গাছ পরিবেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য গাছের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। গাছ মানুষের বন্ধু হিসেবে পরিগণিত হয়; যা আমাদের জন্য অক্সিজেন সরবরাহ ও কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে থাকে। একটি দেশের মোট ভূমির ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ঋঅঙ) ঞযব ঝঃধঃব ড়ভ ঃযব ডড়ৎষফ’ং ঋড়ৎবংঃং ২০২০-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের মোট ভূমির ৩০.৪ শতাংশ বনভূমি। বিশ্বের সমগ্র বনভূমির আয়তন হচ্ছে ৪.০৬ বিলিয়ন হেক্টর। গড়ে একটি গাছ প্রতি বছর প্রায় ২৬০ পাউন্ড অক্সিজেন উৎপাদন করে। দুটি পরিপক্ব গাছ চারজনের পরিবারের জন্য যথেষ্ট অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারে।
জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থান টিকিয়ে রাখার জন্য গাছের বেশ গুরুত্ব রয়েছে। অক্সিজেন সরবরাহ ছাড়াও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, বায়ুদূষণ থেকে পরিবেশকে রক্ষা, ভূমিধস রোধ, নদীর ভাঙন থেকে রক্ষা, বনায়ন সৃষ্টি, সূর্যের তাপ শোষণ ও বিভিন্ন পশুপাখির আবাসস্থল হিসেবেও গাছের গুরুত্ব অপরিসীম। তাছাড়া আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে গাছ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখছে। ফল, ফুল, কাঠ, অক্সিজেন, ছায়াÑএ সবকিছুই আমরা গাছ থেকে পাই।
তবে সব গাছই পরিবেশের জন্য সুফল বয়ে নিয়ে আসে না। অনেক গাছ রয়েছে যেগুলো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য নয় বরং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক গাছগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি গাছ হচ্ছে ইউক্যালিপটাস। এই গাছের বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে “ইউক্যালিপটাস ওবলিকোয়া, যা সাধারণত নিরক্ষীয় অঞ্চলে যেমন অস্ট্রেলিয়া, পাপুয়া নিউগিনি, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশে দেখা যায়। যদিও আবহাওয়াগত ও সহিষ্ণুতার কারণে প্রায় সব মহাদেশেই দেখা যায়।
একটি পূর্ণবয়স্ক ইউক্যালিপটাস গাছ সাধারণত ১৫০-১৮০ ফুট উচ্চতা অর্জন করে থাকে। সারাবিশ্বে প্রায় ৭০০ প্রজাতির ইউক্যালিপটাস গাছ রয়েছে। তবে অস্ট্রেলিয়ায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ইউক্যালিপটাস গাছ রূপণ করা হয় এবং তা থেকে প্রতি বছর প্রায় ২৫ কোটি মার্কিন ডলার আয় করা হয়। দ্রুতবর্ধনশীলতা এবং অভিযোজন ক্ষমতার কারণে এটি অনেক দেশেই কাঠের গাছ হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে এবং সারাবিশ্বে সমৃদ্ধি লাভ করেছে। এদের ফুল সৌন্দর্য বৃদ্ধি ছাড়াও বেশ মধু প্রস্তুতের ক্ষেত্রেও কাজে লাগে। বেশ কিছু ইউক্যালিপ্টাসের প্রজাতিতে গাম নিঃসর্গের কারণে এদের এঁস ঞৎবব হিসেবে অভিহিত করা হয়। ইউক্যালিপটাস গাছ থেকে কিনব, ট্যানিন ও তৈল উৎপাদন করা হয়। তাছাড়া এই গাছ থেকে বিশেষ এক ধরনের তৈল উৎপাদন করা হয়; যা অ্যান্টিসেপটিক, পরিষ্কারক ও মশা নিধনের জন্য ও ব্যবহার করা হয়। কাঠ হিসেবেও এ গাছের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ইউক্যালিপটাস গাছের আশপাশের প্রায় ১০ ফুট থেকে ৫০ ফুট গভীর পর্যন্ত পানি শোষণ করে নেয় এবং তা বাষ্পাকারে আকাশে উঠে যায়। অবিরত ভূগর্ভস্থ পানি শোষণের ফলে আশপাশে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। এছাড়া এইব গাছটির কাঠের গুণাগুণ তেমন মানসম্মত নয়। পানি শোষণের ফলে চারপাশে শুষ্কতা দেখা যায়। যার ফলে সেখানের মাটির উর্বরতা কমে যায়। এই প্রজাতির গাছগুলো মাটিকে শুষ্ক করার ফলে মাটিতে অবস্থিত মিনারেলগুলো আয়ন অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসে। ফলে দেশীয় গাছের বাঁচার ক্ষমতা কমে যায়। কারণ দেশীয় যে গাছগুলো আমরা দেখি সেগুলো মাটির মিনারেলগুলোকে আয়ন হিসাবে গ্রহণ করে। ইউক্যালিপটাস গাছের পাতাও বিষাক্ত ধরনের। যার ফলে এই গাছের নিচে অন্য কোনো গাছ জš§াতে পারে না। এই ইউক্যালিপটাসের কোনো প্রজাতিই তুষারপাত সহ্য করতে পারে না। এটা উষ্ণমণ্ডলীয় এবং উষ্ণ উভয় প্রকারের জলবায়ুর প্রদেশে বেঁচে থাকতে সক্ষম। গাছ থেকে পাতা ও ফুল ঝড়ার ফলে আশপাশের জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে যায় এবং মানুষের শ্বাসকষ্টের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।
বাংলাদেশে ঊঁপধষুঢ়ঃঁং পরঃৎরড়ফড়ৎধ প্রজাতিটি ১৯৬০ সাল থেকে মূলত পথতরু হিসেবে রোপিত হচ্ছে । বনবিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত আশির দশকে সরকারিভাবে ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি ও পাইনের মতো বিদেশি গাছগুলো বাংলাদেশে আনা হয় এবং বিনামূল্যে বিতরণও করা হয় নানা প্রজেক্টের আওতায়। ২০০৮ সালে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ইউক্যালিপটাসের চারা উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় এবং পরবর্তীতে বনবিভাগও এর উৎপাদন বন্ধ করার নীতি গ্রহণ করে।
বাংলাদেশে ইউক্যালিপটাস গাছ রূপণ নিষিদ্ধ করা হলেও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এখনও এই প্রজাতির গাছ রূপন করা হচ্ছে। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এর প্রাদুর্ভাব লক্ষণীয়। আমাদের উচিত এসব প্রজাতির গাছ না রূপণ করে পরিবেশবান্ধব গাছ রূপন করা। ফসল এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংসকারী ইউক্যালিপটাস গাছের কুফল সম্পর্কে জনসচেতনতা জাগ্রত করতে হবে।
ওমর ফারুক
শিক্ষার্থী, রাজনীতি বিজ্ঞান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়