ভাষাগত ঔপনিবেশিকতায় রণদার সরল সমর্পণ

অনাথ শিশুর মতো যার জীবনখানি নিস্তরঙ্গে নিথর হতে পারতো নিযুত জীবনের নিঠুর নিয়তিপাশে তিনি জুগিয়েছেন হৃৎস্পন্দনের খোরাক। দেশের জন্য লড়েছেন। শূন্য জমিনে গড়েছেন ব্যবসায় কাঠামো। জীবনের সব অর্জন লিখে দিয়েছেন মানুষের নামে। তিনিই দেশের সবচেয়ে সফল ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’-এর জনক রণদা প্রসাদ সাহা। নারীশিক্ষা ও চিকিৎসায় নারী-পুরুষ কিংবা ধনী-গরিবের ভেদ ভেঙেছেন। তার জীবনেই রয়েছে সসীমকে ডিঙিয়ে অসীমে শক্তি সঞ্চারের কথামালা। এ জীবন ও কেতন যেন রোমাঞ্চিত হৃদয়েরই উদ্দীপ্ত প্রেরণা।  পর্ব-১৯

মিজানুর রহমান শেলী: সকালের মিষ্টি রবিরশ্মিতে রণার নিদ্রাচ্ছন্ন নয়ন হয়তো কখনও ঝলসে যায়নি। ভোরের দিগন্ত যখন সাদারেখার ধারে আঁধার কেটে ছড়িয়ে পড়তে চায়, তখনই শিয়ালদহের স্টেশনে রেলগাড়ি ভেঁপু বাজিয়ে দাপিয়ে ওঠে। প্রান্ত থেকে সীমান্ত ছুটে চলা ব্যস্ত মানুষের দাপাদাপিতে রণারও ঘুম ভাঙে। চোখ কচলেই উঠে পড়া। কোনোমতো শতছিন্ন কাপড়খানি কোমরবন্দি হলেই হলো। স্থির-চঞ্চল চাহনি, আলুথালু চুল, ধুলো-ধূসর ঘামাঙ্কিত পীত চিটে গতরখানিতে শুধুই ছুটে চলা অবাক মানুষের ভিড়ে, শহরের অলিগলি, রাজপথে। ছোট-বড় মেঘ, ঝলমলে গুচ্ছ গুচ্ছ রোদ ঠিক তারই সঙ্গে লেগে থাকা আড়ালে আড়ালে কিরণ তিরোহিত ছায়া। এই আকাশচুম্বী অট্টালিকার ধারেই নুয়ে পড়া কুঁড়েঘর আর্থিক শ্রেণি-কাঠামোর লেখচিত্রের মতো ছড়িয়ে পড়ে। বড় ঘরের বড় ছায়া, ছোট ঘরের ছোট। ছোট্ট রণাও একটি ছায়া নিয়ে দৌড়ে চলে: শিয়ালদহ থেকে হুগলির প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পথ। আবার এন্টালি, কখনও টালিগঞ্জ, ভবানীপুর, কালিঘাট। ছুটে চলে ভোরের আলোয় পত্রিকা নিয়ে। আবার কখনও শিয়ালদহ স্টেশন থেকে, কখনও হুগলি বন্দর থেকে কয়লা কুড়িয়ে ঘরে ঘরে হাঁক দেয় রণা। ছোট ছোট জলাধারের স্বচ্ছ কাচের মতো জলসেটে সাদা-কালো মেঘের সঙ্গম। আহা! অলৌকিকের সঙ্গে লৌকিকের আঁতাত। সতত স্বচ্ছ মন; এ যেন মৃণয় ছেড়ে হামেশা অনুভ‚তির রথে চড়ে অসীমে ঔদার্য প্রমোদ।
রণদার এই কলকাতা জীবনে কোনো শিক্ষক ছিল না, ছিল না কোনো অভিভাবক। তবু সততা, স্বচ্ছতা, শ্রদ্ধা আর অধ্যবসায় তার হিয়ার মাঝে শক্ত করে এঁটে বসে। অনুভূতিই ছিল কলকাতায় তার প্রথম পাঠশালা। এভাবেই তিনি চলছিলেন সামনের পথে।
ইংরেজি শেখার পরে, এই আত্মশক্তি এবার কাজে লাগানোর নেশায় তিনি উদ্দিষ্ট হলেন। সবসময় ইংরেজদের কাছে যাওয়ার ছুতো খুঁজতেন। চেষ্টা ছিল নিরন্তর। ইংরেজরা ইংরেজি জানা শিক্ষিত লোকের সন্ধান পেত, কিন্তু শ্রমিক শ্রেণির মাঝে কাউকে ইংরেজি জানা লোক পেত না। সেখানে রণদা তখন দিনমজুর বা শ্রমিক শ্রেণির লোক, আবার ইংরেজি জানা কিশোর।

