Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 9:32 pm

ভুল সমীক্ষায় ড্রেজিংয়ে জটিলতা

দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দর কর্ণফুলী নদীর মোহনায় অবস্থিত। এ বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম সম্পাদন হয় ৯২ শতাংশেরও বেশি। তাই কর্ণফুলী নদীতে নৌ-বাণিজ্য কার্যক্রম বজায় রাখতে নিয়মিত ড্রেজিং বা খনন করা প্রয়োজন। কিন্তু নানা জটিলতায় ব্যাহত হচ্ছে ড্রেজিংয়ের কাজ। এতে সংকুচিত হচ্ছে কর্ণফুলী, ভোগান্তিতে পড়ছে নগরবাসী। ফলে বন্দর ব্যবসায়ীরা গুনছেন আর্থিক লোকসান। বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করে শেয়ার বিজ। এ নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: কর্ণফুলী নদীর সদরঘাট-বাকলিয়ারচর ড্রেজিং প্রকল্প সমীক্ষায় বুয়েটের পরামর্শকদল বলেছে, নদীটিতে প্রায় চার মিটার পর্যন্ত পলিথিনের স্তর রয়েছে। এ স্তরকে ভিত্তি ধরে ২০১৮ বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সদরঘাট টু বাকলিয়ারচর ড্রেজিং’ প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ড্রেজিং করতে গিয়ে মিলেছে নদীর সাত মিটার পর্যন্ত পলিথিন বর্জ্য। এক বছরে কাজ করতে গিয়ে বিকল হয়েছে একাধিক ড্রেজার। আবার আনতে হয়েছে সাকশন কাটার। সেটিও ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে চীনে। ৬৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৫ মাসে প্রকল্প অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ১৮ শতাংশ!   

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চিফ হাইড্রোগ্রাফারের অফিস সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে কর্ণফুলী নদীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং হয়নি। দীর্ঘদিন ড্রেজিংবিহীন থাকায় প্রচুর পলি জমে নদীর বিভিন্ন অংশে চর জেগেছে। ২০১৭ সালে বুয়েটের বিশেষজ্ঞদল দিয়ে সমীক্ষা চালানোর পর তাদের পরামর্শ অনুযায়ী ‘সদরঘাট টু বাকলিয়ারচর ড্রেজিং’ প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ওই সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, নদীতে সর্বোচ্চ চার মিটার পর্যন্ত পলিথিনের স্তর থাকবে। এ স্তরকে ভিত্তি ধরে ২০১৮ বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সদরঘাট টু বাকলিয়ারচর ড্রেজিং’ প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ড্রেজিং করতে গিয়ে মিলেছে নদীর সাত মিটার গভীরে পলিথিনের বর্জ্য পদার্থ। এর মধ্যে প্রথম ৯ মাসে প্রকল্পের অগ্রগতি হয় ৩১ শতাংশ। এ সময় কাজ করতে গিয়ে বিকল হয়েছে একাধিক ড্রেজার। শুরুতে ২০ থেকে ২৬ ইঞ্চি ব্যাসের তিনটি ড্রেজার দিয়ে কাজ শুরু হলেও পরে ৩২ ইঞ্চি ব্যাসের ড্রেজার ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ড্রেজিং এলাকায় অতিরিক্ত পিলথিন, প্লাস্টিক ও অন্যান্য কঠিন বস্তু থাকায় ওইসব ড্রেজার পূর্ণ সক্ষমতায় ব্যবহার করা যায়নি। অথচ ঘণ্টায় দুই হাজার ৫০০ কিউবিক ফুট ড্রেজিংয়ের সক্ষমতা ছিল। বাস্তবে ড্রেজার ছয় ঘণ্টায় চার হাজার কিউবিক ড্রেজিং করা অনেক কঠিন ছিল। অনেক সময় মেশিন কিছুক্ষণ পরপর বন্ধ হয়ে যেত। আবার চালু করলেও একই অবস্থা হতো। ২০১৮ সালের নভেম্বরে ৩১ ইঞ্চি ব্যাসের শক্তিশালী সাকশন ড্রেজার আনার কথা থাকলেও সেই ড্রেজার আসে নির্ধারিত সময়ের পাঁচ মাস পর গত বছরের মার্চের মাঝামাঝি। এরপর আরও দুই মাস লেগে যায় ওই ড্রেজার দিয়ে খননকাজ শুরু করতে। এ সময় বেশ ক’মাস কাজ বন্ধ ছিল। সেটিও ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে চীনে। এতে আগের ড্রেজিংকৃত এলাকা আবার বর্জ্যে ভরাট হয়ে যায়। বর্তমানে পুরোনো পদ্ধতিতে, অর্থাৎ লোকাল গ্র্যাব ড্রেজার দিয়ে করা হচ্ছে ড্রেজিং। ফলে গত জানুয়ারি পর্যন্ত ৬৪ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ১৮ শতাংশ! আর এসব জটিলতার কারণে পদে পদে ব্যাহত হচ্ছে ২৪২ কোটি টাকার প্রকল্প। এতে সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা। বাড়তে পারে ব্যয় ও সময়। 

