বিশেষ প্রতিনিধি: বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় গত অর্থবছর থেকে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। চলতি অর্থবছর তা রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। যদিও আগামী অর্থবছর তা কিছুটা কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ঘাটতি কমাতে এরই মধ্যে দুই দফা বাল্ক (পাইকারি) ও তিন দফা খুচরা পর্যায়ে বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। এরপরও ঘাটতি রয়ে গেছে গড় উৎপাদন ব্যয় ও বিদ্যুতের দামের মধ্যে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিদ্যুৎ ও গ্যাসে ভর্তুকি তুলে দেয়া হবে। সেটি করতে হলে বিদ্যুতের দাম আরও ৬৫ শতাংশ বাড়াতে হবে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) এক বিশ্লেষণে এ তথ্য উঠে এসেছে।
সম্প্রতি এ বিশ্লেষণটি বিদ্যুৎ বিভাগে উপস্থাপন করা হয়। এতে দেখা যায়, গত অর্থবছর বাল্ক পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ও দামের মধ্যে পার্থক্য ছিল চার টাকা ৩৫ পয়সা। দুই দফা বাড়ানোর পরও চলতি অর্থবছর ঘাটতি দাঁড়াবে গড়ে চার টাকা ৯৪ পয়সা। আর গ্রাহক পর্যায়ে ২০২১-২২ অর্থবছর ঘাটতি ছিল চার টাকা ৬৫ পয়সা। তিন দফা দাম বাড়ানোর পরও চলতি অর্থবছর ঘাটতি দাঁড়িয়েছে পাঁচ টাকা ৯২ পয়সা।
পিডিবির তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছর বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল আট টাকা ৫৪ পয়সা। তিন শতাংশ ট্রান্সমিশন লস বিবেচনায় এ বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যয় পড়ে ইউনিটপ্রতি ৮ টাকা ৯৬ পয়সা। এর সঙ্গে প্রতি ইউনিটে যোগ হবে ১৫ পয়সা বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিলের খরচ। আর ছয় শতাংশ উৎসে আয়কর কর্তনের পর প্রতি ইউনিট বাল্ক বিদ্যুতের সরবরাহ মূল্য দাঁড়ায় ৯ টাকা ৪৪ পয়সা। যদিও ওই সময় বাল্ক মূল্যহার ছিল পাঁচ টাকা ০৯ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি ইউনিটে পিডিবির ঘাটতি তথা লোকসান ছিল চার টাকা ৩৫ পয়সা।
চলতি অর্থবছর বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে (প্রক্ষেপিত) ১০ টাকা ৫৭ পয়সা। তিন শতাংশ ট্রান্সমিশন লস বিবেচনায় এ বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যয় পড়ে ইউনিটপ্রতি ১০ টাকা ৯০ পয়সা। এর সঙ্গে প্রতি ইউনিটে যোগ হবে ১৫ পয়সা বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিলের খরচ। আর ছয় শতাংশ উৎসে আয়কর কর্তনের পর প্রতি ইউনিট বাল্ক বিদ্যুতের সরবরাহ মূল্য চলতি অর্থবছর দাঁড়াবে ১১ টাকা ৬৪ পয়সা। দুই দফা বৃদ্ধির পর বর্তমানে বিদ্যুতের বাল্ক মূল্যহার দাঁড়িয়েছে ছয় টাকা ৭০ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি ইউনিটে পিডিবির ঘাটতি দাঁড়াবে চার টাকা ৯৪ পয়সা।
এদিকে আগামী অর্থবছর বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় কিছুটা কমে দাঁড়াবে (প্রাক্কলিত) ১০ টাকা ০৯ পয়সা। তিন শতাংশ ট্রান্সমিশন লস বিবেচনায় এ বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যয় পড়ে ইউনিটপ্রতি ১০ টাকা ৪০ পয়সা। এর সঙ্গে প্রতি ইউনিটে যোগ হবে ১৫ পয়সা বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিলের খরচ। আর ছয় শতাংশ উৎসে আয়কর কর্তনের পর প্রতি ইউনিট বাল্ক বিদ্যুতের সরবরাহ মূল্য আগামী অর্থবছর দাঁড়াবে ১১ টাকা ১২ পয়সা। বর্তমান বাল্ক মূল্যহার (ছয় টাকা ৭০ পয়সা) বিবেচনায় প্রতি ইউনিটে পিডিবির ঘাটতি দাঁড়াবে চার টাকা ৪২ পয়সা।