রণদার তখন বয়স তের কিংবা চৌদ্দ। আনুমানিক ১৯১০ সালের কথা। একদিন এক ইংরেজ তার গাড়ি নিয়ে লনে অপেক্ষা করছেন। ব্রিটিশ উপনিবেশিক ভারতের এ সময় ব্রক সোয়ান কার, ডি ডিওন বৌটন, রয়েল-রচে, ব্রেইজার, কার্ভড ড্যাশ ওল্ডসমোবাইল গাড়িগুলো ধনিক শ্রেণির লোকেরা ব্যবহার করতেন। ইংরেজ লোকটি বড় কোম্পানিতে কাজ করা টাকাওয়ালা শ্বেতাঙ্গ। সোয়ান রয়েল-রচে গাড়িই বেশি জনপ্রিয় ছিল তখন। ধারণা করা যায়, এরকম কোনো গাড়িতে ইংরেজ লোকটি চড়ে ছিলেন। রণদা সেদিকেই ঘুর ঘুর করছিলেন টোকায় বা পথশিশুদের মতো। হঠাৎ দেখতে পান সাহেবের ওই গাড়ি থামানো। কলকাতার রাস্তা তখন কংক্রিট কিংবা মেঠো পথ; সব রকমই ছিল। ফলে গ্রীষ্মকালে ধুলো হতো। বিশেষ করে ইঞ্জিনচালিত গাড়িতে একটু বেশিই ধুলো জমতো।

ডি ডিওন বৌটন ব্র্যান্ডের গাড়িটি বোম্বেতে এক স্কটিশ আমদানি করেছিলেন ব্যবহারের জন্য। তা দেখে মহিশুর পরিবারের কেউ একজন আমদানি করেন। তারপর থেকে সে গাড়ি ব্যবহারের চল শুরু হয়। তবে এই ডি ডিওন বৌটন গাড়িতে কোনো কাচে ঘেরা প্রকোষ্ঠ ছিল না। ফলে তার ধুলা মোছার প্রয়োজন পড়ে না। ব্রক সোয়ান কিংবা রয়েল রচে গাড়ি ছিল কাচের জানালা। যাহোক, রণদা ভাবলেন সাহেবের ওই কাচে ঘেরা গাড়ির ময়লা পরিষ্কার করে দিলে কিছু পয়সা-পাতি আয় করা যাবে। আবার ইংরেজ সাহেবের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলাও হবে। পরিচয়টাও হয়ে যেতে পারে।

সাহেবের গাড়িটি পরিষ্কার করার অনুমতি প্রার্থনা করলেন রণদা। সাহেব কিশোর বালকটির দিকে তাকিয়ে আট-দশটি টোকাই ছেলে-পুলের মতোই তাকে ভাবলেন। অনুমতিও দিলেন। তবে দৈনিকের মতো খুব পেশাদারি আচরণ দেখালেন। পারিশ্রমিক হিসেবে সাহেব তাকে এক পয়সা দেবে। সাফ জানিয়ে দিলেন।

