ইসমাইল আলী: ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গড্ডা জেলায় এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করেছে আদানি পাওয়ার। এ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আমদানি করা প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়বে প্রায় ১৮ টাকা। যদিও ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে খরচ হয় গড়ে ৬ টাকা। আগামী ২ জানুয়ারি গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আনুষ্ঠানিক বিদ্যুৎ আমদানি শুরুর কথা রয়েছে। যদিও গত ১০-১১ ডিসেম্বর কেন্দ্রটি থেকে পরীক্ষামূলক (২৪ ঘণ্টা) বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ২ জানুয়ারি ভার্চুয়ালি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে আমদানি প্রক্রিয়ার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে। এজন্য ১ জানুয়ারি বাংলাদেশ থেকে একদল সাংবাদিকদেরও ভারত নিয়ে যাচ্ছে আদানি গ্রুপ। যদিও এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে নেতিবাচক বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নিয়ে চলতি মাসে দুটি পৃথক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট অব এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ) ও যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্ট। উভয় প্রতিবেদনে আদানির বিদ্যুৎকে ব্যয়বহুল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ব্যয় বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেও মন্তব্য করা হয়েছে।
আদানির কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আমদানির সম্ভাব্য ব্যয় এরই মধ্যে প্রাক্কলন করেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি)। সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদানির ঝাড়খণ্ডের গড্ডা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। তবে চলতি অর্থবছর বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে সর্বোচ্চ ৭২৫ মেগাওয়াট। আগামী জুলাই থেকে পুরো বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করবে ভারতের এ গ্রুপটি।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছর আদানির বিদ্যুৎ সরবরাহের সম্ভাব্য পরিমাণ দাঁড়াবে ২৯৮ কোটি ৭০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এজন্য জ্বালানি বাবদ বিল গুনতে হবে চার হাজার ৭৯ কোটি টাকা আর ক্যাপাসিটি চার্জ এক হাজার ২৫৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ব্যয় হবে পাঁচ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। এ হিসাবে আদানির বিদ্যুৎ কিনতে প্রতি ইউনিটের দাম পড়বে ১৭ টাকা ৮৭ পয়সা।
এদিকে ভারত থেকে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি রয়েছে। গত অর্থবছর ওই চুক্তির অধীনে বিদ্যুৎ আমদানি করা হয় ৭৬৪ কোটি ৪০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এজন্য জ্বালানি বাবদ বিল গুনতে হয় দুই হাজার ১৬৪ কোটি টাকা আর ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় দুই হাজার ৫০৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ব্যয় পড়ে চার হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। এ হিসাবে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ছয় টাকা ১১ পয়সা।
চলতি অর্থবছর ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির সম্ভাব্য পরিমাণ ধরা হয়েছে (আদানি ছাড়া) ৮২৪ কোটি ৬০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এজন্য জ্বালানি বাবদ বিল গুনতে হবে দুই হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা আর ক্যাপাসিটি চার্জ দুই হাজার ৬২৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ব্যয় হবে পাঁচ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। এ হিসাবে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ আমদানিতে (আদানি ছাড়া) ব্যয় পড়বে ছয় টাকা ৪১ পয়সা।
গত ১৩ ডিসেম্বর আইইইএফএ’র প্রতিবেদনে জানানো হয়, আদানি গ্রুপ গড্ডা কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অস্ট্রেলিয়ার কারমাইকেল খনির কয়লা ব্যবহার করবে। দেশটি থেকে আনা সে কয়লা ভারতের বন্দর থেকে গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত ৭০০ কিলোমিটার রেলপথে নেয়া হবে। এর পুরো খরচ বহন করবে বাংলাদেশ। কয়লার দাম ও পরিবহন খরচ বেশি হওয়ায় আদানির বিদ্যুতের দাম বেশি পড়বে। যদিও আমদানি করা কয়লা দিয়ে উৎপাদিত পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ছে ৮-৯ টাকা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রাথমিকভাবে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুতের মূল্য ৮.৭১ টাকা ধরা হলেও, পরবর্তী সময়ে তা ১৫ টাকা দাঁড়াবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিভাগ। এর মূল কারণ, গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উচ্চ ক্যাপাসিটি চার্জ। এতে প্রতি মেগাওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ আমদানিতে বাংলাদেশকে প্রয় ১৫০ ডলার গুনতে হবে, যা প্রাথমিক প্রাক্কলিত ব্যয়ের প্রায় দ্বিগুণ।
প্রতিবেদনের লেখক সিমন নিকোলাস বলেন, প্রাথমিকভাবে ভারতের ঝাড়খণ্ডের কয়লাখনির কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে ব্যবহারের পরিকল্পনা ছিল আদানির। পরে তা পরিবর্তন করে অস্ট্রেলিয়ার কারমাইকেল খনি থেকে আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এতে বিদ্যুৎ আমদানিতে যা ব্যয় হবে তা পিডিবির গড় ব্যয়ের প্রায় আড়াইগুণ। ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি এ খাতে সরকারের ভর্তুকির বোঝা বৃদ্ধি করবে। পাশাপাশি তা বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখবে, যা জনগণের কাঁধে চাপবে।