অন্যদিকে গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের বাল্ক মূল্যের সঙ্গে যোগ হবে হুইলিং চার্জ ২৯ পয়সা। এছাড়া সাত দশমিক ৯৫ শতাংশ সিস্টেম লস ও এক টাকা ২১ পয়সা বিতরণ চার্জ যোগ হবে। এতে গত অর্থবছর গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের সরবরাহ মূল্য দাঁড়ায় ১১ টাকা ৭৮ পয়সা। তবে ওই সময় গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের গড় মূল্যহার ছিল সাত টাকা ১৩ পয়সা। এতে বিতরণকারী কোম্পানিগুলো প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রি করে লোকসান গুনে চার টাকা ৬৫ পয়সা।
চলতি অর্থবছর গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের সরবরাহ মূল্য দাঁড়িয়েছে ১৪ টাকা ১৭ পয়সা। তবে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম তিন দফা বৃদ্ধির পর বর্তমানে গড় মূল্যহার দাঁড়িয়েছে আট টাকা ২৫ পয়সা। এতে বিতরণকারী কোম্পানিগুলো প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রিতে লোকসান গুনছে পাঁচ টাকা ৯২ পয়সা। একইভাবে আগামী অর্থবছর গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের সরবরাহ মূল্য কিছুটা কমে দাঁড়াবে ১৩ টাকা ৬১ পয়সা। তবে বর্তমান গড় মূল্যহার বিবেচনায় বিতরণকারী কোম্পানিগুলো প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রিতে লোকসান গুনবে পাঁচ টাকা ৩৬ পয়সা।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি এক বৈঠকে বারবার দাম বৃদ্ধির পরও লোকসান না কমার বিষয়ে জানতে চায় বিদ্যুৎ বিভাগ। এ সময় বৈঠকে উপস্থিত পিডিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেন, সরকার বাল্ক মূল্যহার বাড়ালেও উৎপাদন ব্যয় তার চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে। এর ফলে বাল্ক বা গ্রাহক উভয় পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ালেও ঘাটতি কমানো যাচ্ছে না। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও কয়লার দাম কমায় আগামী অর্থবছর উৎপাদন কিছুটা কমবে। এতে ঘাটতিও কিছুটা কমবে।
তারা আরও জানান, ঘাটতি কমাতে হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ও দাম সমান সমান করতে হবে। এতে অর্থবছর বাল্ক বিদ্যুতের সরবরাহ মূল্য দাঁড়াবে ১১ টাকা ১২ পয়সা, বর্তমানে যা ছয় টাকা ৭০ পয়সা। আর ভর্তুকি পুরোপুরি তুলে দিলে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বেড়ে দাঁড়াবে ১৩ টাকা ৬১ পয়সা, বর্তমানে যা আট টাকা ২৫ পয়সা। অর্থাৎ বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্য না বাড়লে গড়ে ৬৫ শতাংশ দাম বৃদ্ধির পর বিদ্যুতে সরকারের আর কোনো ভর্তুকি দিতে হবে না।
উল্লেখ্য, গত ১৮ মে এক অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, এখন থেকে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে নিয়মিত সমন্বয় করা হবে। সরকার এই দুই খাতে যে ভর্তুকি দেয়, সেটা আগামীতে দেয়া হবে না। এজন্য নীতিমালা প্রণয়নের কাজ চলছে। সে অনুযায়ী নিয়মিত দাম সমন্বয় করা হবে।