রণদা কাজ পেয়ে খুব খুশি। মন দিয়ে কাজ করছিলেন। ইংরেজি জানার কারণে রণদার সঙ্গে কাজের সময় কথা বলতে সাহেব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এমনকি তার ইচ্ছেমতো রণদাকে কাজের ফরমায়েশও মাঝে মাঝে বলে দিতে পারছিলেন। রণদাও সততা আর বিনয় নম্রতার সঙ্গে কাজ করলেন। ভালো করে গাড়ির ময়লা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে দিলেন। ফলে সাহেব তার মনের মতো কাজ পেয়ে খুশি হয়ে গেলেন। সাহেব খুশি হয়ে তার কাজের প্রশংসা করলেন। সাধারণত ভাষাগত কারণে ইংরেজরা শ্রমিকদের সঙ্গে মনের ভালো কিংবা খারাপ অনুভ‚তিগুলো ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারতেন না। তাই চাহিদামতো কাজও পেতেন না। কার্যত, ভাষা জাতীয়তাবাদের উপলক্ষ হলেও সাম্র্রাজ্যবাদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।
লিঙ্গুইস্টিক ইম্পেরিয়ালিজম বা ভাষাগত উপনিবেশ ধারণার ভেতর দিয়ে বিষয়টিকে ব্যবচ্ছেদ করা চলে। ইউরোপীয় উপনিবেশের ভেতর দিয়ে ব্রিটেন পৃথিবীব্যাপী জ্ঞান-ক্ষমতার চর্চা শুরু করেছিল। তার ভেতর ভাষা ছিল প্রধান এক অনুষঙ্গ। রবার্ট ফিলিপসন তার লিঙ্গুইস্টিক ইম্পেরিয়ালিজম বইতে ইংরেজি ভাষার উপনিবেশবাদ নিয়ে লিখেছেন, ‘ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার মধ্যে কাঠামোগত ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য প্রতিষ্ঠার পর নব্য প্রতিষ্ঠিত কাঠামো ও ক্রমাগত পুনর্গঠন দ্বারা আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তা বজায় থাকে।’ এখানে কাঠামো বলতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও আর্থিক বরাদ্দের মতো নানারকম বস্তুগত বিষয়-আশয়কে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আর সাংস্কৃতিক বিষয়াদি বলতে বিভিন্ন অবস্তুগত ধারণাকে বোঝানো হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আচার-আচরণ ও প্যাডাগগিক প্রিন্সিপাল (শিক্ষাগত মূলনীতি)। এই ইংরেজি ভাষার লিঙ্গুইস্টিক ইম্পেরিয়ালিজম হলো লিঙ্গুইসিজম বা ভাষাবাদের একটি উদাহরণ। ১৯৮০ সালে ভাষাবিদ স্কুটিনবব-কাঁগাস লিঙ্গুইসিজমকে সংজ্ঞায়িত করেন। তিনি বলেন, লিঙ্গুইসিজম হলো ‘বিশেষ কিছু মতাদর্শ ও কাঠামো, যা ক্ষমতার অসম বিভাজনকে বৈধতা দেয়, প্রতিষ্ঠা বা ব্যবহার করে এবং প্রয়োজনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে থাকে।’
ইউরোপের প্রাচ্যবাদী দৃষ্টিতে ছিল জ্ঞানের সঙ্গে ক্ষমতা, বিদ্যার সঙ্গে রাজনীতি, পাণ্ডিত্যের সঙ্গে প্রভুত্ব। এ দৃষ্টিতেই ব্রিটিশরা প্রাচ্যকে দেখেছিল; তবে প্রাচ্যের চোখে নয় বরং নিজেদের চোখে। তার মাত্রা এমন ছিল, যে কোনো প্রাচ্যভ্রমণকারী পর্যটককে তারা অরিয়েন্টালিস্ট বলে ডাকত। তার মানে, যে ব্যক্তি প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ঘোরাঘুরি করেছেন তিনিই প্রাচ্যতাত্তি¡ক। তিনি প্রাচ্যের জ্ঞান ও তথ্য ইউরোপে উগরে দেবেন। সেই জ্ঞান থেকে তারা প্রাচ্যকে শাসন করবে। কার্যত, সাম্রাজ্যবিস্তার আর উপনিবেশিকায়নের প্রয়োজনে ইউরোপে বেতনভুক্ত অরিয়েস্টালিস্ট দেখা যায়। প্রাচ্যচর্চা তাই বিধিবিদ্ধ, সরকারি অনুদানভুক্ত ও প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে ওঠে। এর ফলে নৃবিজ্ঞান সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে গাঁট বাঁধলো।

