অনাথ শিশুর মতো যার জীবনখানি নিস্তরঙ্গে নিথর হতে পারতো নিযুত জীবনের নিঠুর নিয়তিপাশে তিনি জুগিয়েছেন হৃৎস্পন্দনের খোরাক। দেশের জন্য লড়েছেন। শূন্য জমিনে গড়েছেন ব্যবসায় কাঠামো। জীবনের সব অর্জন লিখে দিয়েছেন মানুষের নামে। তিনিই দেশের সবচেয়ে সফল ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’-এর জনক রণদা প্রসাদ সাহা। নারীশিক্ষা ও চিকিৎসায় নারী-পুরুষ কিংবা ধনী-গরিবের ভেদ ভেঙেছেন। তার জীবনেই রয়েছে সসীমকে ডিঙিয়ে অসীমে শক্তি সঞ্চারের কথামালা। এ জীবন ও কেতন যেন রোমাঞ্চিত হৃদয়েরই উদ্দীপ্ত প্রেরণা। পর্ব-৩৩..
মিজানুর রহমান শেলী: যুদ্ধবিরতির পর ইংল্যান্ডের রাজা (ভারত সম্রাট) পঞ্চম জর্জ ১৯১৯ সালের ২৯ জুলাইকে শান্তি দিবস ঘোষণা করেন। যুদ্ধবিরতির কারণে দলে দলে বাঙালি সৈনিকেরা দেশে ফিরতে থাকে। শুধু ২০ নভেম্বর থেকে ২২ নভেম্বরের মধ্যে মেসোপটেমিয়া থেকে প্রায় ২৫০ সৈনিক চাকরি ছেড়ে অথবা লম্বা ছুটিতে বাংলায় ফিরে আসে। ছুটিতে আসা অনেক সৈনিক আর কাজে যোগ দেয়নি। এমনকি চাকরি থেকে অব্যাহতি নেয়।
ওই তারিখে ইংল্যান্ডে ‘ভিক্টর মার্চ’ ও ‘পিস সেলিব্রেশন’-এর আয়োজন করা হয়। ১৯১৯ সালের জুলাই মাসে ভারত সম্রাটের আমন্ত্রণে পিস সেলিব্রেশনে অংশ নেওয়ার জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মিত্রপক্ষের সব ইউনিটের প্রতিনিধিরা লন্ডনে মিলিত হয়। সম্রাট ৪৯তম বেঙ্গলি রেজিমেন্ট থেকে সম্মেলনে অংশ নেওয়ার জন্য তিন প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানালেন। ২৫ জুন বাঙালি পল্টনের করাচি ডিপোতে পিস সেলিব্রেশনের জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয়। এদিন ডিপোর সব সৈনিককে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হয় এবং ডিপোর অফিসার কমান্ডিং এবং করাচি ব্রিগেডের স্টাফ অফিসাররা সবাইকে পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনশেষে তারা জমাদার হিসেবে রণদা প্রসাদ সাহা, এনসিও হিসেবে হাবিলদার মোহিত কুমার মুন্সি ও সিপাই (রণদার আরদালি) হিসেবে নিত্যগোপাল ভট্টাচার্যকে নির্বাচন করেন। এছাড়া পার্শ্বচর হিসেবে একজন ধোপা, একজন ঝাড়–দারও নির্বাচিত হন। ১ ও ২ জুলাই এই নির্বাচনের খবর পত্রিকায় প্রকাশ পায়। বাঙালি পল্টনে দলের নেতা হিসেবে লেফটেন্যান্ট ডি জে উইলকস নির্বাচিত হন। করাচি ডিপোতে অবস্থিত হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম নির্বাচিতদের প্রস্তুতিতে সহায়তা করেন। হাবিলদার মুন্সি বলেন, ‘১৯১৯ সালের জুন মাসে আমি আমাদের রেজিমেন্টাল হেডকোয়ার্টার্স করাচিতে ইনস্ট্র্রাক্টর হিসেবে ছিলাম। জুন মাসের শেষদিকে শুনলাম, লন্ডনে পিস সেলিব্রেশনে ফর্টিনাইনথ বেঙ্গলি রেজিমেন্ট থেকে তিনজন প্রতিনিধিকে যেতে হবে। ২৫ জুন ডিপোর সব বাঙালি সৈনিকদের ‘ঋধষষ রহ’ করিয়ে বা সৈনিক রীতিতে দাঁড় করিয়ে ডিপোর কমান্ডিং অফিসার এবং ব্রিগেড স্টাফ অফিসাররা সবাইকে পরিদর্শন করেছেন। রেজিমেন্ট পরিদর্শন করার পর জানা গেল জমাদার রণদা প্রসাদ সাহা, সিপাই নিত্যগোপাল ভট্টাচার্য ও আমাকে সাত হাজার বাঙালি সৈনিকের প্রতিনিধি হয়ে লন্ডনে পিস সেলিব্রেশনে যেতে হবে। আমাদের যথাযোগ্য যন্ত্রাদি ও অন্যান্য উপকরণে সুসজ্জিত করার ভার কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলামের ওপর পড়ল।
