Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 1:41 am

ভোগান্তি নিয়ে ঢাকা ছাড়ছে মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক: কভিড-১৯ মহামারি নিয়ন্ত্রণে ঈদযাত্রা ঠেকাতে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি মোতায়েন করার পরও থামেনি শিমুলিয়া ঘাটমুখী জনস্রোত।

গতকাল সরেজমিন দেখা গেছে, মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসনের সঙ্গে পুলিশ-বিজিবি রাস্তায় থাকলেও চেকপোস্টগুলোর দুই পাশে গাড়ির জটলা। বাধা পাওয়ামাত্র মানুষ গাড়ি ছেড়ে হেঁটে চেকপোস্ট পেরিয়ে ওপাশে অপেক্ষমাণ গাড়িতে গিয়ে উঠছে।

গতকাল সকাল সাড়ে ৭টায় ইকুরিয়া এলাকায় দেখা হলো ব্যাগ নিয়ে হেঁটে চলা চার তরুণের একটি দলের সঙ্গে। তারা জানালেন, সোমবার সারারাত ট্রাকে চেপে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছেন তারা, যাবেন মাদারীপুর।

তাদের একজন আব্দুল ওয়াহাব বলেন, ‘ট্রাকে এক হাজার ৯০০ টাকা ভাড়া দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নেমেছি। এরপর কোনো যানবাহন না পেয়ে ব্যাগ নিয়ে হেঁটে পোস্তগোলা সেতু পার হয়েছি। পরে একটি খালি সিএনজিচালিত অটোরিকশা পাকড়াও করেন ওই চারজন। অটোরিকশার চালক জানালেন, তিনি আব্দুল্লাহপুর টোলপ্লাজা পর্যন্ত যেতে পারবেন। ইকুরিয়া থেকে আব্দুল্লাহপুর টোলপ্লাজা পর্যন্তÑএ সামান্য পথের জন্য অটোরিকশাচালক ৪০০ টাকা চেয়ে বসলেন। অনেক অনুনয় করেও ভাড়া কমাতে পারলেন না তরুণরা।

ওয়াহাব বললেন, ‘এক হাজার ৯০০ টাকা দিয়া ট্রাকে আইসি, এখন আরও ১০০ টাকা বাড়তি লাগব। বাড়িত যাইতে শেষ পর্যন্ত কত টাকা খরচ হয় আল্লাহই জানে।’

সকালে বৃষ্টিতে তিনি ও তার দলের সদস্যরা ভিজে গিয়েছিলেন। ওই সময়ে বেশ কিছু গাড়ি টোলপ্লাজা পেরিয়ে ঘাটে গিয়ে পৌঁছাতে পেরেছে, তবে লোকজন হেঁটে যেতে পারছেন।

কভিড-১৯ সংক্রমণ রোধে ঈদ সামনে রেখে শিমুলিয়া ও পাটুরিয়া ঘাটে ঘরমুখো মানুষের ঢল ঠেকাতে শনিবার রাতে বিজিবি মোতায়েন করা হয়।

বিআইডব্লিউটিসি ওইদিন ফেরি চলাচল বন্ধ রেখেও মানুষের ঘাটে আসা ঠেকাতে পারেনি। নাছোড়বান্দা মানুষ ফেরিতে উঠে পড়লে এক পর্যায়ে ফেরি চলাচল শুরু করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।

গতকাল সকাল সোয়া ৮টার দিকে ৫টি গাড়ির একটি বহর টোল প্লাজা পার হয়। সেখানে একটি গাড়িতে পতাকা দেখা যায়। ওই গাড়িবহরের পেছনে পেছনে হেঁটে টোলপ্লাজা পেরোতেই শোনা গেল চিরচেনা হাঁকডাক ‘মাওয়া ঘাট, মাওয়া ঘাট, ২০০, ২০০’।

ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের কাজে যে ‘ডাম্পট্রাকগুলো’

ব্যবহৃত হতো, সেগুলো এখন যাত্রী বহন করছে। ট্রাকগুলোর চালক ও সহকারীরা ডাকাডাকি করছেন। কেউ চাইছেন ১০০, কারও দাবি ২০০।

২০০ টাকা কেন চাইছেন? জানতে চাইলে পিকআপ ট্রাকচালক মোহাম্মদ সোহেল যাত্রীদের বলেন, মহাসড়ক হয়ে গেলে ঘাটের ৫ কিলোমিটার আগে নামিয়ে দেবে পুলিশ। তিনি গ্রামের ভেতরের রাস্তা দিয়ে একেবারে ঘাট পর্যন্ত নিয়ে যাবেন। সে জন্যই তিনি ২০০ টাকা দাবি করছেন।

কিছুক্ষণ পর দেখা গেল একটি ট্রাকে প্রথমে রাসেল উঠলেন, পরে তার বাবাকে টেনেহিঁচড়ে তোলা হলো। কোলের শিশু নিয়ে নারীরা উঠেন সেখানে।

মোটরসাইকেলে করে প্রচুর মানুষকে ঘাটের দিকে যেতে দেখা গেল। একেকটি মোটরসাইকেলে যাত্রী হিসেবে নারীদের সঙ্গে একাধিক শিশুও রয়েছে। মোটরসাইকেলগুলোয় ব্যাগ বস্তার সঙ্গে ঝুলছে থালা-বাসন, বঁটি, শিশুদের রঙিন খেলনা, পানির বোতল, টিফিন ক্যারিয়ারও। দেখে বোঝা যাচ্ছে, একেকটি পরিবার চলছে ঈদ উদযাপন করতে।

