Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 5:33 pm

ভর্তুকি প্রয়োজন ৩৬,১২০ কোটি ছাড় মাত্র ৪,৩৫৯ কোটি টাকা

ইসমাইল আলী: আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি ও ডলারের উচ্চ বিনিময় হারে দুই অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উচ্চ ক্যাপাসিটি চার্জ। এতে বিদ্যুতের বাল্ক (পাইকারি) মূল্যহার বাড়িয়েও লোকসান কমানো যায়নি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি)। ফলে বিদ্যুৎ খাতে উচ্চহারে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। তবে এ ভর্তুকি নিয়মিত ছাড় করছে না অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে বড় ধরনের তহবিল সংকটে পড়েছে পিডিবি।

ভর্তুকি ছাড় চেয়ে সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি দিয়েছে পিডিবি। পরে তা বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে যায় অর্থ মন্ত্রণালয়ে। এতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছর জুন পর্যন্ত ভর্তুকি ছাড় করা হয়েছে ২৬ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা ২০২১-২২ অর্থবছরের বকেয়া ভর্তুকি। চলতি অর্থবছরের জন্য ছাড় হয়েছে মাত্র চার হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা। যদিও চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে ভর্তুকি দরকার ৩৬ হাজার ১২০ কোটি টাকা।

চিঠিতে বলা হয়েছে, ভর্তুকি ছাড় না হওয়ায় চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল বকেয়া পড়েছে ৩৩ হাজার ১০৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রে আগস্ট থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বিল বকেয়া পড়েছে ছয় হাজার ৫২১ কোটি এবং বেসরকারি (আইপিপি ও রেন্টাল) কেন্দ্রগুলোর বিল বকেয়া ২৫ হাজার ৭০ কোটি টাকা।

বেসরকারি ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় বকেয়া ১২ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা, গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রে বকেয়া চার হাজার ৪৭৪ কোটি টাকা, কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রে বকেয়া সাত হাজার ৬২১ কোটি টাকা এবং সৌর বিদ্যুতের বিল বকেয়া ৪৯২ কোটি টাকা। আর সরকারি ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় বকেয়া দুই হাজার ১৭ কোটি টাকা, গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রে বকেয়া চার হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা এবং সৌর বিদ্যুতের বিল বকেয়া সাত কোটি টাকা। এছাড়া পিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া গ্যাস বিল রয়েছে আরও এক হাজার ৫১৫ কোটি টাকা।

উপরোল্লিখিত বিলের মধ্যে পেট্রোবাংলার বিভিন্ন গ্যাস কোম্পানির পাওনা রয়েছে। এর মধ্যে তিতাস গ্যাসের পাওনা এক হাজার ২০৩ কোটি টাকা, বাখরাবাদ গ্যাসের ৮২৮ কোটি টাকা, কর্ণফুলী গ্যাসের ২০৬ কোটি টাকা, জালালাবাদ গ্যাসের এক হাজার ২৫৪ কোটি টাকা, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাসের ৩৬৯ কোটি এবং সুন্দরবন গ্যাসের ৩১৩ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গ্যাস কোম্পানিগুলোর পাওনা চার হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা। এছাড়া কয়লার বিল বকেয়া রয়েছে পাঁচ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা এবং তরল জ্বালানির (ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল) বকেয়া আট হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ জ্বালানির বিপরীতে বকেয়া রয়েছে ১৮ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা।

এদিকে চলতি অর্থবছর জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ভর্তুকির পরিমাণ প্রাক্কলন করা হয়েছে। এর মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চাহিদা দেয়া হয়েছে জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের এবং জানুয়ারি-মার্চের চাহিদা পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। তবে এপ্রিলের ভর্তুকির চাহিদা পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করা হয়নি। এক্ষেত্রে জুলাইয়ের জন্য ভর্তুকি চাওয়া হয়েছে চার হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা, আগস্টের চার হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা, সেপ্টেম্বরের চার হাজার ৪৮০ কোটি টাকা, অক্টোবরের তিন হাজার ৮৬২ কোটি, নভেম্বরের তিন হাজার ৩৭৯ কোটি এবং ডিসেম্বরের তিন হাজার সাত কোটি টাকা।

এর বাইরে জানুয়ারির জন্য ভর্তুকি লাগবে দুই হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা, ফেব্রুয়ারির দুই হাজার

৮৪৮ কোটি, মার্চের তিন হাজার ৩৭ কোটি এবং এপ্রিলের তিন হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা। ১০ মাসের মধ্যে শুধু জুলাইয়ের চার হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে। ওই মাসের এখনও ৪২৮ কোটি টাকা ভর্তুকি পাওনা রয়েছে। আর আগস্ট থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৯ মাসের পুরো ভর্তুকিই পাওনা রয়েছে।

পিডিবির তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রাপ্য ভর্তুকির পরিমাণ ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। যদিও চলতি অর্থবছরের (সংশোধিত) বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাবদ ২৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আর ছাড় করা হয়েছে ২৬ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। তবে এর মধ্যে ২২ হাজার ১৫১ কোটি টাকা ভর্তুকি গত অর্থবছরের ছিল। আর ভর্তুকি ঠিকমতো না পাওয়ায় জ্বালানি সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

চলতি অর্থবছর জুন নাগাদ ভর্তুকি চাহিদা ৩৯ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাই চলতি অর্থবছরের জন্য বরাদ্দকৃত ভর্তুকির বাকিটা আগামী বছরের জুলাই থেকে দ্রুত ছাড় করতে অনুরোধ করা হয়েছে চিঠিতে। সূত্রমতে, আগামী অর্থবছর ভর্তুকি বাবদ ৩৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আগামী অর্থবছর জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা করে ছাড়ের অনুরোধ করা হয়েছে। তাহলেই কেবল লোডশেডিং মুক্ত থাকা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিডিবির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, প্রতি বছরই ভর্তুকির কিছু অংশ বকেয়া থেকে যায়। কয়েক বছর আগের পরিমাণ হাজার কোটি টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তবে গত দুই অর্থবছর ধরে বকেয়ার পরিমাণ বাড়ছে। এতে চাহিদামতো ভর্তুকি না পাওয়ায় ঘাটতি বাড়ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ পিডিবিকে ভর্তুকি দেয়া হয় সাত হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সাত হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে আট হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১১ হাজার ৯৬৩ কোটি এবং চলতি অর্থবছর ২৭ হাজার কোটি টাকা। যদিও প্রতি বছরই চাহিদা ছিল আরও বেশি।