Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 2:09 am

ভুয়া এনআইডি-টিআইএনে ৪১ কোটি টাকা ঋণ

রোহান রাজিব: ভুয়া এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) ও টিআইএন (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর) দিয়ে মো. কামরুজ্জামান সাঈদী (সোহাগ) নামে এক ব্যক্তি তার পাঁচ প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে অগ্রণী ব্যাংকের মৌলভীবাজার করপোরেট শাখা থেকে ৪১ কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছেন। শুধু ভুয়া এনআইডি ও টিআইএন নয়, ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোয় (সিআইবি) খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন এবং একই সম্পত্তি দুই ব্যাংকে বন্ধক রেখেও ঋণ নেয়া হয়।

এ ঋণ পেতে সহায়তা করেছেন অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহম্মদ শামস উল ইসলাম ও ব্যাংকের অন্য কর্মকর্তারা। অগ্রণী ব্যাংকের অডিট ও পরিদর্শন বিভাগের তদন্তে এ তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, কামরুজ্জামান সাঈদী সোহাগ অগ্রণী ব্যাংক থেকে ৪১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। এর মধ্যে ফান্ডেড ১৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। আর নন-ফান্ডেড ২২.৮৫ কোটি টাকা।

এসব ঋণ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে অনুমোদন ও বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান হলো মেসার্স ভাস্ট বাংলাদেশ। বিভিন্ন প্রকার ফল, মসলা ও নির্মাণসামগ্রী আমদানির লক্ষ্যে ১৫.৩৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক কোম্পানি ভাস্ট অ্যাপারেলস লিমিটেডের মাধ্যমে ১৪.৩৯ কোটি টাকা, ইনায়া কনস্ট্রাকশন লিমিটেড অ্যান্ড কম্বাইন্ড ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন জেভি নামক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেড় কোটি টাকা, প্রায় তিন কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে আইসিএল অ্যান্ড ম্যাক জেভি একটি যৌথ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে আর জারিফ ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি চিকিৎসা সরঞ্জাম পরিবেশক কোম্পানির মাধ্যমে ২.০৫ কোটি টাকা নেয়া হয়েছে। অগ্রণী ব্যাংক ২০২১ ও ২০২২ সালে এ ঋণগুলো অনুমোদন করেছিল। এ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে নেয়া ঋণের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম পেয়েছে অগ্রণী ব্যাংকের পরিদর্শন দল।

ভুয়া এনআইডি ও টিন দিয়ে জালিয়াতি: অগ্রণী ব্যাংকের অডিট প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রূপালী ব্যাংক থেকে কামরুজ্জামান সাঈদী একটি ঋণ নেন, যেখানে জাল এনআইডি ও টিআইএন দেয়া হয়। ওই ঋণ নেয়ার সময় নাম ব্যবহার করা হয়েছিল কামরুজ্জমান সোহাগ। ঋণটি খেলাপি হয়ে পড়ায় তা আদায়ের জন্য মামলা করে ব্যাংক। তবে অগ্রণী ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার সময় মূল জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করা হয়, যেখানে নাম ছিল কামরুজ্জামান সাঈদী। কিন্তু রূপালী ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার সময় ভুয়া নাম ব্যবহার করায় অগ্রণী ব্যাংকের ঋণ নেয়ার সময় সিআইবিতে খেলাপির ঋণের তথ্য প্রদর্শিত হয়নি, যা ব্যাংক কোম্পানি আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ও গুরুতর অনিয়ম।

বন্ধকি সম্পত্তির ভুয়া মালিকানা ও বিক্রীত জমি বন্ধক রেখে জালিয়াতি: ঋণগ্রহীতা মো. কামরুজ্জামান সাঈদী ঋণের বিপরীতে যেসব জমি বন্ধক রেখেছেন, তাতেও ব্যাপক অনিয়ম পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে বিক্রীত জমি বন্ধক, একই ব্যক্তির দুই নাম ব্যবহার করে দলিল দেয়া এবং অন্যের মালিকানার জমি ঋণগ্রহীতার বাবার নামে ভুয়া দলিল দেয়া হয়।

