ভোগান্তিতে ব্যক্তি পর্যায়ের গ্রাহক, কর্পোরেটে ব্যস্ত ডাচ-বাংলার রকেট

শেখ আবু তালেব: রাজধানীর পুরান ঢাকার নাজিরা বাজার এলাকার ডাচ-বাংলার রকেটের গ্রাহক নাজমুল আলম। রকেট সেবা নিতে দুর্ভোগের কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, হঠাৎ পাঁচ হাজার টাকা প্রয়োজন। তাই ক্যাশ আউটের জন্য পুরো এলাকা ঘুরেও কোনো এজেন্টের দেখা পেলাম না।

পরে অন্য এলাকায় গিয়ে এটিএম বুথ থেকে বের করতে হয়েছে। আবার রকেট হিসাবে ক্যাশ ইন করতেও আরো বেশি সমস্যায় পড়তে হয়। আগে কয়েকটা দোকান ঘুরলে রকেট এজেন্ট পাওয়া যেত। কিন্তু এখন পাওয়া দুস্কর। এভাবেই দুর্ভোগের কথা জানান তিনি।

একই ধরনের অভিযোগ পুরান ঢাকার আরেক গ্রাহক ফরিদুল ইসলামের। তিনি বলেন, লকডাউনে গ্রামে রকেটে টাকা পাঠাতে গিয়ে পড়ি বিড়ম্বনা। কয়েকটি এলাকা ঘুরেও কোথায় রকেটের এজেন্টের কাছে টাকা পাওয়া যায়নি। পরে বাধ্য হয়ে গ্রামের বাড়িতে ফোন করে আরেকটি মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব খুলতে বলি। পরে ওই হিসাবে টাকা পাঠাই।

মোবাইলের মাধ্যমে আর্থিক সেবা (এমএফএস) দেয়া বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং নামে পরিচিত হয়ে উঠছে। এর মাধ্যমে মোবাইল হিসাবে থাকা অর্থ স্থানান্তর, উত্তোলন, বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল ও চার্জ পরিশোধ করতে পারেন কোনো গ্রাহক।

দেশে এমএএফএস সেবা অনুমোদন হওয়ার পরে মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় প্রথম নাম লেখায় ডাচ-বাংলা ব্যাংক। ২০১১ সালের মার্চে শুরু হওয়া সেবাটির প্রথম নাম ছিল ডাচ-বাংলা ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং। ২০১৬ থেকে সেবাটির নাম হয় রকেট। প্রথম হওয়ায় প্রচারণার জোরে গ্রাহক বৃদ্ধি করে ডাচ-বাংলা।

ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বতর্মানে দেশে মোবাইলের মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তরের বাজারের ২২ শতাংশ রকেটের দখলে। এখন রকেটের সক্রিয় গ্রাহক সংখ্যা হচ্ছে ১ কোটি ৮২ লাখ। এর মধ্যে পুরুষ গ্রাহক ১ কোটি ২১ লাখ ও নারী গ্রাহক ৬১ লাখ। এসব হিসাবে গড়ে জমা থাকে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা।

অপরদিকে সারা দেশে রকেটের এজেন্ট রয়েছে ২ লাখ ৬৭ হাজারটি। যেখান থেকে গ্রাহকেরা টাকা জমা ও উত্তোলন করা যায়। এসব এজেন্ট পরিচালনা ও অর্থ সরবরাহের জন্য ২৭৭ জন পরিবেশক (ডিলার) রয়েছে। 

কিন্তু বাস্তবে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, রকেট পরিচালনায় অনেক এজেন্টদের আগ্রহ কমে আসছে। ব্যাবসা পরিচালনা করলেও রকেট পরিচালনা করছেন না। শুধু হিসাব খুলেই রাখা হয়েছে।

এক সময়ে সক্রিয় থাকলেও এখন নিস্ক্রিয় হয়ে পড়া রাজধানীর যাত্রাবাড়ির এক এজেন্ট জানান, রকেটে টাকা উত্তোলন বা পাঠাতে কম মানুষ আসে। এছাড়া ডিলারকেও সব সময় পাওয়া যায় না টাকা ঢুকাতে। তাই শুধু শুধু রকেট হিসাবে টাকা জমিয়ে রাখি না।

এমনিতে ছোট ব্যবসায়ী। অযথা ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা আটকে রাখার কোনো মানে হয় না। এই অর্থ অন্য মোবাইল ব্যাংকিংয়ে আটকে রাখলে আমার ট্রানজেকশন বাড়ে। এতে লাভও হয় বলে জানান তিনি।

