ভারত নিয়ে তরুণ প্রজন্মোর মনোভাব ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি

তারিকুল ইসলাম: চতুর্দিক থেকে আমাদের দেশকে ঘিরে রাখা প্রতিবেশী দেশ বলেই নয়। বরং ভারত ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ক্রিকেটাঙ্গন ও আন্তর্জাতিক পরিসরের বিভিন্ন আয়োজনের জন্য এ দেশে আলোচিত ও সমালোচিত। ভারত বছরের পুরো সময়জুড়েই এ দেশের তরুণ প্রজšে§র কাছে কোনো না কোনোভাবে আলোচনার খোরাক জোগায়। বেশিরভাগ সময় সমালোচিত হয়েই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে।

আমাদের দেশে ভারত নিয়ে চিরাচরিত বয়ান হচ্ছেÑভারত আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র। তারা মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা না করলে আমরা কখনোই স্বাধীন হতে পারতাম না। এ দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতারা অকপটে তা বলে বেড়ান। এমনকি পাঠ্যপুস্তকেও ভারতকে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী ও বন্ধু দেশ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা সব সময় ভিন্ন কথা বলে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিল তৎকালীন ভূরাজনীতিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে ভারতের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক বিজয়। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে সবচেয়ে বড় সফলতা ও সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল শ্যাম মানেকশর যুদ্ধক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ জয়। কেননা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা পাকিস্তানের মানচিত্র বদলে দিয়েছিল; যা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের জন্য খুবই অবমাননাকর। তাছাড়া ভারতের দু’দিকে পাকিস্তানের কৌশলগত ভূখণ্ড ভেঙে গিয়েছিল। বরং সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশ অনুগত হওয়ায় কোনো রকম নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকল না ও কৌশলগতভাবে অনেক শক্তিশালী অবস্থান হলো ভারতের। তাই বলা যায়, ভারত মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব বাংলার যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে এদেশের উপকার করে তাদের স্বার্থও হাসিল করেছে। সুতরাং বাংলাদেশের স্বাধীনতা এদেশের রাজনীতিবিদ ও জনমানুষের যেমন অনেক বড় অর্জন ছিল, তেমনি ভারতেরও। বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধের শুরুটা এদেশের রাজনীতিবিদদের নেতৃত্ব এদেশের আপামর জনগণ শুরু করেছিল। আর ভারত শুধু এই যুদ্ধকে নিজেদের সুবিধাজনক একটা অস্ত্রে পরিণত করেছে। যার সুফল তারা আজীবন ভোগ করবে।

