Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 4:15 pm

ভারতীয় ঋণে রেলের তিন প্রকল্প ঝুলছে এক দশক

ইসমাইল আলী: খুলনা থেকে মোংলা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি নেয়া হয় ২০১০ সালের ডিসেম্বরে। কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ পুনর্বাসন প্রকল্পটি নেয়া হয় ২০১১ সালের জুনে আর ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয়-চতুর্থ লাইন রেলপথ নির্মাণ ও টঙ্গী-জয়দেবপুর ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্প নেয়া হয় ২০১২ সালের জুলাইয়ে। এক দশক বা তারও আগে নেয়া রেলের এ প্রকল্প তিনটিতে অর্থায়ন করছে ভারত। তবে কয়েক দফা মেয়াদ বাড়ানোর পরও ঝুলছে প্রকল্পগুলো।

এ কারণে প্রকল্পগুলোয় ভারতের ঋণ (এলওসি) ব্যবহারেও গতি নেই। ফলে ২০১০ সালে ১০০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করলেও তা ছাড় শেষ হয়নি। এ অবস্থায় প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছে ভারত। সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি দিয়েছে দেশটির দূতাবাস। পাশাপাশি দ্বিতীয় ও তৃতীয় এলওসিতে গৃহীত চারটি প্রকল্পও দ্রুত বাস্তবায়ন শুরুর তাগিদ দেয়া হয়েছে।

ভারতের উপ-হাইকমিশনার স্বাক্ষরিত এ চিঠিতে রেলপথ সচিবকে এলওসির আওতায় গৃহীত প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নে ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ দেয়া হয়েছে।

তথ্যমতে, খুলনা-মোংলা বন্দর রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৪ হাজার ৩২৯ কোটি ১১ লাখ টাকা। আর প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ৩৮ কোটি ৮৯ লাখ ডলার বা প্রায় তিন হাজার ৩০৫ কোটি ২০ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে ভারত। প্রকল্পটির সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (আরডিপিপি) চূড়ান্ত করার কাজ চলছে।

চিঠিতে প্রকল্পটি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, খুলনা-মোংলা বন্দর রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের আরডিপি চূড়ান্ত করে দ্রুত তা অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো দরকার। প্রকল্পটির কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইরকন ইন্টারন্যাশনালের চুক্তির ভেরিয়েশন প্রস্তাবও দুই বছরের বেশি সময় ধরে ঝুলে আছে, যা দ্রুত অনুমোদন করা উচিত।

এদিকে প্রকল্পটির মাসিক বিল প্রদান প্রক্রিয়া বিলম্বিত হতে হতে তা ৩-৪ মাসে গিয়ে ঠেকেছে, যা প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। যদিও চুক্তি অনুযায়ী তা ৩০ দিনের মধ্যে অনুমোদনের কথা। এছাড়া প্রকল্পটির আওতায় ৯টি স্টেশনে রঙিন সিগনাল বাতি স্থাপনসহ ইন্টারলকিং সিগনালিং ব্যবস্থা স্থাপনে দ্রুত দরপত্র মূল্যায়ন শেষ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।

এর বাইরে প্রকল্পটির আওতায় মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের জেটি এলাকায় বিদ্যমান বিভিন্ন ইউটিলিটি পরিষেবা লাইন স্থানান্তরের বিষয়টি রেলওয়েকে যথাযথভাবে মনিটর করতে অনুরোধ করা হয়, যাতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট এলাকায় দ্রুত কাজ শুরু করতে পারে।

এদিকে ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয়-চতুর্থ লাইন রেলপথ নির্মাণ ও টঙ্গী-জয়দেবপুর ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ১৬০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। তবে প্রকল্পটির ব্যয় দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। আর এতে ভারত ঋণ দিচ্ছে ২৩ কোটি ৫১ লাখ ডলার বা এক হাজার ৯৯৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এজন্য আরডিপিপি চূড়ান্তকরণের কাজ চলছে।

প্রকল্পটি প্রসঙ্গে ভারতীয় দূতাবাস জানায়, প্রকল্পটির কমলাপুর থেকে বনানী অংশে ১০ কিলোমিটার এলাকায় ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ-সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে রেলওয়েকে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। কারণ এক্সপ্রেসওয়ে ও রেলপথের রুট সমান্তরাল। তাই এক্সপ্রেসওয়ের জন্য রেলপথ নির্মাণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান (এফকন্স অ্যান্ড কল্পতরু জেভি) প্রকল্প এলাকায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও জনবল নিয়োগ করতে পারছে না।

প্রকল্পটির রুটের মধ্যে বনানী-খিলগাঁও অবস্থিত অংশে অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বৈদ্যুতিক খুঁটি, গ্যাসলাইন ইত্যাদি পরিষেবা সংযোগ লাইন স্থানান্তরেও রেলওয়েকে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এছাড়া বিমানবন্দর স্টেশন, মহাখালী ডিওএইচএস ও বনানী আর্মি মেস এলাকায় আর্মি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্মিত সীমানা ওয়ালের কারণে রেলপথ নির্মাণে প্রয়োজনীয় স্থান সংকুলানে জটিলতা দেখা দিয়েছে, তা সমাধানে দ্রুত উদ্যোগ নিতে বলা হয়।