অরিয়েন্টালিজমও সাম্রাজ্যবাদের একটি প্রকল্পে পরিণত হলো। প্রাচ্যতত্তে¡র বিকাশও ঘটতে থাকে ভারতজুড়ে; এমনকি বাংলায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। তার মধ্যে রয়েছে ‘সোসাইটি এশিয়াটিক’ (১৮২৩), ‘আমেরিকান অরিয়েন্টাল সোসাইটি’ (১৮৪২)। মজার ব্যাপার হলো, এই দুটো প্রতিষ্ঠান ভারত নিয়ে চর্চা শুরু করে উনিশ শতকে। কিন্তু তারও বহু আগেই এই চর্চা শুরু হয়েছিল বাংলা নিয়ে। কেননা ১৭৮৪ সালে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ‘দি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল’। স্যার উইলিয়াম জোনসের এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ‘ইন্ডোলজিক্যাল স্টাডিজ’ বা ভারতচর্চা। এরা ভারতের অতীত ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, পাণ্ডুলিপি, মুদ্রা ও মনুমেন্টের মাধ্যমে ভারতকে অনুধাবন করেন। সন্দেহ নেই তারাই প্রথম ‘শকুন্তলা’ ও ‘ঋগবেদ’ আবিষ্কার করেন।

প্রসঙ্গক্রমে এখানে আরও একটু পেছনের ইতিহাসে হাঁটতে হয়। ১৪৯৪ সালে রোমে ভারত সম্পর্কে জিওলিয়ানো দাতির একটি প্যাম্পলেট প্রকাশিত হয়। এরপরে ইউরোপজুড়ে ভারত নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়েছিল। তার চার বছর পরে ভাস্কো দা গামা ভারত আসেন। ভাস্কো দা গামার ভারত সফরের পরে ইউরোপের ভুল ভাঙে। আগে তারা এই অঞ্চলকে এক অদ্ভুত জায়গা মনে করত। কিন্তু ভাস্কো দা গামা দেখালেন না, এটা কোনো অদ্ভুত জায়গা নয়। এখানে বাস্তব মানুষের বসবাস, অফুরন্ত সম্পদ, এর নিসর্গ ও প্রতিবেশ বৈচিত্র্যময়। এর ভেতরে কোনো অবাস্তবতা নেই। এরপর থেকে বহু ইউরোপিয়ান এ দেশে এসেছেন। শুরু হলো ভারত দখলের বাসনা। লেখালেখির প্রাচুর্য ছড়িয়ে পড়ল ভারত নিয়ে। পর্তুগিজ, ডাচ, ডেনিশ, ফরাসি ও ইংরেজরাই এ লেখালেখিতে এগিয়ে ছিলেন। প্রথম পর্তুগিজ টম পিয়ার্স ১৫১৫ সালে লেখেন ‘সুমা অরিয়েন্তাল’। জরুরি ও গোপনীয় তথ্য থাকায় তা বহুদিন পরে প্রকাশ পায়। তিন বছর পরে দুরাট বারবোসার বই প্রকাশ পায়; গাসপার কোরিয়া চার খণ্ডে বহু বিষয় নিয়ে ১৫৫০ সালে লেখেন ‘দ্য ল্যান্ড অব ইন্ডিয়া’; পর্তুগিজদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় বই ‘হিস্ট্রি অব দি ডিসকভারি অ্যান্ড কনকোয়েস্ট অব ইন্ডিয়া বাই দি পর্তুগিজ’ লেখেন ফার্নাও লোপেস। জনপ্রিয়তার পারদে তা ফরাসি (১৫৫৩), স্পেনীয় (১৫৫৪), ইতালীয় (১৫৫৬) ও ইংরেজি (১৫৮২) ভাষায় অনূদিত হয়ে গেল মহাসমারোহে। অনেক ডাচও লিখেছেন। আবার ফরাসিরা ভারতের বিভিন্ন বিষয়ে সেকেন্ডারি অ্যানালাইসিস করেছেন। ডেনিশরাও চেষ্টা করেছেন।