স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে এখন অবধি সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবসময় নিজেদের সুবিধার কথা ভেবেছে ভারত। সীমান্ত ও অভিন্ন নদী থেকে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেছে। বাংলাদেশের সরকার ও ভূখণ্ড ব্যবহার করে নানা সময় বিভিন্ন সুবিধা নেয়ার পাঁয়তারা করেছে। তাদের গোয়েন্দা বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে সবসময় এদেশের সরকার ও রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে আসছে। তাদের নতুন সংসদ ভবনে বাংলাদেশকে তাদের সম্প্রসারিত দেশের অংশ হিসেবে মানচিত্রে দেখিয়েছে। আমরা যেভাবে তাদের বন্ধুপ্রতিম দেশ বলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে পরিচয় করিয়ে দিই, সেভাবে বাংলাদেশেকে ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে কোনো উল্লেখযোগ্য সুবিধা দেয়নি ভারত। বরং আমাদের প্রয়োজনে সবসময় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে পানি বণ্টন চুক্তি। যাতে বাংলাদেশকে দুই দেশের অভিন্ন নদীগুলোর পানির ন্যায্যা হিস্যা দেয়ার কথা ভারতের। কিন্তু আজ অবধি বাংলাদেশ তা পায়নি। বরং দুই দেশের অভিন্ন আরও কয়েকটি নদীতে বাঁধ দিয়েছে ভারত। যার অন্যতম হচ্ছে টিপাইমুখ বাঁধ। যার ফলে অচিরেই সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে পানি স্বল্পতা দেখা দেবে।
পানি বণ্টন চুক্তির পর সবচেয়ে বেশি স্পর্শকাতর বিষয় হচ্ছে সীমান্ত হত্যা। প্রতিবছর সীমান্তে বিএসএফ একের পর এক হত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। যার কোনো সমাধান করছে না ভারত। এ বিষয়ে গত সপ্তাহে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রায়োর সঙ্গে আলোচনা করলে তিনি বলেন, ভারত এ বিষয়ে অনেক সচেতন থাকে। সীমান্ত হত্যা কখনও কাম্য নয়। সতর্কতার শেষ নেই। তবু কখনও কখনও বিএসএফ এমনভাবে আক্রান্ত হয় যে গুলি না চালিয়ে উপায় থাকে না। পররাষ্ট্র সচিবের বক্তব্যে বুঝায় যায়, তারা সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে কতটুকু প্রস্তুত। তারা তা কখনোই বন্ধ করবে না বরং এটা চালিয়ে রেখে এদেশের ওপর তাদের আধিপত্য বিস্তারের প্রক্রিয়া চালু রাখবে। এদেশের ভেতরে এসে বিএসএফ কৃষক, রাখালদের গুলি করে যাচ্ছে অথচ উনি বললেন বিএসএফ নাকি আক্রান্ত হয়।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারতকে দুঃসময়ে পাওয়া যায়। অথচ স্বাধীনতার পর ভারত বাংলাদেশের দুঃসময়ে থেকেছেÑএমন নজির পাওয়া কঠিন। বরং ভারত বাংলাদেশের জন্য দুঃসময় তৈরি করেছে। স্বাধীনতার পর মোংলা বন্দর নির্মাণাধীন থাকায় বাংলাদেশ সরকার কলকাতা বন্দর ব্যবহার করতে চাইলে ভারত তা নাকচ করে দেয়। বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থী। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের শর্তহীন ও নিরাপদ প্রত্যাবর্তন চায়। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক শক্তি, প্রতিবেশী বন্ধুপ্রতিম দেশ হিসেবে ভারতের সাহায্য চায় বাংলাদেশ। অথচ নিজেদের স্বার্থে ভারত এ বিষয়ে বাংলাদেশের স্বার্থের কোনো তোয়াক্কা করেনি বরং বিরোধিতা করে।

অতীতেও মিয়ানমারের সঙ্গে বিভিন্ন সংকট দেখা দিলে ভারত বন্ধুর মতো পাশে থাকেনি। ২০০৮ সালে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের কাছাকাছি মিয়ানমারের নৌবাহিনী ও বাংলাদেশের নৌবাহিনী মুখোমুখি হলেও, ভারত বাংলাদেশের পক্ষে কোনো সহযোগিতামূলক অবস্থান নেয়নি। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্রিকসে যোগ দিতে চেয়েছিল। ভারত অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দেশ হিসেবে কোনো সহযোগিতা করেনি বাংলাদেশকে।
দুঃসময়ে আমাদের পাশে না থেকে কীভাবে উল্টো আমাদের দুর্ভোগের কারণ হয়েছে তার বড় উদাহরণ গড্ডা চুক্তি। চুক্তি অনুযায়ী ভারতের আদানি পাওয়ারের থেকে তিনগুণ বেশি দাম দিয়ে বিদ্যুৎ কিনবে বাংলাদেশ এবং ২৫ বছর ধরে কোম্পানিটির করের বোঝা বহন করবে। বিদ্যুৎ না এলেও ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ দিতে হবে ১ হাজার ২১৯ কোটি টাকা (সূত্র: ডেইলি স্টার)। এটা করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিয়ে বাংলাদেশকে শোষণ করার চিত্র। ভারত আমাদের প্রতি তাদের সহযোগিতার হাত না বাড়ালেও আমরা কিন্তু দু’হাত ভরে ভারতকে সহযোগিতা করছি। স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন উপায়ে ভারতকে সহযোগিতা করে এসেছি।

