ইসমাইল আলী: ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর অংশটির চার লেন নির্মাণ প্রকল্প নেয়া হয় ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে। তবে ভুল পরিকল্পনার কারণে চার বছরের মাথায় প্রকল্পটি সংশোধন করতে হয়েছে। এতে গত অক্টোবরে প্রকল্পটির ব্যয় বেড়েছে চার হাজার ৭৬৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। বাড়ানো হয়েছে প্রকল্পটির মেয়াদও। ভুল পরিকল্পনার জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করতে গত নভেম্বরে তদন্ত কমিটি গঠন করে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। তবে ওই কমিটি দায়সারাভাবে প্রতিবেদন জমা দিয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে গেছে।
সম্প্রতি এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম। পাশাপাশি ভুল পরিকল্পনায় জড়িতদের চিহ্নিত করতে আবার নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৭ জানুয়ারি নতুন চিঠি ইস্যু করা হয়।
চিঠিতে বলা হয়, গত ৬ নভেম্বর সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের (উন্নয়ন) নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ শীর্ষক প্রকল্প এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করে। আর গত ২৯ নভেম্বর সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি। কার্যপরিধি অনুযায়ী, কমিটি প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরামর্শকের কার্যক্রমে ভুলত্রুটি নির্ণয়সহ আনুষঙ্গিক বিষয়াদি পরীক্ষা করে দেখবে এবং দায়দায়িত্ব নিরূপণ করবে; ডিজাইন প্রণয়নের সময় ভূমি অধিগ্রহণের জন্য নির্ধারিত পরিমাণ ও বাস্তবে প্রয়োজনীয় পরিমাণে তারতম্য হয়ে থাকলে সে বিষয়ে দায়িত্ব নিরূপণ করবে এবং সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর থেকে ভূমির পরিমাণ নির্ধারণ ও ম্যাপ প্রস্তুত যথাযথ হয়েছিল কি না, তা পরীক্ষা করে দেখবে। কিন্তু কমিটির দাখিলকৃত প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশে কার্যপরিধির উল্লিখিত বিষয়গুলো যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়নি।
চিঠিতে আরও বলা হয়, সচিবের নির্দেশনা অনুযায়ী নথি উপস্থাপনের লক্ষ্যে উপরোক্ত তথ্যাদি জানা প্রয়োজন। এ অবস্থায় বিষয়সংশ্লিষ্ট রক্ষিত নথি পর্যালোচনা করে উপরোক্ত তথ্যাদি আবার প্রেরণের জন্য অনুরোধ করা হলো।
তথ্যমতে, এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১১ হাজার ৮৯৯ কোটি এক লাখ টাকা। তবে গত অক্টোবরে প্রকল্পটি সংশোধন করায় ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ হাজার ৬৬২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ নির্মাণ ব্যয় বেড়ে গেছে চার হাজার ৭৬৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা বা ৪০ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। পাশাপাশি প্রকল্পটির মেয়াদও বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর করা হয়েছে।
ব্যয় বৃদ্ধির অন্যতম কারণ ছিল জমি অধিগ্রহণ পরিমাণ বৃদ্ধি। প্রাথমিকভাবে প্রকল্পটিতে জমি অধিগ্রহণের পরিমাণ ধরা হয়েছিল ১৯৮ দশমিক ৯৪ হেক্টর ও ব্যয় দুই হাজার কোটি টাকা। তবে সংশোধিত হিসাবে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২৬ হেক্টর এবং ব্যয় চার হাজার ২৫৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এছাড়া নতুন করে ২০টি কালভার্ট নির্মাণ অন্তর্ভুক্ত করা, ধীরগতির যানবাহনের জন্য সেতুতে পৃথক লেনের ব্যবস্থা করা, মহাসড়কটিতে ড্রেনেজ ব্যবস্থা যুক্ত করা, অতিরিক্ত সাতটি জরাজীর্ণ সেতু আবার নির্মাণ করা, হাটিকুমরুল ইন্টারচেঞ্জের নকশা পরিবর্তন, সড়ক গবেষণাগার ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের নকশা পরিবর্তন, ধীরগতির যান চলাচলের জন্য পৃথক লেনের প্রস্থ বৃদ্ধি করা এবং দুটি রেল ওভারপাসের উচ্চতা বৃদ্ধি করাও নতুন করে যুক্ত হয়েছে।