কিন্তু ব্রিটিশরা এসেছে সবার পরে। ফলে ভারতের সঙ্গে তাদের বোঝাপড়া ছিল অনেক গভীর ও নিগুঢ়। তাই ভারতের রঙ্গমঞ্চে সব ইউরোপীয় শক্তি পরাজিত হলেও, ব্রিটেনের জয় হলো। কারণ ব্রিটিশরাই ভারতের সঙ্গে জ্ঞান, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি সব দিক দিয়ে জড়িয়ে পড়ে। অন্যরা পারেনি। ব্রিটিশ পণ্ডিত, ঐতিহাসিক ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে বিচিত্র উদ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে বই-পুস্তক, দলিল-দস্তাবেজ, জরিপ তৈরি হয়। রবার্ট ওরম, রিচার্ড জোসেফ সুলিভানের পর্যটকেরা প্রথমে ভারতের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা, সংস্কৃতি নিয়ে খুব বেশি আগ্রহী ছিলেন না। তারা কেবল এখানকার রাজনীতি আর বাণিজ্য নিয়ে অনুসন্ধিৎসু ছিলেন। তবে তাদের লেখনীতে তারা একটি নতুন, অদ্ভুত দেশ আবিষ্কারের কথা গর্ব করে বৃহৎ পরিসরে বর্ণনা করেছেন। তাদের বর্ণনায় মুখ্য চিন্তা ছিল ভারত ইংল্যান্ডের তুলনায় আদিম, অমার্জিত ও অনুন্নত। তাই ইংল্যান্ডই পারে এই দেশের জ্ঞান, অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ে কাজ করতে।

ফলে প্রাচ্যতাত্তি¡কেরা বাংলা নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন ১৭৮৪ সালে ‘দি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল’র মাধ্যমে। এই প্রাচ্যতাত্তি¡কেরা প্রাচ্যকে কোনোভাবেই বাস্তব ভাবতে পারলেন না। তারা কেবল এটাকে ‘রোমান্টিকতা’র জ্বরে আক্রান্ত করলেন। রোমান্টিকতার নামে আড়াল করেছেন, সরলীকরণ করেছেন, মিস্টিফাই করেছেন। এটা করতে গিয়ে তারা কেবল ‘শকুন্তলা’, যেন্দাবেস্তা ও উপনিষদ দ্বারা শিহরিত হয়েছেন, আচ্ছন্ন হয়েছেন, শীৎকার আর এডিকশনের বিবরণ দিয়েছেন। কিন্তু এই ‘রোমান্টিক ভারতবর্ষে’র আড়ালে যে অর্থনৈতিক, প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি রয়েছে; তাকে ঘিরে লুটেরাদের লোলুপতা আর আগ্রাসন হয়েছে, সে বিষয়টি তাদের চোখে পড়েনি। এডওয়ার্ড সাঈদের ‘অরিয়েন্টালিজম’ এক্ষেত্রে এক মাইলফলক।

উপনিবেশ বা সাম্রাজ্যবাদের এই কালে ইংরেজি ভাষা বাংলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অস্ত্রের জোরে আরোপিত হয়। একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল উপনিবেশিক স্বার্থ সন্ধান এবং ইউরোপীয় বাজারকে আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ করে তোলা। আর বাংলায় এই ভাষাগত আগ্রাসনকে ১৯৯২ সালে ফিলিপসন লিঙ্গুইস্টিক ইমপেরিয়ালিজম বলেছেন।

