়মিত লোকসান দিচ্ছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে একই মানের কয়লার দাম অনেক কম। তাই কয়লার মূল্য কমানো উচিত। এক্ষেত্রে বিইআরসির মাধ্যমে কয়লার মূল্য নির্ধারণে সুপারিশ করা হয়েছে।