ইসমাইল আলী: ২০০৯ সাল থেকেই সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে জোর দিচ্ছে সরকার। এতে গত এক দশকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বেড়ে পাঁচগুণ হয়েছে। যদিও ডিজেলচালিত বেশকিছু বেসরকারি কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অস্বাভাবিক পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। এতে প্রতি বছর বড় অঙ্কের লোকসান গুনতে হচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি)।
তথ্যমতে, এক দশকে ৬২ হাজার ৭০২ কোটি ৭২ লাখ টাকা লোকসান গুনেছে পিডিবি। আর এ ঘাটতি মেটাতে সংস্থাটিকে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে ৫৬ হাজার ৬২২ কোটি টাকা। এর পরও এক দশকে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে ৯ বার। এতে বিদ্যুতের গড় দাম বেড়ে গেছে প্রায় ৯১ শতাংশ। যদিও এক দশকের মধ্যে কয়েকবার বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমেছে। এর মধ্যে গত দুই বছর টানা কমছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়। তবে এর কোনো প্রভাব নেই বিদ্যুতের দামে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতে লোকসান ও দাম বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে মূলত দুটি কারণ। এর প্রথম কারণটি হলো অদক্ষ উৎপাদন ব্যবস্থা। এতে সক্ষমতার অর্ধেকের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। দ্বিতীয় কারণটি হলো বেসরকারি খাতে বিশেষত রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের উচ্চ ক্যাপাসিটি চার্জ। এ চার্জকে যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনলে বিদ্যুৎ খাতে লোকসান অনেক কমে যেত।
সূত্রমতে, ২০১০-১১ অর্থবছরে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল তিন টাকা ৯৫ পয়সা। আর সে অর্থবছরের শুরুতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় দাম ছিল তিন টাকা ৯২ পয়সা। তবে ২০১০-১১ অর্থবছরে পিডিবির লোকসান হয় চার হাজার ৬২০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জই ছিল দুই হাজার ৭৮৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।
যদিও ঘাটতি মেটাতে ওই অর্থবছর পিডিবিকে চার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়। এর পরও ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যুতের দাম গ্রাহক পর্যায়ে পাঁচ শতাংশ বাড়ানো হয়। এতে বিদ্যুতের গড় দাম বেড়ে দাঁড়ায় চার টাকা ১২ পয়সা।
পরের অর্থবছর বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় অনেকটা বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ টাকা ৩৬ পয়সায়। এজন্য এক বছরের মধ্যে দুই দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। প্রথম দফা ২০১১ সালের ডিসেম্বরে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় দাম বেড়ে হয় চার টাকা ৬৭ পয়সা। এর তিন মাসের মাথায় ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় দাম দাঁড়ায় পাঁচ টাকা।
এর পরও ২০১১-১২ অর্থবছর পিডিবির লোকসান বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৬৯৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। যদিও এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় ছিল পাঁচ হাজার এক কোটি ২৩ লাখ টাকা। আর লোকসানের ঘাটতি মেটাতে ওই অর্থবছর পিডিবিকে ভর্তুকি দেওয়া হয় ছয় হাজার ৩৫৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
২০১২-১৩ অর্থবছর বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় বেড়ে হয় পাঁচ টাকা ৭৭ পয়সা। তবে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরেই বিদ্যুতের গড় দাম বাড়িয়ে পাঁচ টাকা ৭৫ পয়সা করা হয়। এর পরও ওই অর্থবছর পিডিবির লোকসান দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৪৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। যদিও ওই অর্থবছর পিডিবিকে ভর্তুকি দেওয়া হয় চার হাজার ৪০৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। আর সে বছর পিডিবির ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় ছিল পাঁচ হাজার ৪৯০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
পরের অর্থবছর বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় আরও বেড়ে হয় ছয় টাকা ২৮ পয়সা। এটি পিডিবির ইতিহাসে সর্বোচ্চ উৎপাদন ব্যয়। যদিও ওই অর্থবছরের মার্চে বিদ্যুতের গড় দাম বাড়িয়ে ছয় টাকা ১৫ পয়সা করা হয়। আর ২০১৩-১৪ অর্থবছর পিডিবির লোকসান ছয় হাজার ৮০৯ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। যদিও ওই অর্থবছর পিডিবিকে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছিল পাঁচ হাজার ৯৭২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। আর সে বছর পিডিবির ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় হয় চার হাজার ৭১৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
২০১৪-১৫ অর্থবছর বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় এক পয়সা কমে দাঁড়ায় ছয় টাকা ২৭ পয়সা। সে বছর বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়নি। এতে পিডিবির লোকসান বেড়ে দাঁড়ায় সাত হাজার ২৮২ কোটি ৯৯ টাকা। তবে ক্যাপাসিটি চার্জ কমে দাঁড়ায় চার হাজার ৬৬৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। আর ঘাটতি পূরণে ৯ হাজার ১৮৫ কোটি ২১ লাখ টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয় পিডিবিকে।
২০১৫-১৬ অর্থবছর বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় অনেকটা কমে দাঁড়ায় পাঁচ টাকা ৫৫ পয়সা। যদিও ওই বছরের সেপ্টেম্বরে বিদ্যুতের দাম উল্টো বাড়িয়ে করা হয় প্রতি ইউনিট গড়ে ছয় টাকা ৩৩ পয়সা। এতে পিডিবির লোকসান অনেকটা কমে যায়। সে অর্থবছর পিডিবি লোকসান করেছিল তিন হাজার ৮৭৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। সে অর্থবছর পিডিবিকে ভর্তুকিও কমিয়ে মাত্র দুই হাজার ৭৯৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা দেওয়া হয়। আর সে বছর পিডিবির ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় হয় পাঁচ হাজার ৩৭৬ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।
