## উদ্যোক্তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ
সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: নভেল করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট কভিড-১৯ রোগের বিস্তার ঠেকাতে বিশ্বব্যাপী বন্ধ রাখা হয় সব ধরনের বাণিজ্যিক ও শিল্পের গতিশীলতা। একইভাবে গত দুই সপ্তাহ বাংলাদেশে চলছে লকডাউন। এর প্রভাবে চট্টগ্রাম বন্দরে জটে পড়েছে প্রায় ৪৫ হাজার কনটেইনার। আর বহির্নোঙরে অলস পড়ে আছে ৪৩টি জাহাজ। অপরদিকে কাঁচামাল, শ্রমিক, পরিবহন ও শিল্পপণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় এতে বন্ধ হচ্ছে বড় ও ভারী শিল্প-কারখানা। এতে প্রতিদিন বাড়ছে লোকসান ও ব্যবসায়িক ব্যয়। আর চলমান এ সংকট ও পরিস্থিতি দ্রুত সময়ে স্বাভাবিক না হলে দীর্ঘ মেয়াদে সংকটে পড়বে এ খাতে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের শিল্পোদ্যোক্তারা।
দেশের বড় শিল্প-কারখানা ও উদ্যোক্তারা বলেন, বিশ্বব্যাপী করোনার আক্রমণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো শিল্প খাত। যার ব্যতিক্রম নয় বাংলাদেশও। গত ডিসেম্বর থেকে চীনের উহান প্রদেশে এ ভাইরাসের উৎপত্তি। এরপর চীনের সঙ্গে সব দেশের বাণিজ্যিক লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আস্তে আস্তে ইউরোপ, আমেরিকাসহ পৃথিবীময় ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। ফলে কার্যত ভেঙে পড়ে শিল্পোৎপাদনের ‘সাপ্লাই চেইন’ ব্যবস্থা। ফলে বিভিন্ন স্থান থেকে শিল্প-কারখানার কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট রোগের বিস্তার ঠেকাতে গত দুই সপ্তাহ বাংলাদেশে চলছে লকডাউন পরিস্থিতি। এর প্রভাবে কাঁচামাল, শ্রমিক, পরিবহন ও শিল্পপণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় একে একে বন্ধ হচ্ছে বড় ও ভারী শিল্প-কারখানা। এর মধ্যে চট্টগ্রামে সব ধরনের শিপইয়ার্ড, শিপব্রেকিং ইয়ার্ড, বেশকিছু রোলিং মিলস, সিমেন্ট মিলস, পেপার মিল ও লবণমিল বন্ধ হয়ে পড়েছে। এতে প্রতিদিন বাড়ছে লোকসান ও ব্যবসায়িক ব্যয়। আর চলমান সংকট দ্রুত সময়ে স্বাভাবিক না হলে দীর্ঘ মেয়াদে সংকটে পড়তে হবে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের শিল্পোদ্যোক্তারা।
অপরদিকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিবহন শাখা সূত্রে জানা যায়, আজ (৮ এপ্রিল) সাড়ে ১১টায় চট্টগ্রাম বন্দরে বিভিন্ন জেটি, বিশেষ বার্থ ও বহির্নোঙরে ১০৩টি পণ্যবাহী জাহাজ ছিল। এর মধ্য থেকে ৬০টি ফিডার ভেসেল থেকে কার্গো, কনটেইনার ও অন্যান্য পণ্যদ্রব্য খালাস হয়। আর ৪৩টি পণ্যবাহী জাহাজ থেকে কোনো কিছুই খালাস হয়নি। একই দিনে বন্দরের ইয়ার্ডে মোট কনটেইনার ছিল ৪৪ হাজার ৮৩৬টি। মোট কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছিল তিন হাজার ৪৩৪টি।
অন্যদিকে গত ২৩ মার্চ ১১টায় চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন জেটি, বিশেষ বার্থ ও আউটারে ৬১ জাহাজ থেকে কার্গো, কনটেইনার ও অন্যান্য পণ্য খালাস করা হয়েছিল। আর ১৮ জাহাজ থেকে কার্গো ও কনটেইনার খালাস হয়নি। একই সময় বন্দর ইয়ার্ডে মোট কনটেইনার ছিল ৩৩ হাজার ১২০ টিইইউএস। আমদানি-রপ্তানিবাহী জাহাজে মোট কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছিল ছয় হাজার ৪৩৮ টিইইউএস। একই সময় বন্দর থেকে কনটেইনার ডেলিভারি হয়েছিল দুই হাজার ৭৬৫ টিইইউএস বা একক কনটেইনার।
বন্দর-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের আমদানি-রফতানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে চালু ছিল চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালন। এ সময় বন্দরের জেটিতে পণ্যবাহী জাহাজ থেকে পণ্য ওঠানামা স্বাভাবিক থাকলেও বন্দর ইয়ার্ড থেকে কনটেইনার ডেলিভারি অস্বাভাবিকভাবে কমছে। এ কদিনে ইয়ার্ডে ধারণক্ষমতার কাছাকাছি কনটেইনার জমেছে। এতে নতুন করে জাহাজের বার্থিং দিতে সমস্যা হচ্ছে। ফলে বাড়ছে অপেক্ষমাণ জাহাজের সময়।
গত পয়লা এপ্রিল বহির্নোঙরে ২৬টি জাহাজ অপেক্ষমাণ ছিল। আর গতকাল ছিল ৪৬টি; অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ জাহাজ পণ্য খালাসের অপেক্ষায় আছে। এর মধ্যে ২০টি কনটেইনারবাহী, ১১টি তেলবাহী ও সাতটি ক্লিংকারবাহী জাহাজ আছে। এদিকে আগামী ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে সাধারণ ছুটির মেয়াদ। এতে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বন্দরের পরিচালন কার্যক্রমে। ফলে শিল্প ও ভোগ্যপণ্যের বাজারে কিছুটা অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।
দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগ্রুপ মোস্তফা হাকিম। এ গ্রুপের আওতায় আছে ইস্পাত কারখানা, সিমেন্ট মিলস ও জাহাজ কাটার একাধিক ইয়ার্ড। এ গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ সরওয়ার আলম শেয়ার বিজকে বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কাঁচামাল সংকটের কারণে আমাদের স্টিল মিল বন্ধ রাখা হয়েছে। যদিও গত কদিন ধরে সীমিত আকারে উৎপাদন চালু ছিল। এখন তো সারা বিশ্বেই লকডাউন চলছে। আজ থেকে পুরোপুরি বন্ধ উৎপাদন।
এ ছাড়া চাহিদা না থাকায় আমাদের শিপব্রেকিং ইয়ার্ড ও সিমেন্ট মিল বন্ধ আছে। অথচ শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন দিতে হবে। আর সামনে রমজান। কবে এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলা যাচ্ছে না। এর মধ্যে ডলারের দাম বাড়ছে। তিন সপ্তাহ আগে ডলারের রেট ৮৫ টাকা ২০ পয়সা থেকে ২৫ পয়সা দিয়েছি। গতকাল দিয়েছি ৮৬ টাকা। ব্যাংকগুলো বলছে আরও বাড়বে। তিনি আরও বলেন, চলমান শিল্প খাতের সংকট নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা অবশ্যই ভালো এক উদ্যোগ। আশা করি শিল্পের গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রণোদনা বাস্তবায়ন হবে।
অ্যাসোসিয়েশন অব এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড অব শিপবিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রিজ অব বাংলাদেশের (এইওএসআইবি) সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, বর্তমান করোনা পরিস্থিতির কারণে আমাদের জাহাজ নির্মাণ খাতে অস্থায়ী এক লাখ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। বেকার বসে থাকা স্থায়ী শ্রমিকের বেতন, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল, ব্যাংক ঋণের সুদসহ অন্যান্য খরচ বাবদ প্রতিদিন ১০ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে।
এর মধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে সম্ভাব্য ২০০ মিলিয়ন ডলার অর্ডারের ব্যবসা হাতছাড়া হবে। তাদেরও তো অবস্থা খারাপ। এছাড়া জাহাজ নির্মাণের জন্য যেসব কাঁচামাল প্রয়োজন, তার প্রায় ৫০ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। সব মিলিয়ে জাহাজ নির্মাণশিল্প চরম সংকটে পড়বে। হয়তো প্রাথমিকভাবে আমাদের ১০ হাজার কোটি টাকা লোকসান হবে। আর করোনার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় পরে সঠিত ক্ষতির হিসাব করা যাবে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ও মুখপাত্র ওমর ফারুক শেয়ার বিজকে বলেন, করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশব্যাপী লকডাউন চলছে। চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজ, কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিং স্বাভাবিক আছে। তবে বন্দর ব্যবহারকারীরা বন্দর থেকে কনটেইনার ডেলিভারি নিচ্ছেন না। ফলে ধারণক্ষমতার কাছাকাছি কনটেইনার জমেছে। এতে নতুন করে জাহাজের বার্থিং দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে; জাহাজের অপেক্ষমাণ সময়ও বাড়ছে। আর নতুন করে জাহাজে শিডিউল দেওয়া হচ্ছে না। ফলে অনেক কনটেইনারবাহী জাহাজ খালাসের অপেক্ষায় আছে। এর মধ্যে দ্রুত ডেলিভারি নেওয়ার জন্য আমরা স্টোর রেন্ট মওকুফ করেছি। আর পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা আরও কিছু চিন্তা-ভাবনা করছি।
উল্লেখ্য, চলমান করোনার কারণে শিল্প খাতে প্রধানমন্ত্রী ৭২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে ব্যাংকগুলো নিজেদের সম্পদ থেকে শিল্প ও সেবা খাতে ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করবে। ৯ শতাংশ সুদে বিতরণকৃত টাকার চার দশমিক পাঁচ শতাংশ সুদ দেবে উপকারভোগী, বাকি অংশ দেবে সরকার। আর ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার আরেকটি ঋণ সুবিধা দেওয়া হবে। এ ঋণের সুদহারও ৯ শতাংশ। তবে চার শতাংশ দেবে উদ্যোক্তারা, বাকি পাঁচ শতাংশ দেবে সরকার।