ভারতকে বন্দর-ভূখণ্ড ব্যবহারে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি হাসিনার

ইসমাইল আলী: বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় ট্রানজিটের পণ্য পরীক্ষামূলক পরিবহন শুরু হয় ২০২০ সালে। গত বছর বাণিজ্যিকভাবে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি পায় ভারত। এজন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ২০২৩ সালের ২৪ এপ্রিল একটি স্থায়ী আদেশ জারি করে, যার আওতায় নামমাত্র ফিতে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছিল দেশটি।

এদিকে বাংলাদেশের সড়ক ব্যবহার করে পণ্য নিয়ে যেতেও খুব সামান্যই ব্যয় করতে হবে ভারতের। প্রতি টন পণ্য পরিবহনে কিলোমিটারপ্রতি সড়ক ব্যবহার ফি দুই টাকারও কম। আর কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা বাস চলাচলে নেই কোনো সড়ক ব্যবহার ফি। বিনা ফিতে দেশটির বাস বাংলাদেশের ওপর দিয়ে কলকাতা থেকে আগরতলা পর্যন্ত চলাচল করে। গত বছরের আদেশ অনুযায়ী, বন্দর ব্যবহারের জন্য প্রতি চালানের প্রক্রিয়াকরণ মাশুল বা প্রসেসিং ফি মাত্র ৩০ টাকা। আর প্রতি টনের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট ফি ২০ টাকা, নিরাপত্তা ফি ১০০ টাকা এবং অন্যান্য প্রশাসনিক ফি ১০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। কনটেইনার স্ক্যানিং ফি (প্রতি কনটেইনারে) ২৫৪ টাকা। এছাড়া প্রতি কনটেইনার বা গাড়ির জন্য কিলোমিটারপ্রতি এসকর্ট (পাহারা) ফি ৮৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

সাধারণত ২০ ফুটের (টিইইউ) প্রতিটি কনটেইনারে ২৫ টন করে পণ্য বহন করা যায়। এতে প্রতি কনটেইনারে মাত্র ৫০০ টাকা হারে ট্রান্সশিপমেন্ট চার্জ দিতে হবে ভারতকে। যদিও ২০১০ সালে এ হার নির্ধারণ করা হয়েছিল ১০ হাজার টাকা। অর্থাৎ ২০১০ সালের নির্ধারিত চার্জের তুলনায় বর্তমানে ২০ ভাগের এক ভাগ ট্রান্সশিপমেন্ট চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে অজ্ঞাত কারণে ২০১০ সালের ট্রান্সশিপমেন্ট ফির ওই হার সে বছরই বাতিল করা হয়।

এদিকে ভারতে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে ইলেকট্রিক লক ও সিল ফি নামের আরেকটি খাত রয়েছে, যেটি এখনও নির্ধারিত হয়নি। এক্ষেত্রে বিধিমালা অনুযায়ী ফি আরোপ করা হবে বলে উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া সড়কপথে পণ্য পরিবহনের জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত মাশুল দিতে হবে। ২০২১ সালের ১৬ জুন আটটি রুটে ওই মাশুল নির্ধারণ করে মন্ত্রণালয়। এতে প্রতি টন পণ্যে প্রতি কিলোমিটারে মাশুল ধরা হয় এক টাকা ৮৫ পয়সা।

আটটি রুটের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূরত্ব মোংলা বন্দর-গোপালগঞ্জ-মাওয়া-ঢাকা-নরসিংদী-আশুগঞ্জ-সিলেট-তামাবিল রুটের। এই রুটে ৪৩৫ কিলোমিটার দূরত্বের জন্য টোলসহ মাঝারি ক্ষমতার ট্রাকের আদায়যোগ্য মাশুল নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ হাজার ১৯৫ টাকা। সবচেয়ে কম দূরত্ব চট্টগ্রাম বন্দর-ফেনী-কুমিল্লা-বিবিরবাজার রুটের, ১৪৩ কিলোমিটার। এই রুটে সড়কপথের মাশুল নির্ধারণ করা হয়েছে তিন হাজার ৯৮৮ টাকা। তবে বিভিন্ন ধরনের মাশুলের ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) আরোপ হবে।
এনবিআরের আদেশে ট্রানজিট অপারেটর নিয়োগ, বন্দরে জাহাজ ভেড়া, ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্টের ঘোষণা, শুল্কায়ন, পণ্যের কায়িক পরীক্ষা, ট্রানজিটকাল প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তারিত প্রক্রিয়া বলা হয়েছে। আদেশটিতে ট্রানজিট অপারেটর হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত করা এবং সড়কপথে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশি যানবাহন ব্যবহারের কথা রয়েছে।