ভারত আমাদের তিস্তার ন্যায্য পানির বণ্টন না দিলেও আমরা ঠিকই কুমিল্লার ফেনী নদী থেকে পানি নিতে দিচ্ছি। আমাদের বিভিন্ন সংকটকালে পণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দিলেও, আমরা ঠিকই নিজের দেশের প্রাকৃতিক গ্যাস দিচ্ছি। তাও দেশের মানুষের চাহিদা পূরণ না করেই। তাদের বন্দর আমাদের ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার করতে না দিলেও আমরা ঠিকই আমাদের দুই বৃহৎ বন্দর তাদের ব্যবহার করতে দিয়েছি নামমাত্র শুল্কে। তাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করে নেপাল, ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কে গড়ে তুলতে না দিলেও সম্প্রতি তাদের আমরা নিজেদের দেশের মধ্যে দিয়ে সড়ক, পানি ও রেলপথে চলাচলের সুবিধা দিয়েছি। যাতে করে তাদের যোগাযোগ অনেক দ্রুত হবে আগের চেয়ে। ত্রিপুরা ও মিজোরাম থেকে পশ্চিমবঙ্গে ৩২-৩৫ ঘণ্টার রেল যোগাযোগ আমাদের দেশের মধ্যে দিয়ে মাত্র ৭-৯ ঘণ্টায় হয়ে যাবে।

ভারত স্বাধীনতার পর থেকেই এমন করে আমাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে আবার উল্টোদিকে একপেশে সুবিধা ও সহযোগিতা নিচ্ছে। ভারতকে বন্ধু দেশ ও মুক্তিযুদ্ধের সাহায্যকারী দল বলে একপক্ষীয় সহযোগিতা দেয়ার ব্যপারকে কোনোভাবেই মেনে নিচ্ছে না এদেশের মানুষ বিশেষ করে তরুণ সমাজ। সম্প্রতি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতকে রেল যোগাযোগ সুবিধা প্রদান নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় বইছে গণমাধ্যমে। দেশের তরুণ সমাজসহ সর্বস্তরের জনগণ এই সিদ্ধান্তকে সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত বলে মন্তব্য করছে। এতে বুঝাই যাচ্ছে, দেশের মানুষের সরকারে সিদ্ধান্তে কোনো সমর্থন নেই।
ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিমরা নানাভাবে নির্যাতিত হওয়ায় এদেশের অধিকাংশ মানুষ ভারত সম্পর্কে ঘৃণ্য মনোভাব পোষণ করে। তরণ সমাজসহ সাধারণ জনগনের ভারতবিরোধী সভা, সমাবেশ, ভারতীয় পণ্য বয়কটের মতো কর্মসূচি পালন তারই বহিঃপ্রকাশ। সম্প্রতি প্রমাণ মিলেছে ফিলিস্তিনিদের হত্যায় ভারতের অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে; যা এদেশের মানুষদের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাবকে প্রভাবিত করেছে। তাছাড়া তরুণ প্রজšে§র মধ্যে ভারত বিরোধী মনোভাবের অন্যতম কারণ হচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলে ভারতের প্রভাব বিস্তার।

সব মিলিয়ে বলা যায়, সুবিধা ও সহযোগিতার অসম চিত্র, বিপদে বন্ধুর মতো আচরণ না করা, লোকসানমূলক প্রকল্পে বাংলাদেশকে চুক্তি করানো, নিজ দেশে ও বিদেশে মুসলিম বিদ্বেষী কার্যকলাপ ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রভাব কাটানো নিয়ে তরুণ সমাজ চরম ভারতবিরোধী মনোভাব পোষণ করছে; যা ভবিষ্যতে দেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে। বিরোধী দলগুলো ইতোমধ্যে জনগণের এ মনোভাবকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। এভাবে সব জায়গায় ভারতের প্রভাব বিস্তার হলে চরম জাতীয়তাবাদীদের উত্থান হতে পারে। এমনকি বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক সশস্ত্র ও রাজনৈতিক দলও প্রকাশ্যে আসতে পারে। মালদ্বীপের মতো ইন্ডিয়া আউট সেøাগান দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকে কাছে টানতে পারে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০