রণদার নির্বাচন বিষয়ে তার সৈনিক বন্ধুরা উল্লেখ করেন, On the conclusion of the First World War, you (Ranoda) were rightly selected to represent the 49th Bengalis along with a NCO and a soldier in the peace celebration.[প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ইতিপর্বে ৪৯তম বেঙ্গলিজকে পিস সেলিব্রেশনে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য একজন এনসিও ও একজন সিপাইসহ তুমিই (রণদা) সঠিকভাবে মনোনীত হয়েছ।] ১৯১৯ সালের ২৯ জুন বাঙালি পল্টন দলসহ ভারতবর্ষে অবস্থিত ব্রিটিশ, ভারতীয় ও নেটিভ স্টেটের বিভিন্ন রেজিমেন্ট থেকে ৬০০ প্রতিনিধি পিস সেলিব্রেশনে অংশ নিতে লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হয়। কিন্তু আবহাওয়া ছিল দুর্যোগপূর্ণ। তাই ভারতবর্ষ থেকে কন্টিনজেন্ট ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারেনি। এ কারণে ১৯ জুলাই পিস সেলিব্রেশনের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান ‘ভিক্টরি মার্চে’ বেঙ্গলিজ সৈনিকরা অংশ নিতে পারেনি। ২৭ জুলাই ভারতীয় দল লন্ডনে পৌঁছে এবং ২ আগস্ট একটি পৃথক মার্চপাস্টে অংশ নেয়। লন্ডন হেমিংটন কোর্টে রণদা ও ভারতীয় অফিসার ক্যাম্পে বাকি বাঙালি সৈনিকরা গারোয়ালিদের সঙ্গে থাকেন।
রণদা লন্ডন থেকে ডা. এস কে মল্লিককে একটি চিঠি লিখেছেন, যা ডা. মল্লিকের হাতে ২৩ আগস্ট এসে পৌঁছে। এই চিঠিতে রণদা তাদের দেরিতে লন্ডনে পৌঁছানো, বিজয় অনুষ্ঠানসহ আরও কিছু তথ্য উল্লেখ করেন। তিনি উল্লেখ করেন, ৩০ জুলাই সেক্রেটারি অব স্টেট মি. এন্টেগু ইন্ডিয়া অফিসে তাদের আপ্যায়ন করেন। সেখানে ভারতের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, যেমন লর্ড সিন্হা, মি. গোর্লে প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। লন্ডনে রণদাকে সমরাস্ত্র প্রদর্শনীতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রণদা বিভিন্ন ধরনের বিমান, যুদ্ধজাহাজ, বাণিজ্য জাহাজ, টর্পেডো, ট্যাংক, বিমানবাহী জাহাজ, সাবমেরিন ইত্যাদি ভেতর ও বাইরে থেকে দেখেন। তিনি কোনো কোনো সমরাস্ত্রের মহড়াও অবলোকন করেন। সমরাস্ত্র প্রদর্শনী অবলোকনকালে ভারতীয়দের সুবিধার্থে দোভাষী ব্যবহার করা হয়। সফরকালে তিনি আমন্ত্রিত হয়ে বেশ কিছু সিনেমা ও থিয়েটার উপভোগ করেন। রণদা লন্ডন ও লন্ডনের বাইরে বেশ কিছু বিখ্যাত জায়গা ভ্রমণ করেন। ১৮ আগস্ট গøাসগো যান। ২২ আগস্ট লন্ডনে ফেরেন। লন্ডনে রণদার অর্থসংকট দেখা দেয়। তিনি রেজিমেন্ট (করাচি) থেকে ফেরত দেওয়ার শর্তে কন্টিনজেন্ট থেকে অগ্রিম অর্থ গ্রহণের কথাও চিঠিতে উল্লেখ করেন। লন্ডন থাকাকালে লর্ড সিনহা, তার ছেলে লেফটেন্যান্ট সিনহা এবং মিস্টার ও মিসেস এসসি সেন কয়েকবার কন্টিনজেন্ট শিবিরে এসে রণদার সঙ্গে দেখা করেন। ৭ বা ৮ সেপ্টেম্বর হাবিলদার মুন্সি করাচির উদ্দেশে ফেরতযাত্রা করেন। জমাদার রণদা ও তার আরদালি সিপাই নিত্যগোপাল আরও কিছুদিন পর ভারত ফিরে যান। ভারত ফিরে আসার রণদা প্রসাদ সাহাকে অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি পাঠালেন পর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ওই চিঠিতে রণদাকে চিন্তাধারা, সেবাপরায়ণতা, সহানুভ‚তি ও মহত্তকে আজীবন লালন করার উপদেশ দিয়েছিলেন তিনি।