সেই প্রমত্ত উপনিবেশিক বাজারে রণার মতো এক কিশোর কোনটা বেছে নেবেন? যার পেট ও পিঠের দায়ে অহর্নিশি ছুটে চলতে হয়। তিনি স্বভাবতই ইংরেজির এই ঔপনিবেশিক ফাঁদে পা দেবেন সেটাই স্বাভাবিক। অধিকন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামমোহন রায়ের মতো পণ্ডিতরাও এই পথে হেঁটেছেন। প্রসঙ্গত, ঔপনিবেশিক কৌশল এ রীতিই মেনে চলে। বাংলাও যদি নতুন কোনো ভাষাগোষ্ঠী পরিচালনা করতে যেত তবে তাদেরও ভাষাগত বাধা অতিক্রম করতে হতো। এই কাজটি পাকিস্তানও করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু বাংলার মানুষ ১৯৫২ সালে মেনে নেননি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সেদিন বাংলার কোনো আন্দোলন হালে পানি পায়নি। সেখানে রণদার জন্য এ পথই ছিল সরল পথ।

রাইজারস তামারা তার ‘ল্যাঙ্গুয়েজ ইম্পেরিয়ালিজম ইন দ্য ইন্ডিয়ান এডুকেশন সিস্টেম; লিঙ্গুয়েস্টিক মানোরিটিজ অ্যান্ড দ্য রোল অব ইংলিশ’ বইতে লেখেন, ভারতের মতো বহুভাষার একটি দেশ ভাষার প্যারাডক্সিক্যাল প্রকৃতি দেখে অভ্যস্ত। একদিক থেকে বিচার করলে ব্রিটেনের এই লিঙ্গুইস্টিক ইম্পেরিয়ালজমকে প্রগতির ভাষা বলা চলে। আবার আরেকভাবে বললে বলতে হয়, এটা হলো আঞ্চলিক ভাষার পরিপ্রেক্ষিতে ‘ভাষার হন্তারক’।
যাহোক, রণদা হয়তো অবচেতনভাবেই এটাকে প্রগতির ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ফলে শ্বেতাঙ্গ সাহেবের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলতে বলতে তার চাহিদামাফিক কাজ করে দেওয়ায় শ্বেতাঙ্গ সাহেব বেশ খুশি হয়ে বাড়তি এক পয়সা বখশিশ দিতে চাইলেন। রণদা সে বখশিশ নিলেন না। সাহেব ভড়কে গেলেন। এই ছোট বালকের এটা কি আত্মসম্মানবোধ নাকি বোকামি। নাকি ছেলেমানুষী বা খেয়ালি। তখন সাহেব বললেন, তুমি তো তোমার চুক্তির চেয়ে বেশি কাজ করেছ। আর ভালো কাজ করেছ বলেই তো আমি তোমায় অতিরিক্ত পারিশ্রমিক দিচ্ছি। এটা তো তোমার প্রাপ্য। নাও।

রণদা বললেন, কথা ছিল এক পয়সা। এক পয়সাই আমার পারিশ্রমিক। আমি কাজ নিয়েছি। আপনি দিয়েছেন। ভালো করে কাজ করে দেব, সেটাই তো আপনি আশা করেছিলেন। আপনি এক পয়সা দিতে চেয়েছিলেন, তাই তো দিয়েছেন। আর এই বাড়তি এক পয়সার কাজ তো আমি করিনি। এটা আমার প্রাপ্য নয়। কিছু মনে করবেন না। মাফ করবেন। সাহেব তার সততায় মুগ্ধ হলেন। তার পিঠ চাপড়ে আশীর্বাদ করে দিলেন, তুমি অনেক বড় হবে।
রণদা যেমন সততার পথে পা বাড়িয়েছিলেন। তেমনি প্রগতির ভাষাটাও ঠিক ধরতে পেরেছিলেন। তাই লিঙ্গুইস্টিক ইম্পেরিয়ালিজমের ফাঁদে পা দিয়ে তিনি কতটুকু সফল হয়েছেন বা হারিয়েছেন সেই প্রশ্ন উঠে আসে। তবে সে প্রশ্নের জবাব পেতে রণদার জীবনের পুরোটা অধ্যায় অধ্যয়নের দাবি রাখে।

গবেষক, শেয়ার বিজ
mshelleyjuÑgmail.com

Add Comment

Click here to post a comment

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০