পরের অর্থবছর বিদ্যুৎ খাতে ক্যাপাসিটি চার্জ কিছুটা বেড়ে হয় পাঁচ হাজার ৭৬৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। ওই অর্থবছর বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয়ও কিছুটা বেড়ে হয় পাঁচ টাকা ৬১ পয়সা। তবে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ২০১৬-১৭ অর্থবছর বাড়ানো হয়নি। এতে পিডিবির লোকসান কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় চার হাজার ৪৩৪ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। আর এ ঘাটতি পূরণে পিডিবিকে ভর্তুকি দেওয়া হয় তিন হাজার ৯৯৪ কোটি এক লাখ টাকা।
এদিকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর বেসরকারি খাতে বেশকিছু বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন শুরু করে। এতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় প্রতি ইউনিটে গড়ে ছয় টাকা ২৫ পয়সা। এজন্য ওই অর্থবছরের ডিসেম্বরে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। এতে প্রতি ইউনিটের গড় দাম দাঁড়ায় ছয় টাকা ৭৭ পয়সা।
উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে দাম বেশি পড়লেও বিদ্যুৎ খাতে অন্যান্য ব্যয় ছিল নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এতে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পিডিবির লোকসান এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় আট হাজার ৩৫৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকায়। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় ছিল ছয় হাজার ২৪১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। তবে ওই অর্থবছর পিডিবিকে ভর্তুকি দেওয়া হয় চার হাজার ৫০৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকা।
২০১৮-১৯ অর্থবছর গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়নি। তবে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় কমে দাঁড়ায় পাঁচ টাকা ৯৫ পয়সা। এতে পিডিবির লোকসানও কিছুটা কমে দাঁড়ায় আট হাজার ১৪১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। তবে ওই বছর বেসরকারি খাতে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়। ফলে ২০১৮-১৯ অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ পিডিবির খরচ এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় আট হাজার ৭২২ কোটি ২৭ লাখ টাকা। আর ঘাটতি মেটাতে সে অর্থবছর পিডিবিকে ভর্তুকি দেওয়া হয় সাত হাজার ৯৬৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
একইভাবে গত অর্থবছরও বেসরকারি খাতে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এতে ২০১৯-২০ অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ পিডিবির খরচ বেড়ে ১০ হাজার ৮০২ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। তবে গত অর্থবছর পিডিবির গড় উৎপাদন ব্যয় কমে দাঁড়ায় পাঁচ টাকা ৮৫ পয়সা।
যদিও এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানির ফলে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির যুক্তিতে গত মার্চে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে বিদ্যুতের গড় দাম দাঁড়িয়েছে সাত টাকা ১৩ পয়সা। এর পরও ঘাটতি মেটাতে গত অর্থবছর পিডিবিকে ভর্তুকি দেওয়া হয় সাত হাজার ৪৩৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।
জানতে চাইলে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির অনুমোদন প্রদানকারী সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল বলেন, শুধু উৎপাদন ব্যয়ের ওপরই বিদ্যুতের দাম নির্ভর করে না। গত মার্চে দাম বাড়ানোর জন্য কমিশন যেসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েছিল তার মধ্যে রয়েছেÑআমদানিকৃত কয়লার ওপর পাঁচ শতাংশ হারে ভ্যাট ধার্য, ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ বৃদ্ধি, অবচয় ব্যয় বৃদ্ধি, তুলনামূলকভাবে কম মূল্যে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বেশি পরিমাণ বিদ্যুৎ কেনা, এক্সপোর্ট ক্রেডিট এজেন্সির অর্থায়নে যেসব নতুন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছিল, সেগুলোর সুদ পরিশোধ এবং প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দামের ওপর ১০ পয়সা হারে ডিমান্ড চার্জ আরোপ করা। এগুলোর সমন্বিত প্রভাব বিবেচনায় বিদ্যুতের দাম কিছুটা বৃদ্ধি অনুমোদন করা হয়। ঘাটতির বাকি অংশ সরকার ভর্তুকি দেবে, এ শর্ত কমিশনই দিয়েছিল।
যদিও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিকে অযৌক্তিক বলে মনে করছেন ভোক্তাদের সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম। তিনি শেয়ার বিজকে বলছেন, বিদ্যুৎ খাতে ‘অযৌক্তিক’ ব্যয় না কমিয়ে সরকার জনগণের ব্যয়ভার বাড়িয়ে দিয়েছে। বরাবরই গতানুগতিক ঐকিক নিয়মে বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস করার প্রতি নির্দেশনা থাকে না। এ খাতে ৯ হাজার কোটি টাকার ওপরে অযৌক্তিক ব্যয় সমন্বয় করা হলে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির দরকার হতো না। এছাড়া কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রয়োজন না থাকলেও বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ অর্থ দেওয়া হচ্ছে। এই কারণেই পিডিবির ঘাটতি বাড়ছে। আর এর দায়ভার চাপানো হচ্ছে জনগণের ওপর।
শামসুল আলম আরও বলেন, ‘২০১৭ সালে দাম বৃদ্ধির আগে কম ব্যয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিকল্পনা তুলে ধরেছিল ক্যাব। তা অনুসরণ করলে দাম না বাড়িয়ে উল্টো বিদ্যুতের দাম কমানো যেত। কিন্তু সরকার সে বিষয়গুলো গুরুত্ব না দিয়ে জনগণের কাঁধে দায়ভার চাপাচ্ছে।’