১৯২০ সালের ১০ আগস্ট লর্ড এম্পটহিল হাউজ অব কমন্সে বাঙালি পল্টন ভেঙে দেওয়া এবং এর সামরিক উপযুক্ততা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। জবাবে হাউজ অব কমন্সের ভারতীয় সদস্য লর্ড সিনহা জানান, যুদ্ধপরবর্তীকালে বাঙালি পল্টনসহ সব অতিরিক্ত ইউনিট ভেঙে দেওয়া হয়েছে, তবে বাঙালি পল্টনের ছোট একটি অংশ এখনও রাখা হয়েছে। তবে তিনি উল্লেখ করেন, মেসোপটেমিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে এই পল্টন সামরিক সক্ষমতা প্রমাণে সফল হয়নি। এ নিয়ে তখন বেশ তর্ক-বিতর্ক চলতে থাকে। বিভিন্ন জন বিভিন্ন যুক্তি পেশ করেন। তারা বাঙালি সৈনিকের নানারকম অযোগ্যতাকে এর কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। সৈনিক হিসেবে বাঙালির অযোগ্যতা, যুদ্ধে বাঙালির কর্মকাণ্ড, শারীরিক ও চারিত্রিক দুর্বলতা, শিক্ষা ও বুদ্ধির মান নিয়ে তারা কথা বলেন। এরপর ১৯২০ সালের ৩০ আগস্ট থেকে বাঙালি পল্টন বা ৪৯তম বেঙ্গলি রেজিমেন্টকে ধীরে ধীরে ভেঙে দেওয়া হয়। ১৯২০ সালের মধ্যেই সব সৈনিককে রেজিমেন্ট থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। অবশ্য যুদ্ধবিরতির পর বাঙালি সৈনিকেরা চিকিৎসা ও অন্যান্য কারণে নিজেরাই ছুটি ও অব্যাহতি নিতে থাকেন।
কার্যত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে মিত্রবাহিনীতে বিপুল সংখ্যক সৈন্যের প্রয়োজন হয়। ফলে সাময়িকভাবে তারা অনেক রেজিমেন্ট ও ব্যাটালিয়ন তৈরি করে। এদেরকে তারা সম্পূরক বা অতিরিক্ত ব্যাটালিয়ন বলে উল্লেখ করে। যুদ্ধশেষে এসব নবগঠিত ব্যাটালিয়নের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। তাই স্বাভাবিক কারণেই পল্টন ভেঙে দেওয়া হয়। ১৯১৬ সালের ১১ আগস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত সৈনিক ভর্তিসংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, ‘চাকরির মেয়াদÑযত দিন যুদ্ধ চলবে।’ সামরিক বাহিনীতে সৈন্য ভর্তির যোগ্যতাকেও শিথিল করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। আদতে যুদ্ধকালীন প্রয়োজনে ব্রিটিশ সরকার এই বাহিনী প্রস্তুত করে, যার কিছু ক্ষেত্র বিচার করলে অপেশাদার মনে হয়। তবে এই বাঙালি পল্টনে যোগ দেওয়া বাঙালিরা সবাই যে পেশাদার সৈনিকের মনোভাবসম্পন্ন ছিলেন, তা নয়। বিভিন্ন জন বিভিন্ন কারণে যুক্ত হয়েছিলেন। সে আলোচনা আগেই হয়েছে। তবে শিক্ষিত অনেক যুবার যুদ্ধে যাওয়ার পেছনে বিপ্লবী মনোভাব কাজ করেছিল। এই বিপ্লবীরা ব্রিটিশের পেশাদারি সামরিক যোগ্যতা বা আচার-আচরণ অথবা দৃষ্টিভঙ্গিতে উন্নীত হবেন না, সেটাই স্বাভাবিক।
তবে মোটাদাগে বাঙালি পল্টনের সফলতার কথা যুদ্ধকালেই বাঙালি, ব্রিটিশ ও ফরাসিরা উচ্ছ¡সিত ভাষা ও ভঙ্গিতে ব্যক্ত করেছেন। তাছাড়া অনেক বাঙালি সেনা পরবর্তী জীবনে জগৎজোড়া খ্যাতি অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। বেঁচে আছেন আজও। তাদের অমরত্ব মানুষ, মাটি, ইতিহাস আর এই বাঙালি সমাজে চিরভাস্বর। রণদা প্রসাদ সাহা ছিলেন তাদের মাঝে সমহিমায় উজ্জ্বল। এছাড়া বাঙালি পল্টনে আরও বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম (জাতীয় কবি), খাজা হাবিবুল্লাহ (ঢাকার নবাব), শৈলেন্দ্র নাথ বসু, কুমার অধিক্রম কুমার রায়, মাহবুব উল আলম প্রমুখ।
গবেষক, শেয়ার বিজ
mshelleyjuÑgmail.com