প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা জানান, সদরঘাট থেকে বাকলিয়ারচর পর্যন্ত প্রায় আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২৫০ মিটার চওড়া এলাকায় এ ড্রেজিং কাজ চলমান। কিন্তু এ কাজের প্রধান বাধা হচ্ছে পলিথিন। ড্রেজার দিয়ে মাটি তুলতে গিয়ে আসে পলিথিন। বারবার ড্রেজিং করেও মাটির নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। নদীর চার ফুটের বেশি গভীরে গিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না মাটি। চার-পাঁচ ফুট পলিথিনের স্তরের জন্য ড্রেজারের কাঁটা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এ কারণে বদলাতে হয় ড্রেজারও। পরে ৩১ ইঞ্চি ব্যাসের শক্তিশালী সাকশন ড্রেজার আনা হলেও পাওয়া যায়নি প্রত্যাশিত সাফল্য। সেটিও ফিরে গেছে। এক্ষেত্রে বুয়েটের সমীক্ষাকারী টিম বলেছে, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে জমে থাকা পলিথিন, ময়লা ও প্লাস্টিক-জাতীয় বিভিন্ন জিনিসের স্তর আছে চার মিটার। কিন্তু বাস্তবে সাত মিটার পর্যন্তও পাওয়া যাচ্ছে পলিথিনের আবরণ। আসলে তাদের সমীক্ষা প্রতিবেদন ভুল ছিল। তারা ২০১২ সালের পুরোনো ও সেকেন্ডারি তথ্য দিয়ে সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। তাদের ভুল তথ্যের কারণে আমাদের প্রকল্পে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের চিফ হাইড্রোগ্রাফার কমান্ডার এম আরিফুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন বিষয়ে বুয়েটের একটি সমীক্ষা প্রতিবেদনে নদীর চার মিটার পর্যন্ত পলিথিন থাকার কথা বলা হয়েছিল। কর্ণফুলীতে ড্রেজিং করতে গিয়ে দেখছি মাটির উপরিস্থলে সাত মিটার পর্যন্ত পলিথিনের স্তর জমেছে। আর এই পলিথিনই খননকাজে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথমে খননকাজ ২০ থেকে ২৬ ইঞ্চি ব্যাসের তিনটি ড্রেজার দিয়ে শুরু হলে পরে ৩২ ইঞ্চি ব্যাসের ড্রেজার ব্যবহার করা হয়। চীন থেকে আনা নতুন সাকশন ড্রেজারটিও পলিথিন আটকে কিছু সময় পরপর বন্ধ হয়ে যেত। এখন গ্র্যাব ড্রেজার মাটি উত্তোলনে কাজ করছে। তিনি বলেন, প্রথম ৯ মাসে এ প্রকল্পের অগ্রগতি ছিল ৩১ শতাংশ। পরে তিন মাসে দেখা যায় খননকৃত স্থানগুলো ভরাট হয়ে যায়। ফলে ১৫ মাসে প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ১৮ শতাংশ।

ভুল সমীক্ষা প্রতিবেদন বিষয়ে বুয়েটের শিক্ষক আতাউর রহমানের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও সংযোগটি ব্যস্ত পাওয়া গেছে। ফলে তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি। 

উল্লেখ্য, কর্ণফুলী নদীর নাব্য ফেরাতে প্রায় ২৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘সদরঘাট টু বাকলিয়ারচর ড্রেজিং’ শিরোনামের প্রকল্প গ্রহণ করে চবক। ই-ইঞ্জিনিয়ারিং ও চায়না হারবার নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পের আওতায় সদরঘাট থেকে উজানের দিকে বাকলিয়ার হামিদচর পর্যন্ত প্রায় আড়াই কিলোমিটার এলাকা খনন করে ৪২ লাখ ঘনমিটার পলি ও মাটি তোলার কথা রয়েছে, যাতে চার বছরে সম্পূর্ণ ড্রেজিং কাজ শেষ হবে।