এদিকে ৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনটি মূলত আদানি গ্রুপের কয়লাভিত্তিক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের জুনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে এসে বাংলাদেশের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রিতে ভারতের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি সই করেন।
নরেন্দ্র মোদির এ সফরের পর ভারতের বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ গৌতম আদানির সঙ্গে ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারে গড্ডায় এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি করে। চুক্তিটি প্রথমে বাংলাদেশ ও ভারতের ‘উভয়ের জন্য লাভজনক’ বলে মনে হলেও আসলে তা বাংলাদেশের জন্য ‘খুবই কম লাভজনক’ বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, এটি ছিল নরেন্দ্র মোদির জন্য ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতিকে শক্তিশালী করা ও ভারতীয় ব্যবসার প্রচারের একটি সুযোগ। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ খাতে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে প্রবেশের সুবিধা’ দিতে বলেছিলেন নরেন্দ্র মোদি।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের আদানির বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ক সইকৃত ১৬৩ পৃষ্ঠার ‘গোপন চুক্তিপত্রে’র কপি তিনজন বিশেষজ্ঞকে দিয়ে পর্যালোচনা করানো হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ওয়াশিংটন পোস্ট। চুক্তি পর্যালোচনা করে ওয়াশিংটন পোস্টকে সিডনিভিত্তিক জ্বালানি বিশ্লেষক টিম বাকলি জানান, গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে যাওয়ার পর কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও আদানিকে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে বছরে প্রায় ৪০ কোটি ৫০ লাখ ডলার দিতে হবে বাংলাদেশকে। বিদ্যুৎ খাতের বৈশ্বিক মান অনুসারে যা ‘উচ্চমূল্য’।
বাংলাদেশ সরকারের তথ্য অনুযায়ী, কয়লা ও গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় এখন সর্বোচ্চ চাহিদার তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছেÑউল্লেখ করে ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন বলছে, ভারতের এই বিদ্যুৎ বাংলাদেশের প্রয়োজন নাও হতে পারে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম যত বেশিই হোক না কেন, বাংলাদেশ একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বিদ্যুৎকেন্দ্রকে পরিশোধ করে। অথচ আদানির সঙ্গে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লার দাম আন্তর্জাতিক বাজারদর অনুযায়ী দেবে। গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে কয়লার দাম প্রায় ৩ গুণ বেড়েছে।
আদানির নিজস্ব কয়লার ব্যবসা থাকায় এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা সরবরাহ করতে পারে তার প্রতিষ্ঠানই। প্রকল্পের পরিবেশগত ছাড়পত্রের নথির বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছরে ৭ মিলিয়ন টন কয়লা এখানে অন্য দেশ থেকে সরবরাহ করা হবে।
চুক্তি বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছেন, এই কয়লা আসতে পারে আদানির মালিকানাধীন ভারতের পূর্বাঞ্চলের একটি বন্দরে। এরপর সেখান থেকে তা আদানির নির্মিত রেলে পৌঁছাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রে। উৎপাদিত বিদ্যুৎ আদানি হাইভোল্টেজ লাইনের মাধ্যমে আসবে বাংলাদেশ সীমান্তে। এসবের পরিবহনের খরচ বহন করবে বাংলাদেশ।
দক্ষিণ এশিয়ায় জ্বালানি নিয়ে কাজ করা বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন টিম বাকলি। তিনি ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছেন, এই চুক্তি অনুযায়ী দেশের পাইকারি বিদ্যুতের বাজার মূল্যের ৫ গুণেরও বেশি দামে আদানির বিদ্যুৎ কিনবে বাংলাদেশ। এমনকি কয়লার দাম ইউক্রেন যুদ্ধের আগের পর্যায়ে ফিরে গেলেও অভ্যন্তরীণ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য যে খরচ সরকার দেখায়, তার চেয়ে অন্তত ৩৩ শতাংশ বেশি দামে এই বিদ্যুৎ কিনতে হবে। বাংলাদেশের কাপ্তাই সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের তুলনায় আদানির বিদ্যুতের দাম পড়বে ৫ গুণ বেশি।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে আদানি পাওয়ার লিমিটেডের চুক্তি সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী গত বছরের ডিসেম্বরে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু হওয়ার কথা ছিল। তবে করোনাসহ নানা কারণে তা এক বছর পিছিয়ে গেছে। ভারতের এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত ১০৫ দশমিক ৯ কিলোমিটার ও বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে জাতীয় গ্রিড পর্যন্ত ২৯ দশমিক ৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইনের কমিশনিং সম্পন্ন হয়েছে। গত ১৫ আগস্ট বাংলাদেশ গ্রিড থেকে ব্যাকফিড পাওয়ার প্রদান করা হয়েছে।
এদিকে গত ১০ ডিসেম্বর বিকাল ৪টা থেকে কেন্দ্রটি থেকে বাংলাদেশে পরীক্ষামূলক ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে ১০ ডিসেম্বর রাত ৯টায় সর্বোচ্চ ১৬০ মেগাওয়াট ও ১১ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় সর্বোচ্চ ১৬৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।