ভাঙন ঝুঁকিতে শতকোটি টাকায় নির্মিত চাঁদপুর শহর রক্ষাবাঁধ

বেলায়েত সুমন, চাঁদপুর: চাঁদপুরে মেঘনা নদীতে অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের প্রতিযোগিতা বেড়েই চলছে। এতে ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে শতকোটি টাকার নির্মিত শহর রক্ষাবাঁধ। সরকারিভাবে উত্তোলন বন্ধ থাকার পরও নদী ড্রেজিংয়ের নামে প্রভাবশালী মহলের (থার্ডপার্টি) বালি উত্তোলন বাণিজ্য অব্যাহত রয়েছে। ফলে একদিকে যেমন রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার, অন্যদিকে হুমকিতে ইলিশ প্রজননক্ষেত্র। সচেতন মহলের দাবি, এখনই বালি উত্তোলন বন্ধের। 

জানা যায়, চাঁদপুরের শহর রক্ষাবাঁধ ঘেঁষে দেশের ৯০ শতাংশ নদ-নদীর পানি বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হয়। ফলে বর্ষাকালে পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্থল বড়স্টেশন মোলহডের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের নদীর মোহনা উত্তাল হয়ে ওঠে। দেখা দেয় তীব্র ঘূর্ণি স্রোত। এ সময় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ অভিমুখে পণ্যবাহী জাহাজগুলোকে ঘূর্ণি স্রোতের এ স্থানটি অতিক্রম করতে বেশ বেগ পেতে হয়।

কিন্তু প্রভাবশালীদের অবৈধ বালি উত্তোলনের কারণে পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্থলে তীব্র ঘূর্ণি স্রোতের সৃষ্টি হয়। ফলে শহরের নতুন বাজার অংশের বড়স্টেশন মোলহেড ও পুরোনো বাজার হরিসভা এলাকা চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। গত কয়েক বছর ঘূর্ণি স্রোত বারবার আঘাত হানছে এসব এলাকায়। ফলে নদীর তীর রক্ষাবাঁধের পাথর ও আরসিসি ব্লক তলিয়ে যাচ্ছে।

পাউবো এসব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে সাময়িকভাবে জরুরি ভিত্তিতে রিজার্ভে থাকা সিসি ব্লক, জিও টেক্সটাইল ব্যাগ ভর্তি বালি ফেলে সাময়িকভাবে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা স্রোতের তোড়েই নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। যার কারণে ভয়াবহ হুমকির মুখে রয়েছে শহরের নতুন ও পুরোনো বাজার বাঁধ এলাকাসহ বহু মূল্যবান স্থাপনা।

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে শহরের নতুন বাজার অংশে বড়স্টেশন মাদরাসা রোড থেকে মোলহেডের পুরোনো লঞ্চঘাট পর্যন্ত চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রতিদিন এ এলাকার ব্লক বাঁধ ও পাথর নদীর তলদেশে তিন নদীর ঘূর্ণি স্রোতে তলিয়ে যাচ্ছে। একই অবস্থা পুরোনো বাজারের ব্যবসায়িক এলাকার দক্ষিণ মাথায় ডাকাতিয়ার মুখ থেকে হরিসভা এলাকা পর্যন্ত।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, শহরের দুই অংশের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত ডাকাতিয়া, পশ্চিম অংশে মেঘনা ও পদ্মার মিলনস্থল বড়স্টেশন মোলহেড এবং পুরোনো বাজার এলাকার বিভিন্ন স্থান দিয়ে নদীর স্রোতে ব্লক বাঁধ দেবে গিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তবে এসব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় মাঝে মধ্যে জিও ব্যাগ ভর্তি বালির বস্তা ফেলা হচ্ছে। শহর রক্ষাবাঁধের পুরোনো বাজার এলাকায় আবারও নতুন করে ভাঙন শুরু হয়েছে। নতুন ভাঙনে ২৫ মিটার এলাকা নদীতে বিলীন হয়েছে। বর্তমানে প্রায় ১০০ মিটার এলাকা ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে। মেঘনার ভাঙনে শহরের প্রাচীন রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট, মাছঘাট, প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী এলাকা পুরোনো বাজারের বেশ কিছু এলাকা হারিয়ে গেছে বহু আগে।

