ভাঙারি হিসেবে বিক্রি হলো বিআরটিসির ভলভো বাস

ইসমাইল আলী: রাজধানীর পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে ২০০৪ সালে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) জন্য কেনা হয় ৫০টি দ্বিতল ভলভো বাস। সুইডিশ সরকারের অর্ধেক অনুদান ও অর্ধেক ঋণে বাসগুলো কেনায় ব্যয় হয় প্রায় ৫২ কোটি টাকা। ১৫ বছর আয়ুষ্কাল ধরা হলেও চার বছর পর থেকেই বিকল হতে শুরু করে বিআরটিসির সবচেয়ে দামি এ বাসগুলো। পরের তিন বছরের মধ্যে ৪৯টি বাসই বিকল হয়ে পড়ে।

বিকল ভলভো বাসগুলো মেরামতে ১২ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সরকার। তবু সচল করা যায়নি অনিয়ম-অবহেলার শিকার এ বাসগুলো। অবশেষে ভাঙারি হিসেবে বিক্রি করা হলো বিআরটিসির সবচেয়ে ব্যয়বহুল বাসগুলো। ৫২ কোটি টাকা কেনায় বাসগুলো সম্প্রতি বিক্রি করা হয়েছে ৫০ লাখ টাকারও কম দামে।

জানতে চাইলে বিআরটিসির চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, বাসগুলো বিআরটিসির বোঝা হয়ে উঠেছিল। তাই উম্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে এগুলো বিক্রি করা হয়। আর পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তক্রমে প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়। ফলে দাম কম না বেশি তা নিয়ে মন্তব্য করা সম্ভব নয়।

সূত্র জানায়, ২০০৪ সালে ১ কোটি ৩ লাখ টাকা দরে ৫০টি দ্বিতল বাস কেনায় ব্যয় করা হয় ৫১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সে সময় বাসগুলো মেরামতে বিভিন্ন সরঞ্জাম আনা হয়েছিল ৯ কোটি ৫০ লাখ টাকার। তবে চার বছরের মাথায় ১৭টি বাস অচল হয়ে পড়ে। আর ২০০৯ সালে অকেজো বাসের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪-এ। পরের দেড় বছরের ব্যবধানে বাকি ২৫টি বাস অকেজো হয়ে পড়ে।

বিক্রির আগে বিআরটিসির মিরপুর ডিপোতে ২৭টি ও কল্যাণপুর ডিপোতে ২২টি ভলভো বাস পড়েছিল। বর্তমানে শুধু একটি বাস সচল রয়েছে, যা সুপ্রিম কোর্টের স্টাফ পরিবহনে ইজারা দেয়া আছে।

বিআরটিসির তথ্যমতে, শুরু থেকে ভলভো বাসের যন্ত্রাংশ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সুইডিশ মোটরস থেকে নেয়া হতো। তবে বিগত জোট সরকারের আমল থেকে বাকিতে যন্ত্রাংশ কেনার কারণে প্রতিষ্ঠানটির কাছে প্রায় ৭০ লাখ টাকা বকেয়া পড়ে। জোট সরকার ওই টাকা পরিশোধ না করায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সুইডিশ মোটরস যন্ত্রাংশ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।

এদিকে ২০১০ সালে ৮টি ভলভো মেরামতে প্রায় ২ কোটি টাকা দেয়া হয়। তবে নি¤œমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহারে এগুলো দ্রুতই অকেজো হয়ে যায়। একদিনও বাসগুলো চালানো সম্ভব হয়নি। এরপর ২০১১ সালে ১৫ কোটি টাকায় বাসগুলো মেরামতের প্রস্তাব দেয় ভলভো কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে সহজ শর্তে সুইডিশ সরকারের ঋণ বা অনুদান সংগ্রহ করে দেয়ার প্রস্তাবও দেয়া হয়। তবে বিআরটিসির অনাগ্রহে তা কার্যকর হয়নি। এর পরিবর্তে নতুন বাস কেনার প্রকল্প নেয় বিআরটিসি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৫ সালে পুনরায় ভলভো বাস মেরামতের উদ্যোগ নেয় বিআরটিসি কর্তৃপক্ষ। এজন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) বাস মেরামতে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এক্ষেত্রে মেরামতকারী প্রতিষ্ঠানকে বাসগুলো ৫ বছর পরিচালনার সুযোগ রাখা হয়। তবে দুই দফা দরপত্রেও কোনো প্রতিষ্ঠান আগ্রহ দেখায়নি।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে সরকারি অর্থে বাসগুলো মেরামতে অনুমোদন চায় বিআরটিসি। এক্ষেত্রে ব্যয় ধরা হয় ৩৩ কোটি টাকা। প্রকল্পটির উন্নয়ন প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে পাঠানো হয়েছিল। তবে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন না পাওয়ায় প্রকল্পটি আর আলোর মুখ দেখেনি।

যদিও বাসগুলোর মেরামতের মান নিয়ে সন্দিহান ভলভোর দেশীয় এজেন্ট সুইডিশ মোটরস বাংলাদেশ লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ২০১০ সালে ৮টি বাস মেরামত করা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো ডিপো থেকে কাউন্টার পর্যন্ত আসতেই বিকল হয়ে পড়ে। অভিযোগ রয়েছে, পুরান ঢাকার নবাবপুর থেকে বাসগুলোর খুচরা যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করা হয়েছিল। ফলে পুনরায় মেরামত করে বাসগুলো থেকে কী ধরনের সেবা পাওয়া যেত তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু ভলভো নয়, এ পর্যন্ত বিআরটিসির জন্য যত বাস কেনা হয়েছেÑসেগুলোর কোনোটিরই যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। ফলে প্রত্যাশিত সেবাও পাওয়া যায়নি। তবে রক্ষণাবেক্ষণের চেয়ে নতুন বাস কেনায় আগ্রহ বেশি কর্তৃপক্ষের। কারণ নতুন কিনলে লাভ বেশি, রক্ষণাবেক্ষণে তো সেটি নেই।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সামছুল হক বলেন, ‘ভলভো বাসগুলোর মেইনটেন্যান্স সেভাবে হতো না। একটা বাসের পার্টস (যন্ত্রাংশ) নষ্ট হলে তা আরেকটা থেকে খুলে নিয়ে লাগানো হতো। এসব করতে করতে কিছু বাস এমনিতেই অকেজো হয়ে গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিআরটিসিতে জবাবদিহিতার কোনো ব্যবস্থা নেই। পাশাপাশি বিআরটিসি বেসরকারি খাতের মতো বাস লিজ দেয়। তবে মেইনটেন্যান্সটা নিজের ঘাড়ে রাখে। আর যারা লিজ নেন তারা আসেন টাকা কামাতে। তাই যেভাবে দরদ দিয়ে গাড়ি চালানো দরকার তারা তেমনটি করেন না। বরং বিআরটিসির গাড়ির অপব্যবহার করে তারা ধনী হন। ফলে শুধু ভলভো নয়, কোনো বাসই টেকসই হয়নি।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০