শেয়ার বিজ ডেস্ক: ভারী বৃষ্টিপাত এবং ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে দেশের আট জেলা বন্যাকবলিত হয়েছে। বন্যা আরও নতুন নতুন অঞ্চলে বিস্তৃত হতে পারে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এদিকে বন্যায় তিনজনের মৃতুর খবর পাওয়া গেছে।
দেশের সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ফেনী, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও খাগড়াছড়ি জেলা বন্যাকবলিত হয়েছে। আবহাওয়া সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। ফলে এ সময় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার প্রধান নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পেতে পারে। এতে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।
এদিকে কুশিয়ারা, মনু, ধলাই, খোয়াই, মুহুরী, ফেনী ও হালদা নদীর পানি সাতটি স্টেশনে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে বলেও জানা গেছে। এদিকে মঙ্গলবার রাতে ত্রিপুরায় গোমতী নদীতে তৈরি করা ডাম্বুর বাঁধ খুলে দেয় ভারত। এর পরই গোমতীর পানি ফুলেফেঁপে ওঠে। ভারতের গোমতী নদীর পানি কুমিল্লার দেবীদ্বার, মুরাদনগর ও দাউদকান্দি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে মেঘনা নদীতে মিশে যায়। ১৯৯৩ সালের পর এবারই প্রথমবারের মতো খুলে দেয়া হয়েছে ত্রিপুরার ডিম্বুর জলাধারের বাঁধটি। কয়েক দিন ধরে ত্রিপুরায় ব্যাপক বৃষ্টিপাতে জলাধারের পানি বৃদ্ধি পায়। এরপরই বাঁধের সøুইস গেট খুলে দেয় ভারত।
এ প্রতিবেদন লেখার সময় রাত ৮ পর্যন্ত বন্যায় তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ফেনীর ফুলগাজীতে বন্যার পানিতে মো. রাজু (২০) নামে এক তরুণের মৃত্যু হয়েছে। গত মঙ্গলবার রাত ১০টায় ফুলগাজী সদর ইউনিয়নের দক্ষিণ শ্রীপুর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত রাজু ফুলগাজী সদর ইউনিয়নের দক্ষিণ শ্রীপুর পশ্চিমপাড়ার মিজানুর রহমানের ছেলে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় বন্যার পানিতে ডুবে সুবর্ণা আক্তার নামে এক অন্তঃসত্ত্বা নারীর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল উপজেলার বীরচন্দ্রপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। আখাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) লুৎফুর রহমান ও দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন এ তথ্য নিশ্চিত করেন। এছাড়া কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে বন্যার পানিতে মাছ ধরার সময় গাছ থেকে পড়ে শাহাদাত হোসেন (৩৪) নামে এক প্রবাসীর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল চৌদ্দগ্রাম পৌরসভার সোনাকাটিয়া (আদর্শ গ্রাম) পূর্বপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
ত্রাণ কার্যক্রমের বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ নাজমুল আবেদীন বলেন, এরই মধ্যে বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণ কাজের জন্য নগদ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। চাল ও শুকনা খাবার দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের জেলা গুদামগুলোয় পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুত রয়েছে। প্রকৃত রিপোর্টের ভিত্তিতে আমরা বন্যাদুর্গতদের কাছে আরও ত্রাণ পৌঁছে দিতে পারব।
যুগ্ম সচিব আরও বলেন, ফেনী জেলা প্রশাসকের দেয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৭৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে এক হাজার ৬০০ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। অন্যান্য জেলার প্রতিবেদন এখনও পাওয়া যায়নি। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে ফেনী জেলা। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর
ফেনী: ভারী বৃষ্টি ও ভারতের উজানের পানিতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে ফেনীর পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলা। মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের সবকটি ভাঙন দিয়ে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করে ডুবছে একের পর এক জনপদ। এতে বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় দিশাহারা হয়ে পড়েছেন লাখ লাখ মানুষ। ভয়াবহ এই বন্যায় বানভাসি মানুষদের উদ্ধারে গতকাল বেলা আড়াইটা থেকে কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
জানা গেছে, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যাকবলিত এলাকায় আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধার করতে সেনাবাহিনী ও কোস্টগার্ডের সহযোগিতা চাওয়া হয়। এরপর স্পিডবোট নিয়ে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করে তারা। একইসঙ্গে বিজিবি সদস্য ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক পরিবারের শত শত স্বেচ্ছাসেবক উদ্ধার ও খাদ্য সহায়তা প্রদান করছেন। এদিকে বিকালে আইএসপিআরের পক্ষ থেকে বার্তা দিয়ে জানানো হয়, ফেনী জেলার পরশুরাম ও ফুলগাজীতে বন্যার্তদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। উদ্ধার কাজে ব্যবহƒত হচ্ছে স্পিড বোট ও হেলিকপ্টার।
