ভুল পরিকল্পনায় তবে সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ!

বিশেষ প্রতিনিধি: চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার ও রামু থেকে মিয়ানমারের সীমান্ত ঘুনধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প নেয়া হয় ২০১০ সালের জুলাইয়ে। ট্রান্সএশিয়ান রেলরুটের অংশ হিসেবে আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি বাড়াতে ১২৮ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের এ প্রকল্প নেয়া হয়। তবে শুরুতেই ভুল ছিল প্রকল্প গ্রহণ প্রক্রিয়ায়। কোনো ধরনের বিস্তারিত সমীক্ষা ছাড়া নেয়া এ প্রকল্পের ব্যয় সে সময় ধরা হয় এক হাজার ৮৫২ কোটি টাকা।

প্রকল্পটি পাস হওয়ার তিন বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০১৩ সালে এটি নির্মাণ শেষ করার লক্ষ্য ধরা হয়। তবে সমীক্ষা করতে গিয়ে নানা বিষয় সামনে আসে রেলের। সংরক্ষিত বনাঞ্চল, ক্যান্টনমেন্ট এলাকা, হাতি চলাচলের পথ, জনবসতিপূর্ণ এলাকায় মানুষের বসতবাড়ি গড়ে ওঠাÑএসব বিষয় বিবেচনায় এর বিস্তারিত সমীক্ষা ও ডিজাইনশেষে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ নির্মাণব্যয় বেড়েছে প্রায় ৮৭৪ শতাংশ।

যদিও মিয়ানমারের সম্মতি না পাওয়ায় পরবর্তীতে রামু থেকে ঘুনধুম অংশের ২৮ কিলোমিটার বাদ দিতে হয়েছে। আর দোহাজারি থেকে কক্সবাজার অংশের দুই প্যাকেজে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয় ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে। এর আওতায় নির্মাণ করা হয়েছে দোহাজারি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেলপথ। তবে এজন্য ব্যয় করতে হয়েছে ১৫ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। আগামী মাসে এ রেললাইন উদ্বোধনের কথা ছিল।

এরই মধ্যে ঘটে গেছে অনাকাক্সিক্ষত এক ঘটনা। গত সপ্তাহের ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় নির্মাণাধীন রেললাইনের একটি অংশে পাথর ও মাটি ভেসে গেছে। রেললাইন উঁচু-নিচু ও বাঁকা হয়ে গেছে। এতে নির্ধারিত সময়ে ট্রেন চলাচল শুরু হওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে একাধিক জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেসব প্রতিবেদনে স্থানীয়দের নানা অভিযোগ উঠে এসেছে। এছাড়া বন্যার মাঝে শেয়ার বিজের সঙ্গেও রেললাইনের ডিজাইনে ত্রুটির বিষয়টি জানান অনেক স্থানীয় অধিবাসী।

তাদের বক্তব্য ছিল, গত ১০০ বছরেও সাতকানিয়ায় এ ধরনের বন্যা হয়নি। এর মূল কারণ দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন। এটি নির্মাণের সময় পানি নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত কালভার্ট রাখা হয়নি। সমীক্ষায় ১০০ কিলোমিটার এলাকায় ১৪৫টি মাইনর ব্রিজ বা কালভার্ট স্থাপনের কথা বলা হয়েছিল। তবে শুরু থেকেই প্রকল্পে কালভার্টের সংখ্যা বাড়ানোর দাবি তুলে আসছিলেন স্থানীয়রা। এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য ছিল পাহাড়ি এলাকায় প্রচুর ছড়া, খাল ও জলপ্রপাত আছে। অতিবৃষ্টি বা ঢলের সময় এগুলোর পানি দ্রুত বের হওয়ার জন্য রেলপথে কালভার্টের সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। স্থানীয়দের দাবির মুখে প্রকল্প এলাকায় মোট ২৪৪টি কালভার্ট স্থাপন করা হয়। তবে এ সংখ্যাও যথেষ্ট নয়। এছাড়া কালভার্টের দৈর্ঘ্য পাঁচ থেকে ৪৫ মিটার। এত ছোট কালভার্ট পানি নিষ্কাশনের জন্য যথেষ্ট নয়।

