শেখ আবু তালেব: বর্তমানে দেশের ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতে ঋণ দিচ্ছে সাত থেকে সর্বোচ্চ আট শতাংশ সুদে, অথচ প্রণোদনা ঋণ বিতরণ করছে ৯ শতাংশ সুদে। এ হিসাবেই সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নিতে আবেদন করেছে ব্যাংকগুলো। এভাবে এক থেকে দেড় শতাংশীয় পয়েন্টের বেশি সুদ ব্যাংকগুলো ভর্তুকি নিচ্ছে সরকারের কাছ থেকে। এতে সরকারের পকেট থেকে চলে যাচ্ছে এক হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত সুদ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজারদরের চেয়ে বেশি সুদহার নির্ধারণ করায় সরকারকে অতিরিক্ত সুদ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলো লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী পাওয়া গেছে এমন তথ্য। বিশ্লেষকরা পরামর্শ দিয়েছেন, বাজার অনুযায়ী সুদহার সমন্বয় করার। এতে ব্যাংকগুলো তার বিতরণ করা সর্বোচ্চ ঋণ সুদহার অনুযায়ী সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নিতে পারবে। ফলে প্রণোদনা প্যাকেজ যেমন বাস্তবায়িত হবে, তেমনি সরকারের রাজস্বও সাশ্রয় হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মো. সালেহউদ্দিন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সুদ ভর্তুকি বাজারদর অনুযায়ী সমন্বয় করা যেতে পারে। এখন তো ঋণ সুদহার আট শতাংশের নিচে রয়েছে। সরকার যদি শুধু ভর্তুকির বিষয়টি অর্থাৎ ৯ শতাংশের মধ্যে চার, সাড়ে চার বা পাঁচ শতাংশের যেকোনোটি নির্ধারণ করে দেয় তাহলে ভালো। এ সুদহার অনুযায়ী ব্যাংক বা গ্রাহককে দেবে। ব্যাংক প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে গ্রাহককে তার বর্তমান ঋণের সর্বোচ্চ হারটি দেবে। অথবা সরকার বলতে পারে, কোনো ব্যাংকের সর্বোচ্চ ঋণ হার অনুযায়ী ভর্তুকি দেয়া হবে, অর্থাৎ কোনো ব্যাংকের বেসরকারি খাতে ঋণ সুদহার বর্তমানে আট শতাংশ হলে সরকার চার শতাংশ দেবে। অবশিষ্ট চার শতাংশ গ্রহক দেবে। সেক্ষেত্রে গ্রাহক বা সরকারের এক শতাংশীয় পয়েন্ট সুদ ভর্তুকি কমে যাবে।’
এদিকে ব্যাংকগুলো সরকারের ঘোষণা করা সুদ ভর্তুকির জন্য আবেদন করেছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জমা হওয়া আবেদনের সত্যতা যাচাই-বাছাই করার কাজ চলছে। এগুলো চূড়ান্ত হলে বোঝা যাবে কত টাকার সুদ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে সরকারকে।
জানা গেছে, করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। মোট ২৩টি প্যাকেজের মাধ্যমে এ প্রনোদনার ঋণ বিতরণ শুরু হয়। পরে কয়েকটি ঋণের বিপরীতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়। সব মিলিয়ে প্রণোদনার ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকায়। এসব প্রণোদনার ঋণ বাস্তবায়নে সরকার চার থেকে পাঁচ শতাংশ হারে সুদ ভর্তুকি দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনতে উদ্যোগ নেয় সরকার। এজন্য আমানত গ্রহণে ছয় ও ঋণের বেলায় সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদহার বেঁধে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু ব্যাংকারদের চাপে শেষ পর্যন্ত শুধু ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। গত বছরের এপ্রিল থেকে তা কার্যকর করা হয়।