টোল প্লাজা পেরিয়ে মানুষের স্রোত এই বাজার থেকে ট্রাক ও ব্যাটারিচালিত রিকশায় উঠছে। এর মাঝে পুলিশ এসে কয়েকটি গাড়ির চাবি নিয়ে গেল। রাস্তার ওপর গাড়িগুলো আটকে পড়ায় সামনে-পিছে বিশাল জটলা তৈরি হয়ে গেছে। চলছে হইচই, চিৎকার, ঠেলাঠেলি।

তবু বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে ফেরির কোনায় দাঁড়িয়ে পদ্মার শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌপথ পাড়ি দিচ্ছে ঈদে ঘরমুখো মানুষ।

কভিড-১৯ সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার লঞ্চ-স্পিডবোট বন্ধ করে রাখায় পদ্মার শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌপথ পার হওয়ার একমাত্র ভরসা ফেরি। দিনে বন্ধ রাখার ঘোষণা থাকলেও জনস্রোতের চাপে ফেরিও চালাতে বাধ্য হচ্ছেন বলে বিআইডব্লিউটিসির ভাষ্য।

বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া ঘাটের এজিএম মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ঈদ এগিয়ে আসায় চাপ আরও বেড়েছে। দিনে জরুরি পরিসেবার পাশাপাশি পরিস্থিতির কারণে লোকজনও পার করা হচ্ছে। ১৬টি ফেরির মধ্যে ১৫টি চলাচল করছে এখন।’

কয়েক দিন ধরে এমন চাপ থাকলেও গতকাল সেই চাপ আরও বেড়েছে।

সকালে বৃষ্টিতে খোলা ফেরিতে কাকভেজা হয়ে হাজার মানুষকে পদ্মা পাড়ি দিতে দেখা গেছে। এখানে ভোর থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। দূরপাল্লার গণপরিবহন বন্ধ থাকায় অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে ছুটছে মানুষ।

বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চেকপোস্টের বাধাও কাজে আসছে না। কভিড সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে লোকজন ছুটছে। রাতেও ছিল একই অবস্থা। রাত ৩টা পর্যন্ত ফেরিতে লোকজনের কারণে গাড়ি উঠতে পারেনি বলে জানিয়েছে পুলিশ।

ওদিকে জীবনের ঝুঁকি ও অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে ঈদ উপলক্ষে বাড়িতে ফিরছেন উত্তরাঞ্চলের মানুষ। মহামারি করোনার কারণে দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাস চলাচল বন্ধ থাকলেও মানুষ ট্রাক, মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাসে গাদাগাদি করে স্বাস্থ্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়িতে ফিরছেন।

আবার যমুনা নদী দিয়ে নৌকায় করে মানুষকে ঢাকা থেকে ফিরতে দেখা গেছে। হাইওয়ে পুলিশ ও বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম থানা পুলিশের পক্ষ থেকে এ মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই মানুষের বাড়ি ফেরা আটকানো যাচ্ছে না। মঙ্গলবার সকাল থেকে সিরাজগঞ্জে বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম সংযোগ মহাসড়কে এসব চিত্র দেখা গেছে।

ঈদের দুদিন আগে এ মহাসড়কে যানবাহনের ব্যাপক চাপ পড়ে। বিভিন্ন পয়েন্টে যাত্রীদের ভিড় লক্ষ করা গেছে। প্রতিদিন মহাসড়ক দিয়ে ৭ থেকে ৮ হাজার অতিরিক্ত যানবাহন চলাচল করছে বলে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী (টোল, দায়িত্বরত) আহসান মাসুদ বাপ্পি।

সিলেট থেকে আসা মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘হায়াস মাইক্রোবাসে চড়ে সিলেট থেকে সিরাজগঞ্জ রোডে এসেছি। ভাড়া দ্বিগুণ। সিলেট থেকে ঢাকায় আসতে লেগেছে ৩০০ টাকা। আর চান্দুরা থেকে সিরাজগঞ্জ রোড়ে আসতে খরচ হয়েছে ৫০০ টাকা। সরকার  লকডাউন  দিয়েছে সবার জন্য কিন্তু আমাদের মতো বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য তা দুর্ভোগ ছাড়া আর কিছুই নয়।  ভাড়াটা অনেক বেশি, তবু মা-বাবার সঙ্গে ঈদ করতে বাড়ি যাচ্ছি।

ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী যাত্রী সোহেল রানা বলেন, আমরা সাধারণ মানুষ। কলকারখানায় চাকরি করে খাই। লকডাউনের কারণে বাস বন্ধ রাখা হয়েছে কিন্তু মানুষ তো ঠিকই বাড়ি ফিরছে। ভাড়া লাগছে চার ডবল। ১০০ টাকার ভাড়া এখন লাগছে এক হাজার টাকা। সাধারণ মানুষের পক্ষে এ ভাড়া দেয়া অসম্ভব। এবার বাড়ি ফিরতে এত ভোগান্তি হয়েছে যে, বলার শেষ নেই।

যাত্রী রফিকুল ইসলাম বলেন, আজকে আমার ঢাকা থেকে আসা জরুরি ছিল। আমার দাদি অসুস্থ। প্রথমে ঢাকা থেকে চান্দুরা ১৫০ টাকা ভাড়া নিয়েছে। চান্দুরা থেকে মাইক্রোবাসে সিরাজগঞ্জ রোড়ে আসতে ৯০০ টাকা ভাড়া নিয়েছে।