চঞ্চল রহমান : রুদ্ধশ্বাস ছড়ানো এক লড়াই। বলে বলে উত্তেজনার খই ফুটল। শেষ পর্যন্ত ডাকওয়ার্থ লুইস পদ্ধতিতে গড়ানো ম্যাচে আকবর আলীর বীরত্বে রচিত হলো নতুন এক বিজয়গাথা। বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন। স্বপ্ন নয়, বাস্তব। ইতিহাস গড়ল যুবারা। ভারতকে ৩ উইকেটে হারিয়ে যুব বিশ্বকাপ শিরোপা এখন বাংলাদেশের।
পচেফস্ট্রুমে গতকাল টস হেরে আগে বল হাতে ৪৭.২ ওভারে ভারতকে মাত্র ১৭৭ রানে গুটিয়ে দেয় বাংলাদেশ। পরে রুদ্ধশ্বাস ছড়ানো ম্যাচে অধিনায়ক আকবর আলীর বীরত্বে ২৩ বল আর ৩ উইকেট হাতে রেখে জয় নিশ্চিত করে বাংলাদেশ। এর সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজয়ের আনন্দে মাতে জুনিয়র টাইগাররা। আকবর অপরাজিত ছিলেন ৪৩ রানে।
ভারতের বিপক্ষে ফাইনালে মানেই হার। গত বছর যুব এশিয়া কাপের ফাইনাল ও ইংল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে প্রতিপক্ষ দলটির কাছে এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখে পড়েছিল টাইগার যুবারা। গতকাল তাই মনে মনে একটা প্রতিশোধের নেশা জেগেছিল আকবর আলীদের। শেষ পর্যন্ত রোমাঞ্চ ছড়ানো ম্যাচ ডাকওয়ার্থ পদ্ধতিতে জিতে বাঁধভাঙা আনন্দে মাতে লাল-সবুজ প্রতিনিধিরা।
রান তাড়ায় গতকাল বাংলাদেশকে ভালো শুরু এনে দিয়েছিলেন পারভেজ হোসেন ইমন ও তানজিদ হাসান তামিম। ভারতীয় দুই পেসার কার্তিক তিয়াগি ও সুশান্ত মিশ্রর আগুনে গোলা ভালোভাবে সামাল দিচ্ছিলেন দুই ওপেনার। ৮.৫ ওভারে ৫০ রানও তারা যোগ করেছিলেন স্কোর বোর্ড। ঠিক সে সময়ই রবি বিষ্ণু লেগ স্পিনে ছক্কা হাঁকানোর চেষ্টায় কার্তিক ত্যাগির হাতে ধরা পড়ে ফেরেন তামিম। তার আগে তিনি করেন ২ চার ও ১ ছয়ে ১৭ রান। তার ফেরার পরই যেন মুহূর্তের মধ্যে এলোমেলো হয়ে যায় লাল-সবুজদের ব্যাটিং লাইনআপ। এজন্য দায়ী বলা যায় রবি বিষ্ণু। তার স্পিন বিষেই ৬২ রান থেকে ৬২ রানে পৌঁছাতে জুনিয়র টাইগাররা হারিয়ে ফেলে ৪ উইকেট। এদিকে আবার হ্যামিস্ট্রিংয়ের চোটে পড়ে মাঠ ছাড়েন পারভেজ হোসেন ইমন। যে কারণে বেশ চাপে পড়ে বাংলাদেশের যুবারা। তখন অবশ্য অধিনায়ক আকবর আলী পঞ্চম উইকেটে শামিম হোসেনকে নিয়ে ধীরে ধীরে এগোতে থাকেন। তারা গড়েন ২০ রানের জুটি। কিন্তু ইনিংসের ২১তম ওভারে মিশ্রর শর্ট পিচ বলে ৬ হাঁকানোর চেষ্টায় শামিম সীমানায় ধরা পড়েন জয়সওয়ালের হাতে। এর কিছুক্ষণ পরই একই বোলারের বলে কার্তিক ত্যাগের হাতে ধরা পড়েন অভিষেক দাস। তার বিদায়ে আসলে বাংলাদেশের প্রথম কোনো আইসিসি টুর্নামেন্টের শিরোপা জেতার আশা প্রায় শেষ হয়ে যায়। তবে চোটমুক্ত হয়ে আবার ইমন ২২ গজে ফিরে আকবরকে নিয়ে প্রতিরোধ গড়লে আশা বাড়ে। সপ্তম উইকেট জুটিতে তারা গড়েন ৪১ রানের জুটি। সে সময় ইমন খেলছিলেন ৪৭ রানে। হাফসেঞ্চুরির জন্য একটা চার চাইছিলেন এ বাঁহাতি। সে লোভেই জয়সওয়ালের শর্ট পিচ বলে ব্যাট চালিয়েছিলেন। কিন্তু টাইমিংয়ে হেরফের হওয়ায় তিনি এক্সটা কাভারে ধরা পড়েন আকাশ সিংয়ের হাতে। তাতে ফের বিপদে পড়ে জুনিয়র টাইগাররা। তবে অষ্টম উইকেটে রকিবুলকে নিয়ে খুব দেখেশুনে পথ হাঁটেন অধিনায়ক আকবর। তারা দু’জনে দলকে ৪১ ওভারে পৌঁছে দেন ১৬৩ রানে। জিততে তখন তাই দরকার ছিল ১৫ রান। কিন্তু হঠাৎ বৃষ্টি নেমে আসে। যে কারণে কার্টল ওভারে টাইগারদের জয়ের জন্য নতুন লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ৪৬ ওভারে ১৭০ রান। মানে পরের ৩০ বলে ৭ রান হলেই প্রথমবার বিশ্বজয়ের আনন্দে মাতবে জুনিয়র টাইগাররা। শেষ পর্যন্ত আকবর আলীর বীরত্বে ২৩ বল আগেই তারা সেটা পেরেছে। এর ফলে প্রথমবার কোনো আইসিসি টুর্নামেন্টের শিরোপা উল্লাসে মাতে জুনিয়র টাইগাররা।