তদন্ত কমিটি এসব বিষয় পর্যালোচনা করে জানায়, সাসেক-২ প্রকল্প বাস্তবায়ন আরম্ভ হওয়ার আগে ডিজাইন রিভিউ করা হয়নি। প্রকল্প কর্তৃপক্ষের বক্তব্য অনুযায়ী ডিজাইন রিভিউ করার জন্য আলাদা কোনো প্যাকেজ বা পরামর্শক নিয়োগের সংস্থান ছিল না। তাই সুপারভিশন পরামর্শকের মাধ্যমে ডিজাইন রিভিউ করা হয়েছে এবং সে সময় ডিজাইন-সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সংশোধনগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে।
পর্যালোচনায় আরও বলা হয়েছে, ডিজাইনকালে ডিজাইন পরামর্শক কর্তৃক প্রণীত ডিজাইনের সীমাবদ্ধতাগুলো দূরীকরণের উদ্যোগ গ্রহণের কারণে প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বৃদ্ধি পেয়েছে। ডিজাইনকালে সওজের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকল্প প্রণয়নকারী ইউনিট কর্তৃক যথাসময়ে প্রকল্পের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা চিহ্নিত করা হয়নি এবং যথাযথভাবে ডিজাইন বুঝে নেয়া হয়নি। এক্ষেত্রে ডিজাইন ত্রুটির বিষয়ে ডিজাইন পরামর্শকের বক্তব্য গ্রহণ করা যেতে পারে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
যদিও ভুল পরিকল্পনার কারণ এবং কারা এজন্য দায়ী, তা তদন্ত কমিটি চিহ্নিত করেনি। জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত (উন্নয়ন) চন্দন কুমার দে শেয়ার বিজকে বলেন, তদন্তের বিষয়টি কয়েক মাস আগের ঘটনা। মূলত জমি অধিগ্রহণে প্রাক্কলন ও বাস্তব অবস্থার মিল ছিল না কেন, তা খতিয়ে দেখার কথা ছিল। আরও কিছু বিষয় ছিল। মাত্র এক দিন ফিল্ড ভিজিট করে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে, তাই কিছু ঘাটতি থাকতে পারে। তবে কয়েক মাস পেরিয়ে যাওয়ায় এখন বিষয়টি স্পষ্ট মনে নেই। আর প্রতিবেদন না দেখে মন্তব্য করাও সম্ভব নয়।
উল্লেখ্য, পাঁচ সদস্যের কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) চন্দন কুমার দে। সম্প্রতি তিনি পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের বদলি হয়ে গেছেন। কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন একজন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের প্রতিনিধি, একজন পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের প্রতিনিধি এবং দুজন সওজের প্রতিনিধি।
সূত্র জানায়, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিবের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে প্রকল্পটির ভুলের জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যৌথভাবে যাচাই করেছে অস্ট্রেলিয়ার স্ম্যাক ইন্টারন্যাশনাল পিটিওয়াই লিমিটেড, দক্ষিণ কোরিয়ার পিয়াংহওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালটেন্টস লিমিটেড ও বাংলাদেশের এসিই কনসালটেন্টস লিমিটেড।
এদিকে সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনটি বুঝে নেয়ার দায়িত্বে ছিলেন সওজের টেকনিক্যাল অ্যাসিসটেন্স ফর সাব-রিজিওনাল রোড ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট প্রিপারেটরি ফ্যাসিলিটি-২ প্রকল্পের চার প্রকৌশলী এবং সওজের পরিকল্পনা বিভাগের চার প্রকৌশলী। প্রকল্পের চারজনের মধ্যে ছিলেনÑসহকারী প্রকৌশলী শাইকা শ্রকিয়া, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ফায়াজ আহমেদ, নির্বাহী প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) মোহাম্মদ নাজমুর হক ও প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, চলতি দায়িত্ব) মো. মাসুদ হায়দার। আর সওজের পরিকল্পনা বিভাগের চারজন হলেনÑউপবিভাগীয় প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, নির্বাহী প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) ফাহমিদা হক, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) মো. রবিউল আলম এবং অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আবুল কাশেম।
জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন অতিরিক্ত সচিব। এছাড়া পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিনিধিও কমিটিতে ছিলেন। তারা দায়িত্ব না নিলে এ বিষয়ে বাকিদের তেমন কিছু করার থাকে না। তবে এবার সচিবের কড়াকড়ি থাকায় প্রকল্পটির ডিপিপি ও সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন থেকে সংশ্লিষ্টদের চিহ্নিত করা হয়েছে।