এদিকে নাজিরা বাজার এলাকার এক এজেন্ট বলেন, রকেটের চার্জ কম হওয়া ও মোবাইল নাম্বারের সাথে একটা ডিজিট বেশি হওয়ায় নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে অনেকেই রকেটে আগ্রহ দেখায়। তবে বড় সমস্যা হল রকেটের ক্যাশ আউট বেশিরভাগই করা হয় এটিএম থেকে। এতে নেটওয়ার্কে টাকা থাকে না। অন্য মোবাইল ব্যাংকিংয়ে এ সমস্যা নাই। তাই লকডাউনের মধ্যে রকেটের সেবা দেওয়া যাচ্ছে না।

একাধিক এজেন্ট জানিয়েছেন, বাজারে থাকা অন্যান্য মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান বেশ কিছু সুবিধা দেয়। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে জরুরী মূহুর্তে হিসাবে টাকা না থাকলেও মোবাইলে কল দিয়েই টাকা নেয়া যায়।

কিছুক্ষণ পরে ডিলারের প্রতিনিধি এসে অর্থ নিয়ে যায়। এতে গ্রাহক সেবা বেশি দেয়া যায়। এজেন্টের ব্যবসার নিরবিচ্ছিন্নতা থাকে। গ্রাহক ধরে রাখা যায়। কিন্তু রকেটে সেই সুবিধা নেই। আর রকেটের গ্রাহক বৃদ্ধির ব্যাপারে সেরকম প্রচারণাও নেই। তাই ব্যক্তি গ্রাহক এখন রকেটের ব্যবহার এখন কমে যাচ্ছে। 

এজেন্টরাও রকেটে হিসাব খুলতে নিরুৎসাহিত করছেন গ্রাহকদের। তাদের মতে, দিন দিন পিছিয়ে পড়তে শুরু করেছে রকেট। অনেকেই রকেট হিসাব থাকার পরও তা পরিচালনা করছেন না সহজে এজেন্ট না পেয়ে। ঝুঁকছেন বাজারে থাকা অন্য দুটি কোম্পানির মোবাইল ব্যাংকিংয়ের প্রতি। যাতে প্রয়োজনে অর্থ উত্তোলন করা বা স্থানান্তর করা যায়।

জানা গেছে, রকেটের মাধ্যমে এখন বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের পণ্য বিক্রির টাকা সংগ্রহ হচ্ছে। শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন-ভাতা, সরকরি বিভিন্ন ভাতা, উপবৃত্তির অর্থ ও বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল পরিশোধ হচ্ছে। এর পরিমাণই বেশি।

বার্জার পেইন্ট, এশিয়ান পেইন্ট, ট্রান্সকম বেভারেজেস, বাটা-শু, পারফেটি ভেনমেলি বাংলাদেশ, ম্যারিকো বাংলাদেশ, বিআরবি ক্যাবলস, রানার অটোমোবাইল, প্রাইম লাইফ ইনস্যুরেন্স ও ডেলটা লাইফ ইনস্যুরেন্সের মতো ১৩০টি প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য বিক্রি ও সেবার অর্থ সংগ্রহ করতে রকেট ব্যবহার করছে।

এছাড়া ছয় শতাধিক প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হয় রকেট হিসাবের মাধ্যমে, যার বেশির ভাগই পোশাক খাতের। নোমান গ্রুপ, ফকির গ্রুপ, অ্যাপেক্স, মোহাম্মদী গ্রুপ, এসিআই, প্রাণ-আরএফএল, রানার, ডিবিএল, বেঙ্গল ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ইউএনডিপির মতো প্রতিষ্টান রকেটের সেবা নিচ্ছে।

এসব কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে সেবা দিয়েই লাভজনক রকেট। এজন্য নতুন করে প্রাতিষ্ঠানিক গ্রাহকের দিকেই বেশি নজর তাদের। এসব গ্রাহককে সেবা দেয়া সহজ। নির্দিষ্ট এসব গ্রাহকের প্রতি মাসে বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেন হচ্ছে। তাই ব্যক্তি পর্যায়ের গ্রাহকদের সেবার মান উন্নয়ন ও এজেন্ট সংখ্যা বৃদ্ধিতে খুব একটা নজর দিচ্ছে না ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বলে অভিযোগ উঠেছে। 

এ বিষয়ে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিনের সঙ্গে গত দুই সপ্তাহে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। এসএমএস ও মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০