তথ্যমতে, ২০১৮ সালের অক্টোবরে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের বিষয়ে দুই দেশের সচিব পর্যায়ে চুক্তি হয়। এক বছর পর ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে বৈঠকে এ-সংক্রান্ত পরিচালন পদ্ধতির মান বা স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) সই হয়। সেই এসওপির আওতায় চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য ২০২০ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রথম পরীক্ষামূলক চালান ভারতে যায়। গত বছর চট্টগ্রাম বন্দর ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে আরও কয়েকটি চালান পরীক্ষামূলকভাবে যায়।
ট্রানজিটের রুট: এনবিআরের আদেশ অনুযায়ী, ভারতের পণ্য চালান চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে আটটি রুটে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে স্থলবন্দর হয়ে ভারতে নেয়া যাবে।

এগুলো হলোÑচট্টগ্রাম বন্দর-আখাউড়া-আগরতলা, মোংলা বন্দর-আখাউড়া-আগরতলা, চট্টগ্রাম বন্দর-তামাবিল ডাউকি, মোংলা বন্দর-তামাবিল-ডাউকি, চট্টগ্রাম বন্দর-শেওলা-সুতারকান্দি, মোংলা বন্দর-শেওলা-সুতারকান্দি, চট্টগ্রাম বন্দর-বিবিরবাজার-শ্রীমন্তপুর এবং মোংলা বন্দর-বিবিরবাজার-শ্রীমন্তপুর। সূত্রমতে, প্রায় এক হাজার ৬০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এবং দীর্ঘ সময় ব্যয় করে ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে পণ্য যেত। তবে মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় পণ্য পরিবহনের সময় এবং খরচ বহুলাংশে কমেছে। এতে ভারতের লাভ হলেও বাংলাদেশের জন্য তা খুব একটা লাভজনক নয়।

বাংলাদেশ ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য যে চার্জ নির্ধারণ করেছে, সেটি আরও বেশি হতে পারত বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম। তিনি শেয়ার বিজকে সম্প্রতি বলেন, বন্দর ব্যবহার করে ভারতের ১০০ ডলার যদি বেঁচে যায়, তাহলে ৫০ ডলার বাংলাদেশকে দেয়া উচিত, ৫০ ডলার ভারত রাখুক। কিন্তু ভারত যদি ৮০ ডলারই নিয়ে যায়, বাংলাদেশকে মাত্র ২০ ডলারের সুবিধা দেয়, সেটা ন্যায্য মনে করি না। কারণ বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার হবে, সড়ক ব্যবহার হবে। এগুলোর যে অবচয় সেটি অনেক বেড়ে যাবে। এ বিষয়গুলো বিবেচনা করলে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা আরও বেশি হওয়া উচিত ছিল।
এদিকে দুই দেশের মধ্যে চুক্তির আওতায় ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্যের কাস্টমস প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে যে ফি এবং চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি টাকায় উল্লেখ করা হয়েছে। এসব চার্জ ডলারে নির্ধারণ করলে ভালো হতো বলে মনে করেন ড. মইনুল ইসলাম। তিনি বলেন, গত দেড় থেকে দুই বছরে টাকার বড় অবচয়ন হয়েছে। অতএব সেখানে টাকার অঙ্কে যদি মাশুল নির্ধারণ হয় তাহলে আমরা কম পাচ্ছি আগের চাইতে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের টাকা আরও বেশি অবচয়নের শিকার হবে। তখন এ মাশুল আরও কমে যাবে।
অন্যদিকে আগে ভারতের কলকাতা থেকে আগরতলা পর্যন্ত সরাসরি বাস সার্ভিস ছিল না।

কলকাতা থেকে ঢাকা ও ঢাকা থেকে আগরতলা পৃথক বাস সার্ভিস ব্যবহার করতে হতো ভারতের নাগরিকদের। তবে ২০১৫ সালের জুনে কলকাতা থেকে ঢাকা হয়ে আগরতলা পর্যন্ত সরাসরি বাস সার্ভিস চালুর চুক্তি হয়। এর আওতায় বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করলেও ভারতের বাসকে কোনো ধরনের সড়ক ব্যবহার ফি দিতে হয় না। যদিও ৫ সেপ্টেম্বর ভারতের সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত দ্বিপক্ষীয় চুক্তি পর্যালোচনার আভাস দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘ট্রানজিট ও আদানির বিদ্যুৎ চুক্তির মতো কিছু চুক্তি পুনর্বিবেচনার দাবি রয়েছে। সবাই বলছে এটা করা দরকার। আমরা প্রথমে দেখব কাগজে কী আছে এবং দ্বিতীয়ত, প্রকৃত অবস্থা আসলে কী। আমি এ বিষয়ে নির্দিষ্টভাবে এখনই বলতে পারছি না। যদি পর্যালোচনার প্রয়োজন হয়, তাহলে আমরা এ বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করব।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০