ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে বৃক্ষ

মাছুম বিল্লাহ ভূঞা: সব শোষণ নেতিবাচক নয়, শোষণ ইতিবাচকও হয়ে থাকে। যেমন, বৃক্ষ ও বনভূমি, জলাশয়, নদী এবং সমুদ্রের শোষণ। এগুলো ভূপৃষ্ঠ থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও ক্লোরোফ্লোর কার্বন জাতীয় ক্ষতিকর গ্যাস শোষণ করে মানুষসহ প্রাণ-প্রকৃতি বাঁচতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

শুধু আমাজন বনই বছরে ৬০ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড ভূপৃষ্ঠ থেকে শোষণ করে, আর সমুদ্রগুলো বছরে ৩০০ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড ভূপৃষ্ঠ থেকে শোষণ করে থাকে। তেমনি সব নিঃসরণ ভালো নহে; যেমনঃ যন্ত্র ও যন্ত্রদানব ব্যবহারের কারণে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ। আবার সব নিঃসরণ খারাপও নয়, যেমন: বৃক্ষ ও  বনভূমি কর্তৃক প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় অক্সিজেন নিঃসরণ।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সারা পৃথিবী যেখানে টেকসই উন্নয়নের পথে ধাবিত হচ্ছে, সেখানে তথাকথিত উন্নয়নের নামে প্রতিনিয়ত বৃক্ষ নিধন, নদী ও জলাশয় ভরাট করে ইমারত বা ইটভাটা নির্মাণ করে আমরা পরিবেশকে বিপন্ন করে তুলেছি। পরিবেশের ক্রমবর্ধমান অবনতি মানব জাতি ও সমস্ত প্রাণীকূলের জন্য হুমকিস্বরূপ। এই পরিস্থিতির একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হলো পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত আমাজান বনে আগুন লাগানো।

এখন বাংলাদেশে বর্ষাকাল বিরাজ করছে। তারপরও সূর্যের প্রখর তাপদাহে প্রকৃতি এক ভয়াল মূর্তি ধারণ করেছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা, রাজশাহীসহ উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের ওপর দিয়ে তীব্র তাপদাহ বয়ে চলেছে। রাজশাহীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৩ ডিগ্রি ও ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফলে প্রকৃতিও বিরূপ আচরণ করে, যার পরিণাম বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এদিকে ভয়াবহ এ তাপদাহে মানুষ ও পশুপাখির জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ঘরবাড়ির জিনিসপত্র রোদের তাপে উত্তপ্ত হয়ে থাকছে। শহরগুলো তাপদ¡ীপে পরিণত হয়েছে বলা যায়। এজন্য সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষ। কাজে বের হতে না পারলে ঘরে অনাহারে থাকতে হয়। তাই বাধ্য হয়েই প্রচণ্ড উত্তাপের ভেতরে তাদের কাজে নামতে হচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে গত ১৮ বছরে রাজধানী ঢাকা শহরের ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা চার থেকে সাড়ে পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে, উক্ত তথ্য প্রকাশ করে বিএসএমআর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর গবেষণা প্রতিবেদনে।

একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকার কথা থাকলেও বাংলাদেশে আছে মাত্র ১৬ শতাংশ। আর রাজধানীকে আলাদা একটি ভূখণ্ড ধরা হলে বনভূমি বা গাছপালার পরিমাণ ২ শতাংশও হবে বলে মনে হয় না। যেটুকু আছে তাও ধীরে ধীরে বিভিন্ন কলকারখানা, ইটভাটা আর বসতবাড়ি ও উন্নয়নের নামে অবকাঠামো স্থাপনের জন্য উজাড় হয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য শহরগুলো ও তার আশপাশে গাছপালা প্রায় নেই বললেই চলে।

নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের পরিণামে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে বিশ্ব। প্রতি বছর পৃথিবী থেকে ৬৪ লাখ হেক্টর বনভূমি হারিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের হিসাবে, প্রতি মিনিটে ধ্বংস হচ্ছে প্রায় ১০ হেক্টর বনভূমি। সবুজ বৃক্ষ ও বনভূমি কমে যাওয়ায় বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণও দিন দিন বাড়ছে, আর কমছে অক্সিজেনের পরিমাণ। জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ বৃক্ষ নিধন। গবেষকরা বলছেন, ১০০ বছরে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা দশমিক ৩ ডিগ্রি থেকে দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়ার বেড়েছে। এ ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে এই শতক শেষে পৃথিবীর তাপমাত্রা গড়ে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি বেড়ে যেতে পারে। একটি গাছ ২৬০ পাউন্ডের বেশি অক্সিজেন প্রকৃতিতে ছেড়ে দেয়।

ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের প্রায় ৩০ শতাংশ এলাকাজুড়ে বনভূমি ছড়িয়ে আছে। প্রায় ১১ হাজার বছর আগে পৃথিবীতে কৃষি উদ্ভবের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৪০ শতাংশ বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ বন উজাড় হয়েছে গত দুই দশকে। মানুষের আবাসস্থল, চাষের জন্য জমি, কল-কলকারখানা স্থাপন, বনদস্যুদের দৌরাত্ম্য, কাঠের ব্যবহারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা কারণে নিধন হচ্ছে গাছপালা। নির্বাচারে গাছপালা কেটে ফেলায় প্রতিবেশের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ফলে বনে বাস করা পৃথিবীর ৭০ শতাংশ প্রাণীর মধ্যে অনেক প্রজাতিই তাদের আবাস হারিয়ে প্রায় বিলুপ্তির পথে। পানি চক্র, ভূমি ও মানুষের জীবন মানের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।

পৃথিবীর ফুসফুস হিসেবে খ্যাত এই আমাজান বনে ব্রাজিল সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল। এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে বৈশ্বিক কার্বন চক্রে। আমাজান বন উজাড় হওয়ার কারণে গাছ থেকে অক্সিজেন সরবরাহ অনেক কমছে, কমছে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণও, উত্তপ্ত হচ্ছে বায়ুমণ্ডল। মানবসৃষ্ট এই কারণ, যার ফলে বায়ুমণ্ডলে ৬ থেকে ১৭ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হচ্ছে। যদিও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২০৩০ সাল নাগাদ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ‘সবার জন্য একটি আরও ভাল এবং আরও টেকসই ভবিষ্যৎ অর্জনের জন্য নীলনকশা’ হিসাবে ডিজাইন করা ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। যার ১১ নম্বর হচ্ছে টেকসই শহর ব্যবস্থাপনা; ১৩ নম্বর লক্ষ্যমাত্রায় জলবায়ু বিপর্যয় রোধ; ১৫ নম্বর লক্ষ্যমাত্রায় ‘ স্থলজ বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার ও সুরক্ষা প্রদান, টেকসই বন ব্যবস্থাপনা, মরুকরণ প্রক্রিয়ার মোকাবিলা এবং জীববৈচিত্র্য হ্রাস প্রতিরোধ’ ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

তারপরও অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে হিমালয় ও মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে এবং বাড়ছে সমুদ্রের উচ্চতা। ধেয়ে আসছে জলোচ্ছ্বাস, তলিয়ে যাচ্ছে নি¤œাঞ্চল। নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় ফণীর ছোবল থেকে আমাদের অনেকাংশে রক্ষা করেছে সুন্দরবন। সহজেই বোঝা যাচ্ছে বনভূমির গুরুত্ব কত অপরিসীম! পরিবেশের গুণগত ও পরিমাণগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এর অবনতি রোধও এখন আবশ্যিক হয়ে পড়েছে। তাই প্রকৃতির করালগ্রাস থেকে রক্ষা পেতে হলে বৃক্ষরোপণ, জলাধার সংরক্ষণ ও উন্নয়নসহ জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে নানা পদক্ষেপ নিতে আমাদের এখনই সুদৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।

আইনজীবী

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০