এদিকে প্রকল্পটির আওতায় ৪২নং সেতুর পাইলের রি-ডিজাইন করা হয়েছে। তবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এখনও ডিজাইন অনুমোদন করেনি। এছাড়া প্রকল্প সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যু যেমনÑসিøপার ডিজাইন, ব্যালাস্ট (পাথর) সংগ্রহের উৎস, জিএফসি (নির্মাণসামগ্রী) ড্রয়িং, কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড প্ল্যান ও অবস্থানসহ বিভিন্ন পেন্ডিং ইস্যু দ্রুত সমাধান করা দরকার।

গত বছর ২০ ফেব্রুয়ারি প্রকল্পটির সিগনালিং কাজের দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্র মূল্যায়ন শেষে গত এপ্রিলে ভারতের এক্সিম ব্যাংককে মেইলে জানানো হয় তা বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু এখনও পুনরায় দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। এছাড়া গত ফেব্রুয়ারি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প ম্যানেজার এক চিঠিতে জানান, স্থানীয় গ্যাং তাকে হুমকি দিয়েছে ও শারীরিকভাবে হেনস্তা করেছে। প্রকল্প এলাকায় বিশেষত টঙ্গীর বঙ্গমালা গেটের কাছে উচ্ছেদকৃত জমির মালিকরা নানাভাবে প্রকল্পের কাজে বাধা সৃষ্টি করছেন। তাই বাংলাদেশ রেলওয়ের উচিত প্রকল্প এলাকায় নিয়োজিত কর্মী ও নির্মাণসামগ্রীর নিরাপত্তা বিধান করা।

একইভাবে কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ প্রকল্পের অগ্রগতির বাধাও তুলে ধরা হয় চিঠিতে। এতে বলা হয়, প্রকল্পটির পরামর্শকের চুক্তি মেয়াদ এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে সরাসরি পদ্ধতিতে পরামর্শক নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণে রেলওয়েকে অনুরোধ করে। এক্ষেত্রে রেলওয়েকে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এছাড়া প্রকল্পটি ঠিকাদার নিয়োগের ভেরিয়েশন প্রস্তাব চূড়ান্ত করার মধ্যে প্রকল্প ব্যয় পুনর্নির্ধারণ করা দরকার।

বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন মেয়াদকাল ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে। এর ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টিও চূড়ান্ত করা দরকার।

যদিও কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ পুনর্বাসন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৭৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা। তবে তা বেড়ে ৮০০ কোটি টাকায় ঠেকতে পারে। আর প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ভারত ঋণ দিচ্ছে ৬৬৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা বা সাত কোটি ৮১ লাখ ডলার।

এর বাইরে দ্বিতীয় এলওসির আওতায় রেলওয়ের প্রকল্প রয়েছে তিনটি। এগুলো হলো সৈয়দপুরে নতুন একটি ক্যারেজ ওয়ার্কশপ নির্মাণ, খুলনা-দর্শনা ডাবল লাইন নির্মাণ ও পার্বতীপুর-কাউনিয়া রেলপথ মিটারগেজ থেকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর। প্রকল্প তিনটিতে ভারত ঋণ দিচ্ছে যথাক্রমে সাত কোটি তিন লাখ ডলার, ৩১ কোটি ২৫ লাখ ডলার ও ১২ কোটি চার লাখ ডলার। আর তৃতীয় এলওসির আওতায় বগুড়া সৈয়দ এম মনসুর আলী স্টেশন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে ৩৭ কোটি ৯৩ লাখ ডলার ঋণ দেবে ভারত। প্রকল্পগুলোর কাজ দ্রুত শুরু করতে অনুরোধ করা হয় চিঠিতে।

উল্লেখ্য, ভারতের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের ইআরডি ১০০ কোটি ডলার ঋণচুক্তি সই করে ২০১০ সালের ৭ আগস্ট। তবে ২০১২ সালে এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ থেকে ২০ কোটি ডলার অনুদান হিসেবে দেয়ার ঘোষণা দেয় ভারত। পরে ২০১৬ সালের আগস্টে এলওসিতে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় আরও ছয় কোটি ২০ ডলার ঋণ অনুমোদন করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এতে সব মিলে প্রথম এলওসিতে ভারতের ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৬ কোটি ২০ লাখ ডলার।

এছাড়া দ্বিতীয় এলওসির আওতায় ১৮টি প্রকল্পে ২০১৬ সালের ৯ মার্চ ২০০ কোটি ডলারের চূড়ান্ত ঋণ চুক্তি সই করে বাংলাদেশ সরকার ও ভারতের এক্সিম ব্যাংক। আর তৃতীয় এলওসির আওতায় ১৬টি প্রকল্পে ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি সই হয় ২০১৭ সালের ৪ অক্টোবর।