জানা যায়, ২০২০ সালে পাউবো থেকে সরেজমিন স্টাডি করে ৪২১ কোটি টাকার স্থায়ী একটি প্রকল্প তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়। আজও আলোর মুখ দেখেনি প্রকল্পটি। এরই মধ্যে চাঁদপুর শহরের দুই অংশের নদী পার আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রতি বছর ঝুঁকিপূর্ণ সময় জানুয়ারি থেকে মার্চ। এ অবস্থার কারণ ও করণীয় নিয়ে গবেষণা করে নদী ভাঙন প্রতিরোধ জরিপকারী বিশেষজ্ঞ দল। তারা চাঁদপুর শহর রক্ষায় নতুন করে ৩ হাজার কোটি টাকার আরেকটি দীর্ঘস্থায়ী প্রকল্প জমা দেন।  সে প্রকল্পটিও আলোর মুখ দেখেনি।

চাঁদপুর  বড়স্টেশন মোলহেডসহ বাঁধ রক্ষায় ১৯৭২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নতুন বাজার এলাকায় চাঁদপুর শহর সংরক্ষণ প্রকল্পের (উন্নয়ন) আওতায় ১৪০ কোটি ৩০ লাখ  টাকা ব্যয়ে ১ হাজার ৭৩০ মিটার তীর সংরক্ষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ২৪ কোটি ৯০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে বলে পাউবো সূত্রে জানা গেছে।

২০১৯ সালে চাঁদপুর সদর ও হাইমচর উপজেলার মেঘনা নদী থেকে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন বন্ধে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। সে সঙ্গে কেন তা অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং এ অবৈধ কাজের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী, ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হবে নাÑসেই মর্মে রুল জারি করেন আদালত।

এদিকে গত শনিবার চাঁদপুর জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপ্রধান ছিলেন চাঁদপুরের ডিসি অঞ্জনা খান মজলিশ। সভায় মেঘনায় অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের বিষয়টি ওঠে আসে।

এ বিষয়ে সভায় ডিসি অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, একদিকে ৪ হাজার কোটি টাকার শহর রক্ষাবাঁধ, অন্যদিকে মেঘনায় যত্রতত্র অবৈধ বালি উত্তোলন। এ দুটি একত্র হতে পারে না। তিনি বলেন, ২০১৪ থেকে ২০২২ পর্যন্ত মেঘনার বালি উত্তোলনে সরকারের ১ টাকাও লাভ হয়নি বরং ডুবোচর খননের নামে শতাধিক ড্রেজারের মাধ্যমে এলোমেলোভাবে উত্তোলনের কারণে মেঘনার দুই পাড়ে ভাঙনের প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে।

তিনি বলেন, ইতোমধ্যে মৎস্য বিজ্ঞানীরা বলেছেন, নির্বিচারে বালি উত্তোলনের ফলে ইলিশের ডিম এবং তাদের বিচরণ ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ অপরিকল্পিত উত্তোলন বন্ধ এবং নদী ও ইলিশ রক্ষায় যা যা করণীয়, তা প্রশাসন করবে। তিনি জানান, চাঁদপুরকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণে ৪ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনেক দূর এগিয়ে আছে।

বিআইডব্লিউটিএর উপপরিচালক কায়সারুল ইসলাম বলেন, ‘২০১০ সালের পর থেকে বালি উত্তোলনের অনুমতি নেই। যারা উত্তোলন করবে তারা জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করবে। এখানে সেটি হয়নি। এদিকে গত রোববার রাতে মেঘনা নদীর মোহনপুর এলাকা থেকে ১২টি বালিবাহী বাল্কহেড আটক করেছে নৌ-পুলিশ।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০