বন্যাকবলিত পরশুরাম উপজেলার সাতকুচিয়া এলাকার বয়োবৃদ্ধ আবদুর রহমান বলেন, বিগত জীবনে এমন ভয়াবহ বন্যা কখনও দেখিনি। সময় বাড়ার সঙ্গে বন্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। টানা বৃষ্টি পড়তে থাকায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। ফেনী আবহাওয়া অধিদপ্তরের উচ্চ পর্যবেক্ষক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, ফেনীতে টানা তিন দিন মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। জেলায় গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আগামী ৭২ ঘণ্টা বৃষ্টি অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ ব্যাপারে ফেনী জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার বলেন, বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী স্পিডবোট নিয়ে কাজ শুরু করেছে। তাদের সঙ্গে কোস্টগার্ডের একটি টিম শিগগিরই যোগ দেবে। এ ছাড়া বিজিবি ও স্বেচ্ছাসেবকরা সকাল থেকে আটকে পড়া মানুষদের নিরাপদ আশ্রয়ে আনতে কাজ করছে।
নোয়াখালী: নোয়াখালীতে ফেনীর মুহুরী নদীর পানি ঢুকছে। এতে নোয়াখালীর ৯টি উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে। নতুন করে জেলার অনেক এলাকা বন্যার পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। এদিকে নোয়াখালীতে গত ২৪ ঘণ্টায় ৭১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত জেলা আবহাওয়া অফিস রেকর্ড করেছে। এর মধ্যে ৯টি উপজেলার ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। গ্রামীণ সব সড়ক ও ফসলি মাঠ এখনও পানিতে তলিয়ে আছে। ভেসে গেছে পুকুর ও খামারের মাছ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টানা বৃষ্টিতে জেলা শহর মাইজদীসহ ৯টি উপজেলার বেশিরভাগ এলাকা জলাবদ্ধ হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতি জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে জেলা প্রশাসন। এদিকে জলাবদ্ধতায় ডুবে গেছে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ও ফসলের মাঠ। এছাড়া নোয়াখালী পৌরসভার বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও দোকানপাটে পানি ঢুকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, ফেনীর মহুরী নদীর পানি নোয়াখালী ঢুকছে। এরপর মহুরী নদীর পানি লক্ষ্মীপুর হয়ে নেমে যাবে। পানি এজন্য বাড়বে। সকালে বিষয়টি আমাকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে। মুহুরী নদীর পানি বেশি হওয়ায় নোয়াখালীও প্লাবিত হচ্ছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া: উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে পণ্য আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিভিন্ন স্থানে গতকাল মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে ভারী বৃষ্টি শুরু হয়। অব্যাহত বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বুধবার সকাল থেকেই জলাবদ্ধতা তৈরি হয় আখাউড়া স্থলবন্দরে।
আখাউড়া স্থলবন্দরের সহকারী পরিচালক মাহমুদুল হাসান জানান, সকালে বন্দরে কয়েকটি মাছের পিকআপ ভ্যান এসেছে। তবে জলাবদ্ধতার কারণে বড় ট্রাকগুলো আসতে পারেনি। ফলে রপ্তানি কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া ইমিগ্রেশনের কার্যক্রমও সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
কুমিল্লা: কয়েক দিনের টানা ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে কুমিল্লার গোমতী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে নদীর চরের সব অঞ্চল প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কয়েকশ পরিবার। গতকাল ভোরে আকস্মিক পানিতে তলিয়ে যায় গোমতী নদীর চরের গ্রামগুলো। বেলা ১টায় নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে। বিকাল ৪টায় ১২ দশমিক ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হতে দেখা গেছে। নদীর বিপৎসীমা ১১ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। এর ফলে গোমতী নদীর উৎপত্তিস্থল ভারতের ডাম্বুরা জলাধারের বাঁধ খুলে দেয়ায় ত্রিপুরার বন্যার পানি নেমে আসছে কুমিল্লার দিকে গোমতী নদী দিয়ে। তবে বিকাল পৌনে ৫টায় গোমতীর বাঁধের কোথাও কোনো সমস্যার খবর পাওয়া যায়নি। এদিকে গোমতীর পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নদীর চরের সব অঞ্চল প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়েছে কয়েকশ পরিবার। জেলার আদর্শ সদর উপজেলার টিক্কারচর, চানপুর, ডুমুরিয়া চানপুর, পালপাড়াসহ নদীর গহ্বরে বসতি গড়া সব পরিবার পানিবন্দি হয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন সেসব পরিবারের মানুষেরা।
কুমিল্লা আদর্শ সদর (ইউএনও) সোমেন রায় বলেন, আমরা তিনটি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছি। বানভাসি মানুষের খাদ্য সহায়তা চলমান রয়েছে।
লক্ষ্মীপুর: টানা ভারী বর্ষণে লক্ষ্মীপুরের সর্বত্র জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। বসতবাড়ি, মাঠ, রাস্তাঘাট, বীজতলা ও ফসলি ক্ষেত পানির নিচে তলিয়ে আছে। একই সঙ্গে মেঘনা নদীর অস্বাভাবিক জোয়ারে উপকূলের বিস্তীর্ণ জনপদ প্লাবিত হচ্ছে। জলাবদ্ধতা আর জোয়ারের পানিতে ডুবে থাকা এলাকাগুলোয় মাটির চুলায় রান্না বন্ধ হয়ে আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে পারছে না শিক্ষার্থীরা, বিপর্যয় বাড়ছে জনজীবনে। তবে জলাবদ্ধতার কারণ হিসাবে খাল দখলমুক্ত না হওয়া এবং উপকূল প্লাবিত হওয়ার সময় নদীতীর রক্ষা বাঁধ না থাকাকে দুষছেন স্থানীয়রা। মঙ্গলবার বিকালে লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ রোড, সমসেরাবাদ, লামচরীসহ কমলনগর উপজেলার চরমার্টিন, চরলরেন্স ও চরকালকিনির নাসিরগঞ্জ এলাকায় গিয়ে পানিবন্দি বাসিন্দাদের দুর্দশার চিত্র দেখা যায়। গতকাল বিকালে খোঁজ নিয়েও একই খবর পাওয়া গেছে।