জানা যায়, ঋণগ্রহীতার স্থায়ী ঠিকানা গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার অন্তর্গত মাথারপাড়া গ্রামে। তিনি এলাকার মোট ১৭৮৪ দশমিক শূন্য শতক জমি ঋণের বিপরীতে বন্ধক রাখেন। তবে এ জমির বেশিরভাগ ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে গ্রাহকের বাবা বিক্রি করেছিলেন। এছাড়া মো. কামরুজ্জামান তার বিভিন্ন বন্ধকি সম্পত্তিতে তার বাবার ভিন্ন নাম ব্যবহার করেছেন। এক্ষেত্রে ১২৩ শতক জমির হস্তান্তরকারী ঋণগ্রহীতার পিতা (শেখ সাদী) নিজেই। কিন্তু দলিল গ্রহীতার পিতার নামের জায়গায় শেখ সাদী লেখা হয়েছে। আবার সম্পত্তিদাতার জায়গায় লেখা হয়েছে রহমত উল্যাহ এবং স্বাক্ষর করেছেন রহমত উল্যাহ হিসেবেই।

এক্ষেত্রে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ সাদী ও রহমত উল্যাহ একই ব্যক্তি হওয়ার পরও দলিল দাতা ও দলিল গ্রহীতার পিতার জায়গায় ভিন্ন নাম ব্যবহার করে দলিল তৈরি করা হয়েছে, যা জালিয়াতি ও প্রতারণার শামিল। এছাড়া ঋণের বিপরীতে বিভিন্ন স্থানে গ্রাহকের সহযোগী জামানত ব্যাংক কর্তৃক অতিমূল্যায়িতত হয়েছে।

ওয়ার্ক অর্ডার ছাড়া ওভারড্রাফট সুবিধা: করোনার এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের জন্য ১০ কোটি টাকার কার্যাদেশের বিপরীতে এক কোটি টাকার ওভারড্রাফট (ওডি) মঞ্জুরি সুবিধা দেয়া হয়। এক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক হওয়া সত্ত্বেও বৈধ ওয়ার্ক অর্ডার ছাড়াই ব্যাংকটি এক কোটি টাকার ওভারড্রাফট সুবিধা অনুমোদন করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ওডি ঋণের বিপরীতে প্রাথমিক জামানত হিসেবে কার্যাদেশের মূল কপি জমা নেয়া হয়নি। যাচাই না করে ওডি ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ করা হয়েছে। ঋণ অনুমোদনে অনিয়ম সত্ত্বেও ব্যাংক ঋণ পুনঃতফসিল করেছে, যা ব্যাংকিং নিয়মের লঙ্ঘন ও গুরুতর অনিয়ম।

কভিড-১৯ প্রণোদনা ঋণে অনিয়ম: কামরুজ্জামান ২০২১ সালে নতুন ব্যবসা শুরু করেন। নতুন ব্যবসার বিপরীতে তাকে কভিড-১৯-এর প্রণোদনা ঋণের সুবিধা দেয়া হয়েছে, এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম লঙ্ঘন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কভিড-১৯ প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় নেয়া ঋণ দিয়ে বিদ্যমান কোনো ঋণ পরিশোধ করা যাবে না। একই সঙ্গে নতুন ব্যবসা শুরু করার জন্যও প্রণোদনা ঋণ না দেয়া।

প্রণোদনার এ ঋণ পেতে ব্যাংকটির শাখা মহাব্যবস্থাপক সহযোগিতা করেছেন। এক্ষেত্রে শাখাপ্রধান কামরুজ্জামানকে অভিজ্ঞ গার্মেন্ট ব্যবসায়ী হিসেবে তুলে ধরেন। তবে পরিদর্শন দল দেখেছে, গার্মেন্ট সেক্টরে তার কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতা নেই। অবৈধভাবে এ ঋণ সুবিধা দেয়ার জন্য ঋণ অনুমোদন ও বিতরণের সঙ্গে জড়িত সবাই দায়ী।

