Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 6:26 pm

ভুল পরিকল্পনায় পঞ্চম দফা প্রকল্প সংশোধনের উদ্যোগ

ইসমাইল আলী: উন্নয়ন প্রকল্প দুবারের বেশি সংশোধন না করার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে নির্দেশনা না মেনে চার দফা সংশোধন করা হয়েছে জয়দেবপুর-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা চার লেন নির্মাণ প্রকল্পটি। সম্প্রতি এটি পঞ্চম দফা সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া ৭০ কিলোমিটার এ চার লেনের কাজ পাঁচ বছরের মধ্যে শেষ করার কথা থাকলেও প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়িয়ে ৯ বছর দুই মাস করা হচ্ছে। প্রকল্প পরিকল্পনায় ভুলের কারণে বারবার প্রকল্পটি সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।

গতকাল সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অনুষ্ঠিত প্রকল্পটির স্টিয়ারিং কমিটির সভায় এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে জানানো হয়, জয়দেবপুর থেকে চন্দ্রা ও টাঙ্গাইল হয়ে এলেঙ্গা পর্যন্ত মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্প নেয়া হয় ২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল। ২০১৮ সালের মার্চের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ করার কথা ছিল। তবে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পটির অগ্রগতি ৮৮ শতাংশ। এজন্য ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পটির মেয়াদ বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে।

এদিকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ওএফআইডি) ও আবুধাবি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট (এডিএফডি) প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ঋণ দিচ্ছে। এজন্য ঋণ চুক্তি সই হয়েছিল ২০১৩ সালে। তবে বিনিময় হার পরিবর্তনের ফলে বৈদেশিক মুদ্রায় এর পরিমাণ কমে গেছে। এতে প্রকল্পটিতে ফাইন্যান্সিং গ্যাপ তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি প্রকল্পটিতে বেশকিছু নতুন অঙ্গ যুক্ত হয়েছে। আবার কিছু কাজ বাদ দিতে হয়েছে। এতে প্রকল্প ব্যয় পরিবর্তন হবে। এজন্য উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধন করতে হবে।

সূত্রমতে, জয়দেবপুর-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা চার লেন নির্মাণ প্রকল্পটির ব্যয় প্রাথমিকভাবে ধরা হয়েছিল দুই হাজার ৭৮৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে তিন সংস্থার ঋণ দেয়ার কথা ছিল এক হাজার ৮৩৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। আর সরকারি তহবিল থেকে দেয়ার কথা ছিল ৯৪৭ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। তবে ১০ মাসের মধ্যে প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। এতে ২০১৪ সালের ৯ জানুয়ারি প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ৬৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। জমি অধিগ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধির যুক্তিতে সে সময় প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো হয়েছিল।

এরপর ২০১৬ সালের ২৭ মার্চ জমির দাম বৃদ্ধির যুক্তিতে প্রকল্পটি আরেকবার সংশোধন করা হয়। এতে ব্যয় বাড়ানো হয় ২৯৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। ফলে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ৩৬৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। দুবারই সরকারি খাতের ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। ফলে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল অপরিবর্তিত।

২০১৮ সালের ৮ মে প্রকল্পটি তৃতীয় দফা সংশোধন করা হয়। সে সময় প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৫৯৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল ছিল এক হাজার ৫২১ কোটি সাত লাখ টাকা। আর প্রকল্প সহায়তার পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৪২০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। ধীরগতির যানবাহনের জন্য একটি নতুন সড়ক লেন, পাঁচটি ফ্লাইওভার, ১৩টি আন্ডারপাস ও কংক্রিট পেভমেন্ট অন্তর্ভুক্তি এবং জমি অধিগ্রহণ বৃদ্ধির যুক্তিতে সেবার ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়েছিল।

এদিকে জয়দেবপুর-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা চার লেন প্রকল্পের চতুর্থ দফা ব্যয় বাড়ানো হয় ২০২০ সালের ৯ জুন। সে সময় প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজার ২১৪ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের তহবিল থেকে দেয়া হবে দুই হাজার ৭৯৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। আর বাকিটা প্রকল্প সহায়তা হিসেবে তিনটি সংস্থা ঋণ দিচ্ছে। জমি অধিগ্রহণ ব্যয় বৃদ্ধির ফলে চতুর্থ দফা সংশোধনের পুরোটাই সরকারি খাত থেকে দিতে হচ্ছে।

এর পরও আরেক দফা প্রকল্পটি সংশোধন করতে হচ্ছে। সর্বশেষ এ সংশোধনের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলা হয়েছে, বিনিময় হার পরিবর্তনের ফলে প্রকল্পটিতে বৈদেশিক ঋণের ফাইন্যান্সিং গ্যাপ তৈরি হয়েছে পাঁচ দশমিক ২৫২ কোটি ডলার বা প্রায় ৪৪৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা। আবার ডিপিপিতে উল্লিখিত কাজের পরিধিও পরিবর্তন হবে। এর মধ্যে রয়েছে চন্দ্রা গ্রেড সেপারেটেড লুপ বাদ দেয়া। এক্ষেত্রে চন্দ্রা মোড়ে পৃথক ইন্টারচেঞ্জ নির্মাণ করতে হবে। এছাড়া ১৩টি আন্ডারপাসের পরিবর্তে দুটি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হয়েছে। বাকি পয়েন্টে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হবে।

এদিকে কালিয়াকৈরের লতিফপুরে ধীরগতির যানবাহনের জন্য নির্মিতব্য ওভারপাসটি বাদ দিতে হচ্ছে। তবে কালিয়াকৈরে টানসূত্রাপুর এলাকায় একটি ট্রাকস্ট্যান্ড নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। আর ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস, রেলওভারপাসসহ পুরো সড়কে লাইটের ব্যবস্থা করার বিষয়টি নতুন করে যুক্ত হয়েছে। পাশাপাশি ভ্যাট, আইটি ও কাস্টমস ডিউটি খাতে ব্যয় বেড়েছে, বাস্তবায়ন বিলম্বের কারণে পরামর্শক সেবা ও ঠিকাদারের চুক্তিমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে সরকারি অর্থায়ন কমবে, তবে বৈদেশিক সহায়তা বৃদ্ধি করতে হবে। তবে সব মিলিয়ে মোট প্রকল্প ব্যয় পরিবর্তন হবে না বলে বৈঠকে জানানো হয়।

এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বৈঠকে উপস্থিত একজন অতিরিক্ত সচিব জানান, প্রকল্পটির পরিকল্পনায় নানা ধরনের ত্রুটি ছিল। ফলে এটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দফায় দফায় সংশোধন করতে হয়েছে। তবে এজন্য দায়ী কাউকে শাস্তি দেওয়া হয়নি। এক্ষেত্রে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তারা প্রকল্প গ্রহণে ভবিষ্যতে আরও সতর্ক হতো।

উল্লেখ্য, জয়দেবপুর-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা প্রকল্পটি পাঁচটি প্যাকেজে বিভক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে চারটি প্যাকেজের আওতায় ৭০ কিলোমিটার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ ছাড়াও ৫৩টি ছোট-মাঝারি সেতু, ৯টি ফ্লাইওভার, দুটি রেলওয়ে ওভারপাস, ৭৬টি কালভার্ট, ১৩টি আন্ডারপাস ও ছয়টি স্টিল ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করার কথা ছিল। তবে এ পরিকল্পনা সংশোধন করা হচ্ছে। অপর প্যাকেজের আওতায় সওজের প্রধান কার্যালয় নির্মাণ করা হচ্ছে।