পারভীন লুনা, বগুড়া: বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার খোট্টাপাড়া ইউনিয়নের জালশুকা গ্রামের বছর ১৬ বয়সী তরুণ বিশাল কুমার। মাত্র ৫ বছর বয়সে বাবাকে হারায় সে। ক্যান্সারের কাছে তার বাবা লিটন চন্দ্র দাস মারা যাবার পর সংসারের হাল ধরেন মা সোহাগী রানী দাস।
স্বামী মারা যাবার পর বিশালের মায়ের একমাত্র সন্তানকে নিয়েই নতুন করে জীবন যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বিশালের বাপ- দাদার ভিটা বাড়ি বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার সাদুল্লাপুর গ্রামে। বিশালের বাবার চিকিৎসা জন্য সম্বল স্বরুপ ১ শতক জায়গা বিক্রি করতে হয়েছে বিশালের মাকে। স্বামী ভিটে বিক্রি করে বাবার ভিটায় আশ্রয় নেন বিশালের মা। জালশুকার হিন্দু পাড়ায় বিশালের নানার বাড়ি। স্বামী মারা যাবার পর বিশালের মা বিশালকে নিয়ে তার বাপের বাড়ি উঠেন। ৫ বছরের বিশালকে ভর্তি করিয়ে দেন জালশুকা বালক প্রাইমারি বিদ্যালয়ে। তার কদিন পড়েই মারা যান বিশালের নানা। বাবার কাছে যে আশ্রয়ের জন্য সন্তানকে নিয়ে এসেছিলেন সোহাগী রানী সেখানেও বোঝা হয়ে যান সে। বৃদ্ধা মা কে নিয়ে তখন নতুন যুদ্ধে নামেন তিনি। বিশালের মায়েরা ছিলেন ৪ বোন। কোন ভাই না থাকায় মাথার উপর বাবার রেখে যাওয়া ছোট্ট ঘর ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। তাই এক সময় বাধ্য হয়ে নিজেই নিজের কর্মের সন্ধান করে নেন। কখনো কাজ করেন মানুষের বড়িতে, কখনো চাতালে, কখনো ইটের ভাটায়, আবার কখনো বা অন্যের জমিতে।
জমিতে মরিচের সময় মরিচ তোলেন, কখনো বা কারোর বাড়িতে ঢালায়ের কাজ করেন। গড়ে প্রতিদিন ১শত টাকা থেকে দেড়শ টাকা রোজগার করেন। এই ভাবে জীবন যুদ্ধ করে বিশাল কে পড়াশুনা করান, সাথে নিজের মায়ের খরচও তিনিই চালান।
৬ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠার পর বিশাল মায়ের কাছে আবদার করে তার জন্মদিন পালন করার। ছেলের আবদারে মাও রাজি হন। ছোট্ট সেই আয়োজনে বিশাল জন্মদিনে উপহার হিসাবে কিছু টাকা পান। সেখান থেকে পাওয়া ১২০০ টাকা দিয়ে একটি ভেড়া কিনে পালন শুরু করে বিশাল। তারপর থেকে শুরু হয় ছোট্ট বিশালের নিজের ভাগ্য বদলের যাত্রা। আস্তে আস্তে সেই একটি ভেড়া থেকে বৃদ্ধি হতে থাকে ভেড়ার সংখ্যা। একসময় তাদের বাড়িতে গড়ে ওঠে ভেড়ার খামার। সে খামারে একে একে ভেড়ার সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২ টি। আর তখন কিছুটা দূর হয়েছে তাদের সংসারের অভাব। কেননা অর্থের প্রয়োজন দেখা দিলেই বিক্রি করেন ভেড়া। সেই টাকায় পরিবারের চাহিদা মেটান। এভাবেই চলছে বিশালের জীবন-জীবিকা।

কিন্তু এখনো কিছু কাজ বাকি রয়েছে। বড় খামার তৈরির মতো নিজস্ব কোনো জায়গা জমি করতে পারেননি বিশাল। নানার জায়গায় তাকে রাখতে হয় প্রিয় ভেড়াগুলো। বিশাল এবছর এস এস সি পরীক্ষা দিয়েছেন। পড়াশোনার চাপ থাকায় ভেড়ার সংখ্যা কমিয়ে দেয়ায় এখন তার ১৪ টি ভেড়া রয়েছে।
বিশাল বলেন, ভেড়া পালন করার ৬ মাস পর থেকে বাচ্চা ধারণের সক্ষমতা রাখে। ভেড়া বছরে দুই বার বাচ্চা দেয়। প্রতিবার বাচ্চা দেয় ৪/৫ টা করে। তাই তার একটি ভেড়া থেকে একাধিক ভেড়া হয়েছে। গ্রামীন জনপথ হওয়ায় টাকা খরচ করে ভেড়ার জন্য বিশালের কোন খাদ্য কিনতে হয়না। তাই ভেড়া পালনে অনেক সুবিধা রয়েছে। এরা বাড়ির আশপাশের বা ক্ষেতের আইলের বা পুকুরের ধারের নিকৃষ্ট ঘাস, গাছ-গাছড়ার পাতা, লতা-গুল্ম দিয়ে এদের খাদ্যের প্রয়োজন মেটাতে পারে। একটি পূর্ণ বয়স্ক ভেড়া ২৮ থেকে ৩০ কেজি ওজনের হয়ে থাকে এবং যার বাজার মূল্য ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। প্রতি বছর ভেড়া বিক্রি করে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় করতে পারি। কোরবানির ঈদে এই ভেড়ার চাহিদা বেশি থাকে এবং দামও ভালো পাওয়া যায়। গত পাঁচ বছরে ভেড়া বিক্রি করে সব খরচ বাদ দিয়ে ব্যংকে জমিয়েছি দুই লক্ষ টাকা।
বিশালের মা সোহাগী রানী বলেন, আমার ছেলে বিশালই আমার ভরসা। আমি যত কষ্টই হোক আমার বিশালকে পড়াশোনা করাব। বিশালকে নিয়ে আমার স্বপ্ন বিশাল বড় চাকুরী করবে।
বিশাল বলেন, যখন আমার খেলার সময় তখন আমি সংসারে কাজ করি, চরে গিয়ে ভেড়াকে ছেরে দিই, ভেড়াকে খাওয়াই। বাবা মারা যাওয়ার কারনে ছাত্রজীবনেই আমাকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। খুব কষ্ট করে আমার মা আমাকে বড় করেছেন। আমি মায়ের মনের আশা পূরন করে মায়ের মুখের হাসি ফোটাবো। বিশালের সখ সে পুলিশের চাকুরী করবে। কারন পুলিশের চাকুরী করতে এসএসসি/এইচএসসি পাস করেই পাওয়া যায়। ইচ্ছা থাকলেও সে পড়াশোনা খুব বেশি করতে পারবেনা তাই সে পুলিশের চাকুরী করতে চায়।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা ভেটেরিনারি সার্জন আব্দুস সামাদ জানান, এ উপজেলার মধ্যে বিশাল খামারী হিসেবে বয়সে সবচেয়ে ছোট। এই ছোট বয়সে বিশাল একজন সফল খামারি হয়ে গড়ে উঠেছে। তার খামারের ভেড়ার কোনো সমস্যা দেখা দিলে খামারে গিয়ে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।