নিজস্ব প্রতিবেদক: ডলার সংকটের কারণে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে ডলারের বিকল্প মুদ্রায় লেনদেন চালু করতে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এরই ধারাবাহিকতায় চীনা মুদ্রা ইউয়ানে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন। ভারতের সঙ্গেও বিকল্প মুদ্রায় লেনদেন করার জন্য বাংলাদেশ অনেক আগে থেকে চেষ্টা চালিয়ে গেছে। অবশেষে দেশটি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের সঙ্গে শুরু করতে যাচ্ছে রুপিতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য।
ইতোমধ্যে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) গত সপ্তাহ স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও ইস্টার্ন ব্যাংককে (ইবিএল) রুপিতে লেনদেন করার অনুমতি দিয়েছে। ব্যাংকগুলো গ্রাহক পেলে যে কোনো সময় রুপিতে লেনদেন করতে পারবে। আগামী ১১ জুলাই ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ট্রেডিং ইন্ডিয়ান রুপি ঘোষণা করা হবে।
ভারতের সঙ্গে কারেন্সি সোয়াপ ব্যবস্থা বা নিজস্ব মুদ্রা বিনিময়ের মাধ্যমে উভয় দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য করার আলাপ চলছে প্রায় এক দশক ধরে। ডলার বা অন্য কোনো মুদ্রা এড়িয়ে দুটি দেশ যখন নিজেদের মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য পরিচালনা করে, আর্থিক পরিভাষায় একে বলা হয় ‘কারেন্সি সোয়াপ ব্যবস্থা’। এ ব্যবস্থায় অর্থাৎ ভারতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য করতে বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক ও ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই) হিসাব খোলার অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ হিসাবের নাম নস্ট্র হিসাব। গত সপ্তাহে ইস্টার্ন ব্যাংক ও ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া রুপি লেনদেনে বিশেষ অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক থেকেও অনুমোদন পেয়েছে। সোনালী ব্যাংক হিসাব খোলার এখনও আরবিআই’র অনুমোদন পায়নি।
এক দেশের এক ব্যাংক অন্য দেশের কোনো ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেনের উদ্দেশে হিসাব খুললে সে হিসাবকে নস্ট্র হিসাব বলা হয়। একইভাবে বিদেশের কোনো ব্যাংক যদি বাংলাদেশের কোনো ব্যাংকে একই উদ্দেশে হিসাব খুলে থাকে, তাকে বলা হয় ভস্ট্র হিসাব। আপাতত ভস্ট্র হিসাব খোলার দিকটি বিবেচনায় থাকছে না বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রগুলো জানায়। রুপির পাশাপাশি বাংলাদেশি মুদ্রা টাকাও যখন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহƒত হবে, তখন ভস্ট্র হিসাব খোলার বিষয়টি আসবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, ২০২২ সালের জুলাইয়ে আরবিআই স্পেশাল ভস্ট্র হিসাব খোলার অনুমতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। ওই প্রজ্ঞাপনের আলোকে আমাদের তিনটি ব্যাংক স্পেশাল ভস্ট্র (এখানের নস্ট্র) অ্যাকাউন্ট খুলতে অনুমতি চায়। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের খোলার অনুমতি দেয়। এরপর তারা আরবিআই’র অনুমোদন নিয়ে দুটি ব্যাংক হিসাব খুলে ফেলেছে। এখন গ্রাহক পেলে যে কোনো সময় তারা রুপিতে লেনদেন করতে পারবে।
২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্যের উদ্যোগ নিয়েছিল ভারত। তখন উদ্যোগটি এগোয়নি। গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ-ভারত মন্ত্রিপর্যায়ের বৈঠকে ভারত উভয় দেশের জন্য বাণিজ্যের মাধ্যম হিসেবে রুপি চালু করার প্রস্তাব দেয়। সেই ধারাবাহিকতায় গত ফেব্রুয়ারিতে ভারতের বেঙ্গালুরুতে এক বিশেষ বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এবং আরবিআই’র গভর্নর শক্তিকান্ত দাস ডলারের পরিবর্তে রুপির ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করেন।
বর্তমানে ভারতে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ এবং প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট ৮ হাজার ৯১৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৬৯ কোটি ডলারের পণ্যই আমদানি হয় ভারত থেকে। একই অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে রপ্তানি করে ১৯৯ কোটি ডলারের পণ্য। আমদানি-রপ্তানি মিলিয়ে উভয় দেশের মধ্যে ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয় ওই অর্থবছরে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরেও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের একই প্রবণতা রয়েছে।
এদিকে ডলার সাশ্রয়ের লক্ষ্যে আগামী সেপ্টেম্বরে দেশে টাকা-রুপিভিত্তিক ডেবিট কার্ড চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি উপস্থাপনকালে গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার এ ঘোষণা দেন।
কার্ডের মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা টাকা দিয়ে যেমন দেশের মধ্যে কেনাকাটা করতে পারবেন, তেমনি একই কার্ড দিয়ে ভারতে রুপিতেও কেনাকাটা করতে পারবেন।
এই কার্ডের মাধ্যমে ডাবল কারেন্সি এক্সচেঞ্জের প্রয়োজন মিটবে বলে আশা করা হচ্ছে। ফলে টাকাকে ডলারে এবং এরপর ডলারকে রুপিতে রূপান্তর করতে ৬ শতাংশ এক্সপেনডিচার লস সাশ্রয় হবে বলে জানিয়েছেন গভর্নর। তিনি আরও বলেন, যেসব বাংলাদেশি পর্যটক ঘন ঘন ভারতে ভ্রমণে যান তাদের জন্য এটি বিশেষভাবে উপকারী হবে।