সাজেদা আকতার: প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের জীবনযাত্রায় আগের চেয়ে অনেক পরিবর্তন এসেছে। ঘরে বসেই এখন অনেক কাজ করা সম্ভব হচ্ছে এবং যেসব কাজ করতে অনেক দিন সময় লেগে যেত, তা এখন মিনিটেই করা সম্ভব হচ্ছে। যথারীতি প্রযুক্তির অনিয়মতান্ত্রিক ব্যবহার নষ্ট করছে সময় এবং সৃষ্টি করছে নানাবিধ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য জটিলতা। বর্তমানে সব বয়সের মানুষের মধ্যে ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্তি দেখা যায়। তবে শিশুকিশোর ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে তা বেশি। একটা সময় শৈশব ও কৈশোর ছিল দুরন্তপনার নাম। বাচ্চারা ঘরে থাকতে চাইত না, সারাদিন আড্ডা, খেলাধুলা ও নানাধরনের সামাজিক কার্যক্রমে উপস্থিত থাকত, বই পড়ে সময় কাটাত। অথচ বর্তমানে ঠিক এর বিপরীত, ইন্টারনেটের চক্করে শিশুদের ঘর থেকে বেরই করা যায় না। সারাদিন মোবাইল ফোনে গেম, ফেসবুক, টুইটার, স্নাপচ্যাট, টিকটক, লাইকিসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় থেকে কিংবা ইউটিউবে ভিডিও দেখে সময় কাটায় শিশুকিশোররা। অর্থাৎ শিশুদের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান ডিজিটাল ডিভাইস বা ইন্টারনেট। অধিকন্তু এটি বেশিরভাগ সময় ড্রাগের মতো কাজ করছে, যাকে বলা চলে ডিজিটাল ড্রাগ! এক তথ্যমতে, বাংলাদেশের পাঁচ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের মধ্যে মোট ৩০ দশমিক ৬৮ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে!
ডিজিটাল আসক্তি বলতে মূলত টেকনোলজি ও ইন্টারনেটের প্রতি আসক্তিকে বোঝায়। ডিজিটাল ডিভাইস, ইন্টারনেট বা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে করতে একটা সময় দেখা যায় এগুলো ছাড়া এক মুহূর্তও কাটানো যায় না, খাওয়া-দাওয়া ও ঘুমের অনিয়ম হয়। পড়াশোনা ও ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষতিও হয় এই আসক্তির ফলে। ড্রাগ আসক্ত ব্যক্তি যেমন ড্রাগ ছাড়া থাকতে পারে না, ডিজিটাল আসক্তিও মানুষের মধ্যে এরকম প্রভাব বিস্তার করে। গবেষণায় দেখা গেছে, স্ক্রিন আসক্তি মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল কর্টেক্সে কোকেন বা হেরোইনের মতো মাদকদ্রব্যের মতো কাজ করে। একজন মাদকাসক্ত মাদক না পেলে যেমন অস্বাভাবিক আচরণ করে থাকে, তেমনি ইন্টারনেটে আসক্তরা ইন্টারনেট ছাড়া থাকতেই পারে না। মাদকাসক্তির মতোই ইন্টারনেট আসক্তি থেকে বের হয়ে আসা অনেক কঠিন। শিশুদের স্ক্রিন আসক্তি নিয়ে লেখা বিখ্যাত গ্লো কিডস বইয়ের লেখক ড. নিকোলাস কারদারাস বলেন, আমি কয়েকশ হেরোইনে আসক্ত মানুষকে নিয়ে কাজ করেছি, আমি বরং বলি যে একজন সত্যিকারের স্ক্রিন আসক্ত ব্যক্তির চিকিৎসা করার চাইতে একজন হেরোইনে আসক্ত ব্যক্তির চিকিৎসা করা সহজ।”
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, স্ক্রিনে আসক্তরা তাদের সৃজনশীলতা হারিয়ে ফেলে। তারা সহজে কারও সঙ্গে মিশতে পারে না, গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। স্কুলের পড়াশোনায়ও পিছিয়ে থাকে। একসময় একাকিত্ব, অস্থিরতাসহ নানা রকম মানসিক সমস্যায় ভোগে।
শিশু-কিশোরদের ডিজিটাল ড্রাগে আসক্ত হওয়ার বেশকিছু কারণ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ডিজিটাল ডিভাইসের সহজলভ্যতা, অভিভাবকদের অবহেলা বা অমনোযোগিতা এবং পর্যাপ্ত খেলাধুলার সুযোগ না থাকা উল্লেখযোগ্য। আগের তুলনায় ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ফলে বর্তমানে ঘরে ঘরে স্মার্টফোন, ট্যাব, আইপ্যাড, ল্যাপটপ ও ডেস্কটপ রয়েছে। ফলে শিশুরা সহজেই ডিজিটাল ডিভাইস হাতের কাছে পাচ্ছে এবং ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে। শহরে দেখা যায়, বাবা-মা দুজনেই চাকরিজীবী হওয়ায় শিশুসন্তানকে গুণগত সময় দিতে পারে না। বাচ্চারা কী করছে, কীভাবে সময় কাটাচ্ছে, এ ব্যাপারে খোঁজ নেয়ার সুযোগ হয়ে ওঠে