এর আগে পচেফস্ট্রুমে গতকাল টস জিতে বল হাতে দারুণ শুরু করেছিল বাংলাদেশ। শরিফুল ইসলাম ও তানজিম হাসানদের বলে কঠিন সময়টা পার করেন জয়সওয়াল ও দিব্যানাশ সাক্সেনা। এর কিছুক্ষণ পরই বোলিং আক্রমণে এসেই প্রতিপক্ষ শিবিরে আঘাত করেন অভিষেক দাস। অফ স্টাম্পে পড়ে বেরিয়ে যাওয়া বলে পয়েন্ট নিয়ে চার মারতে চেয়েছিলেন সাক্সেনা। ঠিকমতো টাইমিং করতে পারেননি। ধরা পড়েন পয়েন্টে। দ্বিতীয় উইকেটে অবশ্য ৯৪ রানের জুটি গড়েন তিলক ভার্মা ও যাশাসবি জয়সওয়াল। তাতে কিছুটা হলেও চাপে পড়েছিল জুনিয়র টাইগাররা। শেষ পর্যন্ত ম্যাচের ২৯তম ওভারের শেষ বলে তিলক ভার্মাকে সীমানায় শরিফুলের ক্যাচে ফেরান তানজিম হাসান সাকিব। এর কিছুক্ষণ পরই প্রিয়ম গার্গকে ফিরিয়ে আনন্দে মাতেন রকিবুল। বাঁহাতি স্পিনারের অফ স্টাম্পের বাইরের বলে আলগা শটে কাভারে তানজিম হাসানের হাতে ধরা পড়েন গার্গ। তবে অন্য প্রান্তে বেশ খেলছিলেন জয়সাওয়াল। সেঞ্চুরির স্বপ্ন বুনছিলেন তিনি। অবশেষে পারলেন না, সেঞ্চুরির আগেই যাশাসবি জয়সাওয়ালকে ফিরিয়ে ভারতকে বড় একটা ধাক্কা দেন শরিফুল। পরের বলে তিনি ফিরিয়ে দেন সিদ্ধেশ বীরকে।
এদিকে জোড়া উইকেট হারানোর ধাক্কা সামাল দেওয়ার আগেই আরেকটি উইকেট হারায় ভারত। রান আউট হয়ে ফিরে যান ধ্রুব জুরেল। এর কিছুক্ষণ পরই নিজের বলে ফিল্ডিং করে রান আউট করে রবি বিষ্ণুইকে ফেরান শরিফুল ইসলাম। ভারতের সেই ক্ষত থাকতেই জোড়া ধাক্কা দেন অভিষেক। এবার এ পেসার আক্রমণে ফিরেই ওভারের প্রথম বলে বোল্ড করেন আনকোলেকারকে। শেষ বলে কট বিহাইন্ড করেন কার্তিক তিয়াগিকে। এর ফলে মাত্র ২১ রানেই শেষ ৭ উইকেট হারায় ভারত। যে কারণে দলটি গুটিয়ে যায় ৪৭.২ ওভারে মাত্র ১৭৭ রানে।
বাংলাদেশের হয়ে শরিফুল ইসলাম ১০ ওভারে ৩১ রানে ২ উইকেট নেন। এদিকে তানজীম হাসান ৮.২ ওভারে ২৮ রানে ২ উইকেট নেন। অভিষেক দাস নিজের পকেটে পুরেন ৯ ওভারে ৪০ রানে ৩ উইকেট।
এদিকে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিশ্বজয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক অভিনন্দন বার্তায় তিনি উল্লেখ করেন ‘যুবাদের অসাধারণ নৈপুণ্য ও মনোবলে পুরো জাতি গর্বিত।’ এছাড়া অভিনন্দন জানিয়েছেন আইসিসির সাবেক সভাপতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, পরিকল্পনামন্ত্রী এম. এ. মান্নানসহ মন্ত্রিপরিষদের অন্য সদস্যরা।
সংক্ষিপ্ত স্কোর :
ভারত অনূর্ধ্ব-১৯ দল: ৪৭.২ ওভারে ১৭৭ (জয়সাওয়াল ৮৮, সাক্সেনা ২, ভার্মা ৩৮, গার্গ ৭, জুরেল ২২, বীর ০, আনকোলেকার ৩, বিষ্ণুই ২, সুশান্ত ৩, ত্যাগী ০, আকাশ ১*; শরিফুল ১০-১-৩১-২, তানজিম ৮.২-২-২৮-২, অভিষেক ৯-০-৪০-৩, শামীম ৬-০-৩৬-০, রকিবুল ১০-১-২৯-১, হƒদয় ৪-০-১২-০)
বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল: (লক্ষ্য ৪৬ ওভারে ১৭০) ৪২.১ ওভারে ১৭০/৭ (পারভেজ ৪৭, তানজিদ ১৭, মাহমুদুল ৮, হƒদয় ০, শাহাদাত ১, আকবর ৪৩*, শামীম ৭, অভিষেক ৫, রকিবুল ৯*; কার্তিক ১০-২-৩৩-০, সুশান্ত ৭-০-২৫-২, আকাশ ৮-১-৩৩-০, বিষ্ণুই ১০-৩-৩০-৪, আনকোলেকার ৪.১-০-২২-০, জয়সওয়াল ৩-০-১৫-১)
ফল: ডাকওয়ার্থ ও লুইস পদ্ধতিতে বাংলাদেশ ৩ উইকেটে জয়ী