পুরান ঢাকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আবর্তিত হচ্ছে কয়েকটি খাতকে ঘিরে। এসব খাত একদিকে যেমন অর্থনীতিতে অবদান রাখছে, অন্যদিকে কর্মসংস্থানেও রাখছে ভূমিকা। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডভিত্তিক খাতগুলো নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের তৃতীয় পর্ব
নাজমুল হুসাইন: রাজধানীসহ সারা দেশের খাদ্যপণ্যের অন্যতম জোগান আসছে পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার থেকে। বিশেষ করে তেল, চিনি, আটা-ময়দা ও অন্য খাদ্যসামগ্রী, মুদিদ্রব্য ও মসলার সর্ববৃহৎ পাইকারি বাজার এটি। প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি দোকান নিয়ে এ বাজার এখন দেশের অর্থনীতির বড় অংশ হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন এ বাজারে লেনদেন হচ্ছে প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকা।
মৌলভীবাজার থেকে ভোজ্যতেল, চিনি, লবণ, ডাল, আটা, ময়দার মতো প্রধান খাদ্যশস্যগুলো সারা দেশে সরবরাহ করা হয়। আর প্রায় ১০ হাজারের মতো ছোট-বড় পাইকারি দোকানে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার মানুষের। এদের মধ্যে একটি বড় অংশ আবার দিনমজুর।
মৌলভীবাজারে বেশিরভাগ আমদানিকৃত পণ্যের কোনাবেচা হয়। এসব পণ্য আসে চট্টগ্রাম বন্দর, মোংলা বন্দর, বেনাপোল বন্দরসহ অন্যান্য স্থলবন্দর হয়ে। আর দেশে উৎপাদিত সারা দেশের বিভিন্ন হাট থেকে পণ্য সংগ্রহ করা হয়। ট্রাকযোগে ও নৌ-পথে প্রতিদিন শত শত টন পণ্য এ বাজারে আনা-নেওয়া করা হয়।
ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে আমদানি পণ্যের প্রায় ৪০ শতাংশ ব্যবসা মৌলভীবাজারকেন্দ্রিক ব্যবসায়ীদের হাতে রয়েছে। ভোগ্যপণ্য আমদানির বাকি ব্যবসায় চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও খুলনা অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে। ওইসব এলাকা থেকে পাইকারি পণ্য কেনাবেচা হয়। ফলে আমদানিকৃত পণ্যের সব থেকে বড় বাজার মৌলভীবাজার।
এদিকে অনেকে বলছেন, আমদানি পণ্য কাস্টমস চার্জ আদায়ের পর বন্দরের আউটার থেকে আগে নৌ-পথে সব থেকে বেশি মৌলভীবাজার আসতো। এখন আবার চট্টগ্রাম বন্দর ও মাঝিরঘাট হয়ে খালাস হওয়া পণ্যের অধিকাংশ সড়কপথে বিভিন্ন এলকার বাজারে যাচ্ছে। এ ছাড়া চিনি, তেল, ডাল জাতীয় অনেক পণ্য এখন ডিলারভিত্তিক ব্যবসা হয়ে গেছে। এসব মোড়কজাত পণ্য কোম্পানি থেকে জেলার বিভিন্ন বাজারে সরাসরি সরবরাহ কাছে। ফলে ভোগ্যপণ্যের মধ্যে অধিকাংশ পণ্যের বাজার পাইকারি ব্যবসায়ীদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। এতে বেচাকেনা আগের থেকে কমে গেছে।
বাংলাদেশে বাণিজ্য জগতে শতাধিক বছর যাবৎ মৌলভীবাজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। এখানে প্রায় সব ব্যাংক ও বিমা কোম্পানি শাখা স্থাপন করেছে। প্রতিদিন সেসব শাখায় লেনদেন হচ্ছে শত শত কোটি টাকা। যা সরকারের একটি বড় আয়ের উৎস।
প্রতিদিন এ বাজারে কত টাকা লেনদেন হয় তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে জানতে চাইলে মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে দিনে এ বাজারে ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়। তবে ইদানীং কেনাবেচা একটু কম। বেশ কিছু সমস্যার কারণে ক্রেতা কমছে।’
তিনি বলেন, ‘এখানকার ব্যবসায়ীদের অধিকাংশই কোটি কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন। প্রচুর পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করছে। সারা দেশে সরবরাহ হচ্ছে। সব মিলে দেশের সব থেকে বড় বাজার সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক কার্যক্রম এখানে হচ্ছে। যা জাতীয় অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছে।’
এদিকে মৌলভীবাজার ক্রমেই জৌলুস হারাচ্ছে এমন অভিযোগ অনেকেরই। একক আধিপত্য থাকলেও এ পাইকারি বাজার এখন নানা সমস্যায় ভারাক্রান্ত। এতে পাইকারি পণ্যের বৃহত্তম এসব বাজারে কমছে ব্যবসা-বাণিজ্য। অন্যান্য সমস্যার সঙ্গে যানজট, রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং অব্যবস্থাপনার কারণ বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ী আবুল হাসান বলেন, ‘এ বাজারের প্রধান সমস্যা হলো এখানে গাড়ি পার্কিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। বাজারের রাস্তাগুলোও খুব সরু, ফলে সর্বদা যানজট লেগে থাকে। ফলে স্বাভাবিক পণ্য পরিবহন ব্যাহত হয়। অনেক ব্যবসায়ী এ বাজারে আসতে চান না।’
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, মৌলভীবাজারে পণ্য পরিবহন সমস্যা বড় আকার ধারণ করেছে। চকবাজার থেকে শুরু করে চারপাশের সব রাস্তা খুব ব্যস্ত থাকে। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা ব্যবসায়ীরা এখানে এসে মালামাল কিনে দ্রুত যেতে চান। কিন্তু দেখা গেছে, পণ্য কিনে নিয়ে যেতে পুরো এক দিন লেগে যায়। যানজট, রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং অব্যবস্থাপনার মূল কারণ বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। একদিকে অতিরিক্ত পরিবহন ব্যয় অন্যদিকে দীর্ঘ যানজটে পড়ে সময় নষ্ট হওয়ায় মফস্বলের পাইকারদের মধ্যে মৌলভীবাজারে আসা নিয়ে বিমুখতার ভাব তৈরি হয়েছে, যা উদ্বেগের বিষয়।
বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা বলেন, ‘কিছুদিন ধরে মৌলভীবাজারে ব্যবসা-বাণিজ্য কম হচ্ছে। যানজটের কারণে খুচরা ব্যবসায়ীদের মধ্যে মৌলভীবাজারে আসার ব্যাপারে অনীহা দেখা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, যদি পণ্য ক্রয় করতেই সারাদিন যায়, তবে খুচরা বিক্রেতারা বেচবে কখন?’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘এ বাজার দেশের বৃহত্তম পাইকারি বাজার। সরকার ও সিটি করপোরেশনের উচিত এদিকে নজর দেওয়া। কারণ দেশের অর্থনীতিতে মৌলভীবাজার বড় ভূমিকা রাখছে।’
Add Comment