সুদহার বেঁধে দেয়ার সময়ই করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। পরে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য ঘোষণা করা হয় প্রণোদনা প্যাকেজ। এ প্যাকেজ ঘোষণায় সব ঋণের জন্য সর্বোচ্চ সুদহার ধরা হয় ৯ শতাংশ। এসব ঋণের মধ্যে শিল্প তথা বৃহৎ খাতের ব্যবসায়ীদের জন্য বরাদ্দ দেয়া প্রণোদনা ঋণের ৪০ হাজার কোটি টাকার ঋণে সুদ ভর্তুকি ধরা হয় সাড়ে চার শতাংশ। অবশিষ্ট সাড়ে চার শতাংশ সুদ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে পরিশোধ করবেন ব্যবসায়ীরা।
এভাবে কৃষিঋণে পাঁচ শতাংশ ও এসএমই ঋণে চার শতাংশ সুদ ভর্তুকি দেবে সরকার। অবশিষ্ট চার ও পাঁচ শতাংশ সুদ গ্রাহককে পরিশোধ করতে হবে। যদিও গত বছরের এপ্রিল মাসের প্রথম দিন থেকেই সব ব্যাংকের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে ২০২০ সালের এপ্রিল শেষে ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদহার দাঁড়ায় সর্বোচ্চ আট দশমিক ২৯ শতাংশে। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ব্যাংকগুলোর জমা দেয়া তথ্য।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালের এপ্রিল শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণ সুদহার ছিল সাত দশমিক শূন্য চার শতাংশ, স্প্রেড ছিল শূন্য দশমিক ২১ শতাংশ, দ্য সিটি ব্যাংকের ঋণ সুদহার ছিল আট দশমিক ৫৩ শতাংশ ও স্প্রেড তিন দশমিক ৫৮ শতাংশ, উত্তরা ব্যাংকের ঋণ সুদহার আট দশমিক ৩৬ শতাংশ ও স্প্রেড ছিল তিন দশমিক ৯১ শতাংশ, ইস্টার্ন ব্যাংকের আট দশমিক ৮৩ শতাংশ ও স্প্রেড ছিল তিন দশমিক ৫৪ শতাংশ, প্রাইম ব্যাংকের ঋণ সুদহার ছিল সাত দশমিক ৯১ শতাংশ ও স্প্রেড ছিল তিন দশমিক ১৯ শতাংশ এবং এনসিসি ব্যাংকের ঋণ সুদহার ছিল আট দশমিক ২২ শতাংশ ও স্প্রেড ছিল এক দশমিক ৯৯ শতাংশ।
এই সময়েই সরকার প্রণোদনার ঋণ ও ভর্তুকির সুদহার ঘোষণা করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই (আগস্ট মাসের তথ্য এখনও জমা হয়নি) মাস শেষে ব্যাংকগুলোর ঋণ সুদহার সাত দশমিক তিন শতাংশের ঘরে নেমেছে।
এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণ সুদহার দাঁড়িয়েছে সাত শতাংশে, দ্য সিটি ব্যাংকের ছয় দশমিক ৯৮ শতাংশে, উত্তরা ব্যাংকের সাত দশমিক ৮৫ শতাংশে, ইস্টার্ন ব্যাংকের সাত দশমিক ১৫ শতাংশে, প্রাইম ব্যাংকের ছয় দশমিক ৯৬ শতাংশে, এনসিসি ব্যাংকের সাত দশমিক ২৪ শতাংশে, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাত দশমিক ৮৭ শতাংশে ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের সাত দশমিক ৬৭ শতাংশে।
অথচ করোনা মহামারির সময়ে সরকারের সব খাত থেকে রাজস্ব কম আদায় হচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছে না। বিদ্যমান সুদহার অর্থাৎ সরকারের সুদ ভর্তুকির পরিমাণ কত হতে পারে এমন বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেছেন, ‘প্রণোদনার ঋণের সুদ ভর্তুকি দাবি করেছে ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করছে। মাঠপর্যায় থেকে যাচাই-বাছাই শেষে বোঝা যাবে প্রকৃত সুদ ভর্তুকির পরিমাণ কত হবে।’