Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 9:26 pm

ভুয়া কাগজপত্রের বিপরীতে ঋণ: সোনালী ব্যাংকের সাড়ে ৫ কোটি টাকা বেহাত!

 

রিজাউল করিম: ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক থেকে নেওয়া হয়েছে সাড়ে ৫ কোটি টাকা ঋণ। ব্যাংকের গাজীপুর কোর্ট বিল্ডিং শাখা থেকে স্থানীয় প্রভাবশালী রফিকুল ইসলাম ঢালী এ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ঘটনা তদন্তে গঠিত তিন সদস্যের কমিটি ইতোমধ্যেই ঋণের বিপরীতে বন্ধকী জমির ভুয়া বণ্টকনামার প্রমাণ পেয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় ভুয়া কাগজপত্রের বিপরীতে ঋণ প্রদানে ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছিল কিনা- তা খতিয়ে দেখতে পৃথক আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে যাচ্ছে সোনালী ব্যাংক প্রধান

কার্যালয়। ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, শ্রীপুর উপজেলার গাড়ারন সাতখামাইর এলাকার রফিকুল ইসলাম ঢালীর ওয়ারিশ সূত্রে পাওনা জমির পরিমাণ হচ্ছে ১৩৯ শতাংশ। কিন্তু জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে নিজের নামে জমি দেখিয়েছেন ৩৯৪ শতাংশ। জালিয়াতির মাধ্যমে ২৫৫ শতাংশ জমি বেশি দেখিয়ে গাজীপুরের সোনালী ব্যাংকের কোর্ট বিল্ডিং শাখা থেকে ঋণ নিয়েছেন তিনি। নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সিটিজি কনজ্যুমার অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্ট লিমিটেড, ফ্লাওয়ার মিলস এবং ঢালী অ্যাগ্রো কমপ্লেক্সের বিপরীতে জমি বন্ধক দিয়ে এ ঋণ নেওয়া হয়। ওয়ারিশদের বিরোধপূর্ণ ওই জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে সিটিজি কনজ্যুমার অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্ট লিমিটেড। শ্রীপুর উপজেলার ৬নং ওয়ার্ড গাড়রন এলাকায় কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। এদিকে ঋণ গ্রহণের পর ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও ওই ব্যবসায়ী এখন ঋণের টাকা পরিশোধ করছেন না। ফলে বেহাত হয়ে যাচ্ছে সোনালী ব্যাংকের সাড়ে ৫ কোটি টাকা।

তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের গাজীপুর প্রিন্সিপাল শাখার অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার উত্তম কুমার সাহা বলেন, ‘তদন্ত শেষের পথে। দুই চারদিনের মধ্যেই আমরা প্রতিবেদন দিয়ে দেব।’

তিনি বলেন, জমির দলিলে অসঙ্গতি রয়েছে। এ ছাড়া ১৬ জনের জায়গায় তিনজনকে দেখিয়ে জমির ঘরোয়া বণ্টননামা করা হয়েছে। ব্যাংকে যে বণ্টননামা দেওয়া হয়েছে তা রেজিস্ট্রি করা ছিল না। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই ঋণ দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকের উচিত ছিল কাগজপত্রগুলো যাচাই-বাছাই করা। এক্ষেত্রে সেটা করা হয়নি’- বলে মন্তব্য করেন উত্তম কুমার সাহা।

এদিকে ঋণ জালিয়াতির বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযোগ অস্বীকার করেন রফিকুল ইসলাম ঢালী। তিনি বলেন, ‘আমি বৈধ কাগজপত্র দেখিয়েই ঋণ নিয়েছি। সব জমি আমার। বৈধ কাগজপত্র দেখিয়েই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছি। কারো এক ইঞ্চি জমিও নেইনি। সোনালী ব্যাংক ঋণ দেওয়ার আগে দুইবার তদন্ত করেছে। এখানে কোনো অসঙ্গতি নেই।’

