ড. মতিউর রহমান: সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য প্রতি বছর ৩০ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবস (World Thrift Day)|। ১৯৩৪ সালের ৩০ অক্টোবর, প্রথম আন্তর্জাতিক সঞ্চয় ব্যাংক কংগ্রেসে, বিশ্ব সঞ্চয় দিবস বা মিতব্যয় দিবসের ধারণাটি ইতালীয় অধ্যাপক, ফিলিপো রাভিজ্জা প্রস্তাব করেছিলেন। এর পেছনের ধারণাটি ছিল অর্থ সঞ্চয় করার অনুশীলনকে উৎসাহিত করা, বিশেষত ব্যয় করার ক্ষেত্রে। কিছু দেশে, বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবসে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়।
সঞ্চয় এবং সঞ্চয়ের অভ্যাসকে গড়ে তুলতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালিত হয়। স্পেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানির মতো দেশগুলো অনেক উৎসাহের সঙ্গে বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবস উদযাপন করে।
পরিবার ও জাতির কল্যাণের জন্য মানুষকে মিতব্যয়ী হওয়ার কথা মনে করিয়ে দিতে দিবসটি পালিত হয়।
ইতালির মিলানে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সঞ্চয় ব্যাংকের প্রতিনিধিদের প্রথম বিশ্ব কংগ্রেসে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে দিবসটি উদযাপন শুরু হয়। সেই থেকে সঞ্চয় ব্যাংকগুলো আন্তর্জাতিকভাবে দিবসটি উদযাপন করে। এই দিনটি মূলত সার্থকতা এবং সঞ্চয়ের গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে পালন করা হয়। প্রতি বছর বাংলাদেশেও দিবসটি আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হয় এবং জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর এ উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে।
বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবস মানুষের জন্য একত্রিত হওয়ার এবং পুনর্ব্যবহার এবং সঞ্চয়ের ধারণা প্রচার করার জন্য একটি দুর্দান্ত উপলক্ষ। এই দিনে, লোকেরা সঞ্চয় সম্বন্ধে বিভিন্ন ইভেন্টে অংশ নেয়, যেমন সঞ্চয়ের পুনর্ব্যবহার করা এবং তাদের সঞ্চয়গুলো নিরাপদে রাখা।
প্রতি বছর, বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবসের জন্য একটি ভিন্ন থিম ঘোষণা করা হয়, যার ভিত্তিতে দিবসটি উদযাপনের পরিকল্পনা করা হয়। এ বছর দিবসটির থিম হলো সঞ্চয় আপনাকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করে। (Saving prepares you for the future)। যারা এ দিবসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক তাদের জন্য এই সাধারণ থিমটিতে একটি শক্তিশালী বার্তা রয়েছে।
জাতীয় উন্নয়নের জন্য অভ্যন্তরীণ সম্পদ বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের জন্য দুটি বিকল্প পদ্ধতি রয়েছে। যথা: স্বেচ্ছায় সঞ্চয় এবং কর সংগ্রহের মাধ্যমে বাধ্যতামূলক সঞ্চয়।
অর্থনীতিবিদরা বিশ্বাস করেন, ব্যক্তির স্বেচ্ছা সঞ্চয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ট্যাক্স বা রাজস্বের ওপর নির্ভরতা হ্রাস পায়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এ নীতির ওপর ভিত্তি করেই তাদের উন্নতি করেছে। সমৃদ্ধি ও সম্পদের জন্য সঞ্চয়ের মনোভাব মানুষের জীবনে একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য।
মানুষ যত বেশি তাদের জীবনে সঞ্চয় করবে, তত বেশি ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক নিরাপত্তা পাবে। বিশ্বায়নের এই প্রযুক্তিনির্ভর যুগে সঞ্চয় আর ঐতিহ্যগত ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। যেকোনো সঞ্চয় অগ্রগতি ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বলা হয়ে থাকে অর্থ উপার্জন করা কঠিন কিন্তু ব্যয় করা সহজ। মানুষ বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য কিছু অপ্রয়োজনীয় খরচ করে, যা ভবিষ্যতের জন্য অমঙ্গল বয়ে আনে।
আমরা যদি খোলা চোখে আমাদের চারপাশে তাকাই, তাহলে কিছু অপ্রত্যাশিত দৃশ্য দেখতে পাই, যা সত্যিই বেদনাদায়ক। দেখা যায় জীবন দিয়ে পরিশ্রম করেও কেউ দুই মুঠো ভাত খেতে পারে না। মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও কেউ কেউ গৃহহীন বা ভূমিহীন। কেউ কেউ বেকার ও নিঃস্ব। আবার কেউ কেউ কিছু না করেই রাজকীয় জীবনযাপন করছে। তবুও, মানুষ বেঁচে থাকার মরিয়া আকাক্সক্ষায় অর্থ উপার্জনের জন্য বিভিন্ন উপায়ে লিপ্ত হয়।