অন্যের নাম নিবন্ধন করে মোবাইল ফোন সিম কার্ড ব্যবহার করা

ভাস্ট বাংলাদেশ এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানের লিফলেটে ছয়টি মোবাইল ফোন নম্বর ব্যবহার করছে। যদিও প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক মো. কামরুজ্জামান সাঈদীর নিজের এনআইডি কার্ড ব্যবহার করে কোনো সিম কার্ড ওঠানো হয়নি। পরিদর্শন দল পুলিশ ও র?্যাবের সহায়তায় এসব জালিয়াতি ঘটনা বের করেছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়।

সীমাতিরিক্ত উত্তোলন সুবিধা

গ্রাহকের অনুকূলে ২০২২ সালের ১২ এপ্রিল ৩০ লাখ টাকা সীমাতিরিক্ত উত্তোলন সুবিধা দেয়া হয়েছে, যা পরবর্তীকালে সমন্বয় করা হয়নি। সীমাতিরিক্ত উত্তোলন সুবিধা দেয়ার জন্য শাখাপ্রধান বৈষ্ণব দাস মণ্ডল ও উপ-মহাব্যবস্থাপক দায়ী বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

অবৈধ ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা

গ্রাহকের নেয়া সব ঋণ চলতি বছরের জুন পর্যন্ত অনিয়মিত ছিল। কিন্তু বিপুল ঋণ অনিয়ম থাকা সত্ত্বেও গত ২৫ জুলাই ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ গ্রাহকের জন্য ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য অনুমোদন করে। ফলে গ্রাহক তার ঋণের একটি বড় অংশ অবৈধ ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা গ্রহণ করে নিয়মিত করেন, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মের পরিপন্থি।

কেলেঙ্কারি ও জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা

পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণের বড় অংশের অনুমোদনের ক্ষমতা রাষ্ট্রীয় অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার অধীনে ছিল। সে সময় ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ছিলেন মোহম্মদ শামস উল ইসলাম। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোহম্মদ শামস উল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ঋণটি অনিয়ম বা অনৈতিকভাবে দেয়া হয়নি। সব নিয়মকানুন মেনেই দেয়া হয়েছে।

সাবেক এমডি ছাড়াও ব্যাংকের মৌলভীবাজার করপোরেট শাখার প্রধান বৈষ্ণব দাস মন্ডল; মো. মেহেদী হাসান সোহাগ, ব্যবস্থাপক, ঋণ ও অগ্রিম বিভাগ; ব্যাংকের কর্মকর্তা মো. বিল্লাল হোসেন; রিপন দে সরকার, বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগের ব্যবস্থাপক; আনোয়ার পারভেজ, ব্যাংকের এসপিও; নাজমুল এহসান, ঋণ ও অগ্রিম বিভাগের ব্যবস্থাপক; প্রভাত কুমার পালিত, বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগের ব্যবস্থাপক; আবদুর রহিম, ব্যাংকের কর্মকর্তা; অশোক এলাহী, জেনারেল ম্যানেজার; মনিরুল আলম, সহকারী মহাব্যবস্থাপক; শেখ মঈনুদ্দিন ও আসানুল কবির ঋণ কেলেঙ্কারি ও অনিয়মের সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অগ্রণী ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনের মতোই একই ধরনের অনিয়ম পাওয়া গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানে। এরপর চলতি বছরের জুলাইয়ে বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়ে গ্রাহক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যাংকের পক্ষ থেকে কী ধরনের আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তা জানতে চাওয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মুরশেদুল কবির শেয়ার বিজকে বলেন, ঋণ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত প্রতারক ব্যবসায়ী ও ঋণদাতা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে ব্যাংক। তিনি আরও বলেন, এরই মধ্যে মৌলভীবাজার শাখার প্রধান বৈষ্ণব দাস মণ্ডলকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং ব্যাংক অনিয়মের সঙ্গে জড়িত অন্য কর্মকর্তাদের কাছেও ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।