না। ফলে তাদের বাচ্চারা নিজেদের ইচ্ছামতো ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারের সুযোগ পায় এবং একসময় তাতে আসক্ত হয়ে যায়। আবার অনেক সময় দেখা যায়, বাবা-মা কোনো কাজে ব্যস্ত থাকলে শিশুদের বিরক্তি থেকে বাঁচতে তাদের কার্টুন বা অন্যান্য ভিডিও দেখতে বসিয়ে দেয়। এভাবে অভিভাবকের অমনোযোগিতা শিশুকে ডিজিটাল ডিভাইসের প্রতি আকৃষ্ট করে এবং পরে তা আসক্তির রূপ নেয়। এছাড়া শহরে আগের তুলনায় বর্তমানে খেলার মাঠের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। এতে যে সময়টা শিশু-কিশোররা খেলাধুলায় কাটাত, সে সময়টা তাদের ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে কাটাতে হয়।
ডিজিটাল ড্রাগে আসক্তি কতটা ভয়াবহ আকার নিয়েছে, তা আশেপাশের পরিস্থিতি দেখে সহজেই বোঝা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে গণমাধ্যম সিএনএন ‘ইবরহম ঞযরৎঃববহ’ শিরোনামে একটা ক্যাম্পেইন চালিয়েছিল। ক্যাম্পেইনে ১৩ বছরের এক কিশোরীকে জিজ্ঞেস করা হয়, যদি তার স্মার্টফোন নিয়ে নেয়া হয়, তার কেমন অনুভূতি হবে? জবাবে কিশোরী বলল, প্রয়োজনে আমি টানা এক সপ্তাহ খাবার খাব না, কিন্তু স্মার্টফোন হাতছাড়া করতে আমি মোটেও রাজি নই। এ তো গেল যুক্তরাষ্ট্রের কথা। বাংলাদেশের অবস্থা আরও ভীতিপ্রদ। কিশোররা আত্মহত্যা করছে মোবাইল না পেয়ে! কেউ কেউ আবার আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে গেমস না খেলতে পারায়! এসব ঘটনা থেকে কিশোরদের স্ক্রিন আসক্তির ভয়াবহতা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। অথচ প্রযুক্তি-দুনিয়ার প্রথম সারির লোকদের শিশুসন্তানদের প্রযুক্তি ব্যবহারের রুটিন রীতিমতো অবাক করা। অ্যাপল ব্র্যান্ডের সিইও স্টিভ জবসের শিশুরা আইপ্যাড ব্যবহারে কখনও স্বাধীন ছিল না। প্রতিদিন কত সময় তারা আইপ্যাড ব্যবহার করতে পারবে, তা নির্দিষ্ট করে দেয়া ছিল। এমনকি রাতে খাবারের টেবিলে কোনো প্রকার ডিজিটাল ডিভাইস যাতে পরিবারের কারও হাতে না থাকে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতেন স্টিভ জবস। এছাড়া গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই এবং মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের ব্যাপারেও একই কথা। তারা শিশুদের জন্য স্ক্রিন-টাইম যথেষ্ট সীমিত রাখতেন। স্ন্যাপ-চ্যাটের প্রতিষ্ঠাতা ইভান স্পাইগেল তো তার শৈশব-কৈশোরে মোবাইল ফোনই হাতে পাননি এবং তার আজকের সফলতার পেছনে তার ছোটবেলার ডিভাইস-ফ্রি লাইফের যথেষ্ট ভূমিকা আছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি নির্ধারণ করেছেন, তার শিশুরা সপ্তাহে সব মিলিয়ে কেবল দেড় ঘণ্টা স্মার্ট-ডিভাইস ব্যবহারের সুযোগ পাবে। টেক-জায়ান্টদের সোশ্যাল মিডিয়া বা ইন্টারনেট ব্যবহারের নিয়ম থেকেই বোঝা যায়, এগুলোর কুফল কতখানি। তাছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা যতটা না শেখার জন্য ইন্টারনেটে সময় ব্যয় করে, তার চেয়ে বেশি ব্যয় করে আসক্তির কারণে।
ডিজিটাল ড্রাগে আসক্ত হওয়ার পর সহজে এ থেকে বের হওয়া যায় না, তাই আসক্ত হওয়ার আগেই অভিভাবকদের এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। উপযুক্ত বয়সের আগে বাচ্চারা ডিজিটাল ডিভাইসের সংস্পর্শে যাতে আসতে না পারে, সেদিকে নজর রাখতে হবে। ডিজিটাল ডিভাইসকে বিলাসিতার বিষয়বস্তু করা যাবে না। এছাড়া বাবা-মাকে অবশ্যই বাচ্চাদের সময় দিতে হবে এবং তাদের খেলাধুলার ব্যবস্থা করে দিতে হবে, যাতে তারা ডিজিটাল ড্রাগে আসক্ত হতে না পারে। একটা সুস্থ, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সৃজনশীল প্রজš§ গঠনের পূর্বশর্ত ডিজিটাল ড্রাগ মুক্তি। তাই বাচ্চাদের তো ডিজিটাল ডিভাইস থেকে দূরে রাখতেই হবে, সেইসঙ্গে অভিভাবকদেরও নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া ‘ডিজিটাল ড্রাগ আসক্তি’মুক্ত দেশ গঠনে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়