জানা গেছে, পাঁচ ভাই, তিন মা, এক বোনের উত্তরসূরিসহ ১ হাজার ২৬০ শতাংশ জমির মালিক ১৬ জন। অথচ রফিকুল ইসলাম ঢালী তিনজন উত্তরসূরি দেখিয়ে জমির ভুয়া বণ্টননামা ও দলিল করে সোনালী ব্যাংকে তিন ধাপে ঋণ নেন। ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ব্যবসায়ীকে এ ঋণ দেন। গাজীপুরের কোর্ট বিল্ডিং শাখায় প্রথম দেওয়া হয় ৭০ শতাংশ জমির ভুয়া কাগজপত্র, এরপর ৫২ শতাংশ এরপর ২৭২ শতাংশ জমির কাগজপত্র। কেবল উত্তরসূরিদের জমিই নয়, প্রথম দফায় ব্যাংকে জমা দেওয়া জমির কাগজপত্রের মধ্যে রাজধানী মহাখালীর আরজতপাড়ার ব্যবসাহী মোসলে উদ্দিন মিশনের ৩২ শতাংশ জমিও রয়েছে। ব্যাংক থেকে রফিকুল ইসলাম ঢালী ঋণ নেওয়ার পর জালিয়াতির বিষয়টি জানতে পারেন মোসলে উদ্দিন মিশন। অথচ ২০১৩ সাল থেকে ওই জমি মোসলে উদ্দিন মিশনের দখলে। জমি এলাকায় মোসলে উদ্দিন সীমানাপ্রাচীর ও সাইনবোর্ডও স্থাপন করেছেন।

রফিকুল ইসলামের ভাতিজা নোমান আলী ঢালী বলেন, আমার বাবা, রফিকুল ইসলাম ঢালীসহ চার চাচা, ফুফু ও তিন দাদি ওই ১১ দশমিক ৯৮ একর জমির অংশীদার। কিন্তু ওই জমি এখনও ভাগবাটোয়ারা হয়নি। তিনজনের নামে ভুয়া বণ্টননামা দেখিয়ে চাচা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন।

চাচা রফিকুল ইসলাম ঢালীর জালিয়াতির কথা তুলে ধরে নোমান ঢালী অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক বিভাগের সচিব বরাবর গত বছরের ১২ ডিসেম্বর লিখিত অভিযোগ দেন। অপর ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী মোসলেহ উদ্দিন মিশনও একই দফতরে প্রতিকার চেয়ে চিঠি দেন। এ দুই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ গত ১২ জানুয়ারি সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে তদন্তপূর্বক এক মাসের মধ্যে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেয়। এর আগে ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখা থেকে ৬ ডিসেম্বর তদন্তের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে সোনালী ব্যাংক গত বছরের জানুয়ারিতে সোনালী ব্যাংকের গাজীপুর শাখার অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার উত্তম কুমার সাহা, আবদুল মাজেদ, সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার জামাল উদ্দীনকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলে। তিন কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও ১ মাসেও প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি গাজীপুরের সোনালী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের প্রধান শাখার ডিজিএম সাইদুর বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে। আমরা প্রতিবেদনের অপেক্ষায় আছি। কারো বিরুদ্ধে অনিয়মের প্রমাণ পেলে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেব। ওই ঋণ বিতরণে তৎকালীন কোনো সম্পৃক্ততা অনিয়ম করেছেন কি না -তা খতিয়ে দেখা হবে। প্রমাণ পেলে আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যাংকে ঋণ থাকার পরও কারখানা ও সমুদয় জমি নুরুল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করার চেষ্টা করছেন রফিকুল ইসলাম ঢালী। এরই মধ্যে রফিকুল ইসলাম ঢালী ৮০ লাখ টাকা অগ্রিম নিয়েছেন। অথচ ওই জমির প্রকৃত বণ্টননামা হয়নি।

এ বিষয়ে ক্রেতা নুরুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ব্যাংক তাদের ঋণের টাকা তুলতে চাইছে। এই কারণে রফিকুল ইসলাম ঢালী জমি বিক্রি করতে চাইছে। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, ঋণ উত্তোলন প্রক্রিয়ায় ঝামেলা আছে। রফিকুল ইসলাম ঢালী যতটুকু জমির মালিক আমরা কেবল সেইটুকু কিনব। বাকি জমিগুলো কিনতে চাই না।’

‘রফিকুল ইসলামের অংশের জমি কিনলে ব্যাংকের ঋণ শোধ হবে কি না’ -জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না। রফিকুল ইসলামের যেটুকু জমি এতে ব্যাংকের টাকা শোধ হবে না।’