গতকাল দৈনিক প্রথম আলোতে ‘চালুর আগেই বেঁকে গেল রেললাইন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে রেললাইনের অবস্থা ও স্থানীয়দের অভিযোগ। এতে বলা হয়, টানা অতিবর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সাতকানিয়ার বিভিন্ন এলাকা গত সোমবার সন্ধ্যা থেকে ডুবতে শুরু করে। মঙ্গলবার ভোরে রেললাইন পানিতে তলিয়ে যায়। পরদিন বুধবার পানি নামে। এরপর রেললাইন উঁচু-নিচু ও বাঁকা হয়ে যাওয়া এবং লাইন থেকে পাথর ও মাটি সরে যাওয়া দৃশ্যমান হয়। এ পরিস্থিতির জন্য অপরিকল্পিত রেলপথ নির্মাণকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞ ও এলাকাবাসী। তারা বলছেন, ছোট ছোট যে কালভার্ট রাখা হয়েছে, সেগুলো পানি নিষ্কাশনের জন্য যথেষ্ট নয়।

রেলওয়ের কর্মকর্তারা গত বৃহস্পতিবার ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইন পরিদর্শন করেন। তাদের মতে, এক কিলোমিটার জুড়ে রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবহাওয়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তিন-চার সপ্তাহের মধ্যে সংস্কারকাজ শেষ করা যাবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যে অঞ্চলে রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেখান দিয়ে বান্দরবানের পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানি দ্রুত নেমে এসে সাগরে গিয়ে পড়ে। রেললাইন নির্মাণের সময় তা বিবেচনায় নেয়া দরকার ছিল। এখন রেললাইন করার কারণে পানি নিষ্কাশনের পথ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এতে বন্যার ব্যাপকতা বেড়েছে। মানুষকে যেমন ভুগতে হচ্ছে, তেমনি রেলের সম্পদ নষ্ট হয়েছে।

গত শুক্রবারও রেললাইনের দুই পাশের এলাকা ও বিলে পানি জমে ছিল। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সাম্প্র্রতিক সময়ে তাদের এলাকায় এমন ভয়াবহ বন্যা হয়নি। রেললাইনের কারণে পানি নিষ্কাশনের পথ আটকে যাওয়ায় তাদের এলাকার বাড়িঘর ডুবে গেছে। যদি রেললাইনে পর্যাপ্ত কালভার্ট বা সেতু নির্মাণ করা হতো, তাহলে এত ক্ষতি হতো না।

স্থানীয় সিএনজিচালক মোহাম্মদ হোসাইন (৪৩) বলেন, তাদের এলাকায় রেললাইনে চারটি মাত্র কালভার্ট দেয়া হয়েছে। শুরুতে আরও কম ছিল। তারা আন্দোলন করলে কালভার্ট বাড়ানো হয়। আরও যদি বাড়ানো হতো, তাহলে এই সর্বনাশ হতো না। ভবিষ্যতেও এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী।

অপরিকল্পিত রেলপথের কারণে ভয়াবহ বন্যা হয়েছেÑএলাকাবাসীর এই বক্তব্য মানতে নারাজ রেলওয়ের প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তারা। প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাই থেকে শুরু করে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এই প্রকল্প নেয়া হয়েছে। ১০০ বছরের বন্যার বিষয়টিও হিসাবে রাখা হয়েছিল। যে অংশে রেললাইন ডুবেছে, সেখানে প্রায় ২০ ফুট উঁচুতে লাইন করা হয়। এবার অস্বাভাবিক বৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে রেললাইন ডুবে গেছে। আর ১০০ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে মাত্র এক কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

যদিও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল হক এ পরিস্থিতির জন্য অপরিকল্পিত রেলপথ নির্মাণকেই দায়ী করছেন। তিনি বলেন, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনে ছোট ছোট কালভার্ট রাখা হয়েছে। পানি নিষ্কাশনের জন্য তা পর্যাপ্ত নয়। এই অঞ্চল দিয়ে পাহাড়ি এলাকার ঢল দ্রুত নেমে এসে সাগরে গিয়ে পড়ে। পানি নিষ্কাশনের পথে রেললাইনের মাধ্যমে বাঁধ দেয়ায় পানি নামতে পারেনি। যেহেতু রেললাইন হয়ে গেছে, তাতে সংশোধনের তেমন কোনো সুযোগ নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন এ ধরনের বৃষ্টি আরও হবে। তখন রেললাইন আবার ডুববে। এতে স্বাভাবিকভাবই মানুষ প্রশ্ন তুলবেন পরিকল্পিতভাবে রেললাইনটি নির্মাণ করা হয়নি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০