জয়নাল আবেদিন: ভল্টের টাকা হারানোর সমালোচনা শেষ হতে না হতেই আবার আলোচনায় বেসরকারি ইউনিয়ন ব্যাংক। ব্যাংকটির হাটখোলা শাখা থেকে ১০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে একটি কোম্পানি। ভুয়া এফডিআর দেখিয়ে এই টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। কিন্তু এফডিআরধারীর ওই অ্যাকাউন্টে কোনো টাকাই ছিল না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিষয়টি একাধিক সংস্থার নজরে এলে ওই অ্যাকাউন্টের বিপরীতে লোন ক্রিয়েট (ঋণ তৈরি) করে বিষয়টিকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চলছে। সূত্রমতে, মৌখিক আদেশে অবৈধ ঋণটি তৈরিতে বাধ্য হয়েছেন সংশ্লিষ্ট শাখার নিম্ন শ্রেণির কর্মকর্তারা।
২০২০ সালের ২৪ নভেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) বিষয়টি অবহিত করে চিঠি পাঠান ইউনিয়ন ব্যাংকেরই এক কর্মকর্তা। তবে চিঠিটি গ্রহণ করা হয়েছে ২০২১ সালের ১১ জানুয়ারি। বিষয়টি তদন্ত করে দুর্নীতিগ্রস্তদের আইনের আওতায় আনার অনুরোধ জানানো হয়েছে চিঠিতে। কোনো ধরনের আইনের তোয়াক্কা না করে সেনশন ব্যতীত, মর্টগেজ ব্যতীত, বোর্ডের অনুমতি ছাড়া কীভাবে টাকা দিতে পারে, তা বোধগম্য নয় খোদ শাখার কর্মকর্তাদের। তবে ঘটনাটি বিস্তর তদন্তের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে মামলাটি হস্তান্তর করে দুদক। এই চিঠি ২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর গৃহীত হয় বাংলাদেশ ব্যাংকে।
দুদকে পাঠানো ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘ইউনিয়ন ব্যাংকের হাটখোলা শাখা থেকে ২০২০ সালের ১৫ জুলাই ভুয়া এফডিআর দেখিয়ে একটি কোম্পানি ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। যার অ্যাকাউন্ট নম্বর ০০৪৭০৯০০০০০৫৬ ও সিআইএস নম্বর ৩০৬৯৩২। অ্যাকাউন্টটি খোলা হয়েছে একই দিনে (তারিখ ১৫ জুলাই ২০২০)। ঋণের মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ ছিল ১৫ জানুয়ারি ২০২১। এই ঋণের সুদের হার ছিল ১২ শতাংশ। ওই কোম্পানির একটি কারেন্ট অ্যাকাউন্টও আছে; যার নম্বর ০০৯১০১০০০৭১৭২, কাস্টমার আইডি নং ৩০৬৯৩২। কোম্পানিটি সুকৌশলে টাকাটি নিজের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে না নিয়ে অন্য কোম্পানির মাধ্যমে বের করে নিয়ে যায়। যার পে-অর্ডার নম্বর ৩২০৬৮৪৭, তারিখ ১৫ জুলাই ২০২০, হাটখোলা শাখা ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড (যা ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মৌখিক আদেশে দেয়া হয়েছে)। বর্তমানে শাখাপ্রধান বারবার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে তাগিদ দিলেও তিনি এ ব্যাপারে কোনো সাড়া দিচ্ছেন না। তিনি বলেন, দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক আছে, আপনি চিন্তা করবেন না।’
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘উল্লেখ্য যে, আত্মসাৎকারী ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের নাম এর আগে তিস্তা নদীর ব্রিজ নির্মাণ প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা রয়েছে। মামলাটি এখনও চলমান। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কীভাবে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত কোম্পানিকে ব্যাংকের নিন্ম শ্রেণির কর্মচারীদের দিয়ে কোনো প্রকার আইনের তোয়াক্কা না করে সেনশন ব্যতীত, মর্টগেজ ব্যতীত, বোর্ডের অনুমতি ছাড়া টাকা দিতে পারেন। এ ব্যাপারটি একটি ব্যাংকের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। মাননীয় চেয়ারম্যান (দুদক), সমাজে আপনার একটা সুনাম রয়েছে। এ নিয়ে আমরা ছোট কর্মকর্তা হিসেবে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মৌখিক নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে গিয়ে বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছি। এই ব্যাপারে আপনার সুদৃষ্টি কামনা করছি। আশা করি, আপনি ব্যাপারটিকে গুরুত্ব সহকারে নেবেন এবং দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের শাখাকে বড় ধরনের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করবেন।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক জানতে চাইলে নয়-ছয় উত্তর দিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দিতে চাচ্ছে ইউনিয়ন ব্যাংক। ব্যাংকের মতে, ওই অ্যাকাউন্টের বিপরীতে একটি ঋণ তৈরি করা হয়েছে। এর বেশি কিছুই জানানো হয়নি। সংশ্লিষ্টদের মতে, বিষয়টি নিয়ে একটি বিস্তর তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে। কারণ টাকাগুলো বিদেশে পাচারের আশঙ্কাও রয়েছে বলে মত সংশ্লিষ্টদের।
বিষয়টি নিয়ে একাধিক মাধ্যমে যোগাযোগ করেও ইউনিয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী এবিএম মোকাম্মেল হক চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। এমডির সহকারীকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হোয়াটস অ্যাপে প্রশ্ন লিখে পাঠালেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। সবশেষ এমডির কার্যালয়ে গেলেও দেখা না করে প্রতিবেদককে ফিরিয়ে দেন তিনি। ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ‘স্যার (এমডি) খুব ব্যস্ত আছেন, ধারাবাহিক মিটিং থাকায় দেখা করতে পারবেন না।’
উল্লেখ্য, বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদে ২০১৩ সালে ৯টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব ব্যাংকের মধ্যে দেশীয় উদ্যোক্তাদের মালিকানায় ছয়টি এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের মালিকানায় অনুমোদন পায় তিনটি ব্যাংক। এর মধ্যে দেশীয় উদ্যোক্তাদের মালিকানায় গড়ে উঠেছে ইউনিয়ন ব্যাংক। যদিও পরবর্তী সময়ে দেশের একটি খ্যাতনামা গ্রুপ ব্যাংকটির অধিকাংশ শেয়ার কিনে নেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইউনিয়ন ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ১৮ হাজার ২৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ দশমিক ৩৮ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে, অঙ্কে যার পরিমাণ ৪৩৪ কোটি টাকা। ব্যাংকটিকে সম্প্রতি পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। ব্যাংকটি ৪২ কোটি ৮০ লাখ সাধারণ শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ৪২৮ কোটি টাকা পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলন করবে। এজন্য আইপিও প্রক্রিয়া শুরু করেছে ব্যাংকটি। প্রতিটি শেয়ারের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ টাকা।