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে, উচ্চ সুদের হারে ব্যাংক বা মহাজনদের ঋণ দেয়ার প্রবণতা এখনও রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে অনেক পরিবারেই ঋণের দায়ে সর্বস্ব হারানোর নজিরও রয়েছে। আর বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই দৃষ্টান্ত তুলনামূলকভাবে বেশি। কারণ এসব দেশের জনগণের একটি বড় অংশ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। অশিক্ষিত মানুষকে ঠকানো যেমন সহজ, তেমনি তাদের দ্বারা অল্প বা বিনা বেতনে কাজ করানোও সহজ। আবার কর্মক্ষেত্রের অপ্রতুলতার কারণেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষার অবমূল্যায়ন করা হয়। কিন্তু ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে ক্ষুদ্র বিনিয়োগ হিসেবে ব্যবহার করে মানুষের জীবন পরিচালনা করা অসম্ভব নয়।
অন্যদিকে সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণির কাছে রয়েছে সীমাহীন অর্থ। তারা অপ্রয়োজনীয় খরচে আচ্ছন্ন যা সহজেই এড়ানো যায়। বিনোদন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাজার হাজার অতিথির আপ্যায়ন ইত্যাদিতে প্রচুর অর্থ অপচয় হয়। অপচয় প্রতিরোধ ও সংরক্ষণ ব্যক্তি, সমাজ এবং সর্বোপরি জাতির জন্য মঙ্গলজনক।
সঞ্চিত অর্থ আত্মনির্ভরশীলতা দিতে পারে এমন যেকোনো উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। আত্মনির্ভরশীলতার জন্য অপচয় পরিহার এবং সঞ্চয় অপরিহার্য। সঞ্চয় করার অভ্যাস একজন মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণাবলির একটি। হাজার হাজার বছর আগে থেকে মানুষ ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তুলেছে। এটি এখনও অনেকের দ্বারা লালিত একটি উত্তরাধিকার। বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবস পালন করা হয় প্রত্যেকের মিতব্যয়ী হতে এবং সঞ্চয় করার জন্য সচেতনতা তৈরি করতে।
বাংলাদেশের মতো দেশের নাগরিকদের জন্য মিতব্যয়িতা অপরিহার্য। অপব্যয় চর্চা এদেশে বেশি পরিলক্ষিত হয়। অপচয়কারীরা শুধু নিজের জন্য নয়, সমাজ, পরিবার ও জাতির জন্যও কিছু করতে পারে না। মনে রাখা দরকার, সঞ্চয় করার জন্য কাউকে ধনী হতে হয় না। প্রতিটি মানুষ একটি সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখে। এই স্বপ্ন থেকেই বিশ্বাসের জন্ম হয়। সঞ্চয়ের প্রবণতা প্রত্যয় থেকে বিকাশ লাভ করে।
অনেক সংস্কৃতিতে সঞ্চয়ের অভ্যাসকে একটি গুণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে লোকেরা প্রায়ই আবেগের দ্বারা চালিত হয় এবং এড়ানো যায় এমন কিছুও কেনাকাটা করে। বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবসে, একটি জাতির মানুষের মধ্যে সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য সঞ্চয় এবং অর্থ সঞ্চয়ের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়।
বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবস সঞ্চয়ের গুরুত্ব তুলে ধরে। আর্থিক সংকটের সময়ে সঞ্চয় একটি নিরাপত্তা জাল প্রদান করে। এটি একটি ব্যবসা শুরু করতে, একটি শালীন শিক্ষা অর্জন করতে এবং মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা পেতে আমাদের সহায়তা করে।
দেশ এবং সেখানে বসবাসকারী মানুষ আর্থিক স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে, যদি তারা সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তোলে। সঞ্চয় মানসিক এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা প্রদান করে এবং একটি ভালো জীবনযাপনের জন্য একটি সুদৃঢ় মনোভাব প্রদান করে।
সঞ্চয় আমাদের ঋণ এড়াতে, চাপ কমাতে এবং অপ্রত্যাশিত স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়ের জন্য প্রস্তুত করতে সাহায্য করতে পারে। ব্যাংকগুলো বেসরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে একত্রে, অর্থ সাশ্রয়ের অনেক উপায় বোঝার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে?
বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবস, আন্তর্জাতিক মিতব্যয়িতা দিবস বা বিশ্ব সঞ্চয় দিবস নামেও পরিচিত। ব্যক্তি, পরিবার এবং জাতি হিসেবে নিয়মিত সঞ্চয়ের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই প্রতি বছর দিবসটি পালিত হয়। এ দিনটি অর্থ সঞ্চয় করার অভ্যাসে নিজেদের পুনরায় উৎসর্গ করার কথা মনে করিয়ে দেয়।
বিশেষ করে চলমান কোভিড-১৯ মহামারি, জলবায়ু পরিবর্তন ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট অনিশ্চয়তায় ও আসন্ন মহামন্দা মোকাবিলায় সঞ্চয়ের প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব আবারও স্মরণ করিয়ে দেয়।
গবেষক ও উন্নয়নকর্মী