বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত নিয়ে গত সপ্তাহে বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে বৈঠক করেছে সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদল। এ সময় তারা বিদ্যুৎ খাতের বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশকিছু প্রশ্ন করে। সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে শেয়ার বিজ। তা নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্ব
ইসমাইল আলী: ২০০৯ সাল থেকে নিয়মিত বড় অঙ্কের লোকসান গুনতে শুরু করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। লোকসানের ঘাটতি পূরণে সে সময় পিডিবিকে ঋণ দিত অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে ভর্তুকি হিসাবে সরাসরি অনুদান দেয়া শুরু হয়। এতে গত অর্থবছর পর্যন্ত ভর্তুকি দেয়া হয়েছে ৫৭ হাজার ৭৯৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। তবে বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি নিয়ে আপত্তি তুলেছে আইএমএফ। যদিও এ মুহূর্তে ভর্তুকি বন্ধ করলে দেনায় ডুববে পিডিবি।
সংস্থাটির এশীয় ও প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধিদল গত ২ নভেম্বর বিদ্যুৎ বিভাগ ও পিডিবির সঙ্গে বৈঠকে করে। এ সময় বিদ্যুৎ খাতে বিশেষত পিডিবিকে দেয়া ভর্তুকির বিষয়ে আপত্তি জানায় আইএমএফ। বিদ্যুতে ভর্তুকি বন্ধে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া যায় কিনাÑপিডিবির কাছে জানতে চায় আইএমএফ। তবে সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠান হিসেবে এ ধরনের ঋণ নেয়ার সুযোগ নেই বলে জানায় পিডিবি।
আইএমএফ প্রতিনিধিদল জানতে চায়, ‘সরকারের কাছ থেকে পিডিবি যে ভর্তুকি নেয়, তার পরিবর্তে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে, সেটি বেশি সুবিধাজনক হয় কিনা’Ñএ প্রশ্নের উত্তরে পিডিবির চেয়ারম্যান বলেন, ‘এটি ভায়াবল (উপযুক্ত) নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিদ্যুৎ পাওয়াটা মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। এ অধিকার পূরণের জন্য সরকার কিছু দায় নেয় এবং ভর্তুকি দিয়ে থাকে। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে ঋণের অর্থ সুদসহ পরিশোধ করতে হবে। তবে পিডিবির বর্তমান আয়ের দ্বারা তা সম্ভব নয়। আর সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নিলে তা পরিশোধ করতে হয় না। এটি পিডিবির জন্য সুবিধাজনক।’
আইএমএফ প্রতিনিধিদল জানতে চায়, সরকার ভর্তুকি বন্ধ করে দিলে পিডিবি কী করবে? এর জবাবে পিডিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়, তখন পিডিবি সরকারের নীতি মেনেই কাজ করবে।
আইএমএফের প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির সর্বশেষ (২০২১-২২ অর্থবছর) আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দায়দেনায় এরই মধ্যে ডুবে আছে পিডিবি। বর্তমানে সংস্থাটির ঋণের পরিমাণ ইক্যুইটির তুলনায় প্রায় ১৪ গুণ। যদিও এ অনুপাতটির আদর্শ মান দুই থেকে আড়াই। অর্থাৎ কোনো সংস্থার ঋণ তার ইক্যুইটির দুই থেকে আড়াইগুণ হলে, তা গ্রহণযোগ্য। এক্ষেত্রে খুবই বাজে অবস্থায় আছে পিডিবি।
এদিকে সরকারের কাছে বাজেট সহায়তা বাবদ পিডিবির ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ১৬০ কোটি ১২ লাখ টাকা। মূলত লোকসানের ঘাটতি পূরণে ২০০৯ সাল থেকে তিন শতাংশ সুদে ঋণ দিত অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে কখনোই সে ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি সংস্থাটি। এতে ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলে পিডিবির। আর সে ঋণের সুদ বাবদ বকেয়া জমা পড়েছে ১০ হাজার ৮৪৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা। অর্থাৎ সরকারের কাছে পিডিবির বাজেট সহায়তা বাবদ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সুদসহ ৫৪ হাজার আট কোটি টাকা।
এর বাইরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য সরকারের কাছে পিডিবির ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে আট হাজার ৬১৬ কোটি চার লাখ টাকা। আর বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১২ হাজার ৩৭৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এছাড়া বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন তহবিল থেকে ঋণ নিয়েও কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে পিডিবি। সে বাবদ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৯৬২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।
এদিকে পিডিবির পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬১ হাজার ৮০৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। গত অর্থবছর সংস্থাটির লোকসানের পরিমাণ ছিল ৩১ হাজার আট কোটি ৩২ লাখ টাকা। লোকসানের ঘাটতি পূরণে গত অর্থবছর অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে ভর্তুকি চাওয়া হয় ২৯ হাজার ৬৫৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। তবে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে ছাড় করে ১৪ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা। এখনও ১৪ হাজার ৭৬৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ভর্তুকি বকেয়া রয়েছে। ভর্তুকির অর্থ ছাড় না করায় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিল পরিশোধ করতে পারছে না পিডিবি।
জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণের সুদহার বেশি। আর ওই ঋণ ও তার সুদ সময়মতো পরিশোধ না করলে ঋণখেলাপি হতে হবে। তবে ভর্তুকি দিলে তা পরিশোধ করতে হবে না। এছাড়া আগামীতে পিডিবির লোকসান ও ভর্তুকি চাহিদা অনেক বাড়বে। এ অবস্থায় ব্যাংক ঋণ নিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব হবে না।
প্রসঙ্গত, চলতি অর্থবছর পিডিবির সম্ভাব্য লোকসান প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫১ হাজার ৮৫৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা। আর আগামী অর্থবছর তা আরও বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৬১ হাজার ৬৭২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। অর্থাৎ দুই বছরে সংস্থাটির লোকসান দাঁড়াবে প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা। ভর্তুকি ছাড়া ঋণ দিয়ে এ ঘাটতি পূরণ করতে গেলে পিডিবিকে দেউলিয়া হতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আইএমএফ ব্যাংক ঋণ নিয়ে ভর্তুকির চাহিদা পূরণ করতে বলেছে। অন্যথায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে লোকসান কমানোর কথা বলেছে। তবে লোকসানের ঘাটতি পূরণ করতে গেলে বিদ্যুতের দাম দ্বিগুণ করতে হবে, যা এতটা সহজ নয়। গত জানুয়ারিতে বিদ্যুতের দাম ৬৯ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করলেও তা খারিজ হয়ে গেছে। এছাড়া আগামী বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তার আগে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না সরকার। এ অবস্থায় ভর্তুকি বন্ধ করলে দায়দেনায় ডুবে যাবে পিডিবি।