ভোজ্যতেল নিয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে না সিটি গ্রুপ!

আয়নাল হোসেন: ভোজ্যতেল আগাম বিক্রি করে সরবরাহ দিতে বিলম্ব করছে দেশের অন্যতম বৃহৎ ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপ। তবে বাজারে কোম্পানিটির সয়াবিন তেলের বিক্রয় আদেশ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে কম দামে বিক্রি হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কয়েক মাস ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়তি। অক্টোবরে প্রতিটন সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৭০০ থেকে ৭৫০ মার্কিন ডলার। পরে তা বেড়ে বিক্রি হয় এক হাজার ৯০ থেকে এক হাজার ১০০ ডলারে। এ অবস্থায় দেশের পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসানের আশঙ্কায় আমদানি কমিয়ে দেয়। এতে বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ সংকট দেখা দেয়। ফলে দাম বাড়তে থাকে হু-হু করে। দেশের পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত অগ্রিম বিক্রয় আদেশের স্লিপ বিক্রি করে। পরে তেল সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এরপর অনেক ক্ষেত্রে কোম্পানি তেল সরবরাহ দিতে দেরি করে। আবার পরিবেশকরাও মিল থেকে তেল সংগ্রহে দেরি করে। এক্ষেত্রে অনেক ব্যবসায়ী শুধু বিক্রয় আদেশ হাত বদল করে। ফলে পণ্যটির দাম বেড়ে যায়। এভাবে মূলত ভোজ্যতেলের ব্যবসা দেশে চলে আসছে।

রাজধানীর পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের একাধিক পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী জানান, বর্তমানে বাজারে ভোজ্যতেলের চাহিদা বেশি। কিন্তু সিটি গ্রুপের মিলে ভোজ্যতেলের বিক্রয় আদেশ জমা দেয়ার পর সরবরাহ দিতে কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ দিন সময় নিচ্ছে তারা। তবে এ ক্ষেত্রে তারা দামও তুলনামূলকভাবে অন্য কোম্পানির চেয়ে কম নিচ্ছে। গতকাল মৌলভীবাজারে সিটি গ্রুপের প্রতিমণ হিসেবে সয়াবিন তেলের বিক্রয় আদেশ বিক্রি হয়েছে চার হাজার ৭০ থেকে চার হাজার ৮০ টাকায়। আর মেঘনা গ্রুপের প্রতিমণ হিসেবে বিক্রয় আদেশ বিক্রি হয়েছে চার হাজার ৪৩০ টাকায়। তবে মেঘনা গ্রুপের মিলে বিক্রয় আদেশ জমা দেয়ার দিনই তারা সরবরাহ করেছে। এ কারণে তারা দামও মণপ্রতি ৩৫০ থেকে ৩৬০ টাকা বেশি নিচ্ছে।

মৌলভীবাজারের ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী মঞ্জুর আহমেদ জানান, বাজারে যেসব কোম্পানি ভোজ্যতেল সরবরাহ করছে, তাদের কাছে মজুত কম রয়েছে। এ কারণে সিটি গ্রুপের ওপর চাপ বেশি পড়ায় সেখানে সরবরাহ নিতে কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে। তবে সিটি গ্রুপের মিল থেকে প্রতিদিনই সরবরাহ দেয়া হচ্ছে।

সিরিয়াল জটের কারণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা শেয়ার বিজকে বলেন, তাদের মিলে সয়াবিন তেল সরবরাহে কোনো জটলা নেই। তিনি দাবি করেন, বিক্রয় আদেশ হাতে পাওয়ার দিনই তারা মিল থেকে তেল সরবরাহ দিচ্ছেন। তিনি এও বলেন, বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য অনুযায়ী প্রতি কেজি সয়াবিন তেল আমদানিতে তাদের ট্যাক্স-ভ্যাট গুনতে হচ্ছে ২৪ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত। বাজারে দাম কমানোর জন্য তিনি ট্যাক্স-ভ্যাট কমানোর দাবি জানান।        

মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা বলেন, দেশে সয়াবিন তেল উৎপাদিত হয় না। পুরোটাই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজার চড়া থাকায় অনেকেই আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে এ খাতের বৃহৎ পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বসুন্ধরা, গ্লোব, এস আলম ও সেনা কোম্পানির কাছে তেলের মজুত নেই।  সিটি মেঘনা ও টিকে গ্রুপের কাছে যে পরিমাণ তেল রয়েছে, তা চাহিদায় তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। সামনে রমজান মাস। তখন তেলের চাহিদা আরও বেশি হবে। এ আবস্থায় সরকারের উচিত আমদানিকারকদের সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক করে দ্রুত আমদানি বৃদ্ধি করা। বাজার স্থিতিশীল রাখতে আমদানির বিকল্প নেই। পাশাপাশি কর না কমালে মিল মালিকরাও আমদানিতে সাহস পাচ্ছে না।

একাধিক খুচরা তেল ব্যবসায়ী জানান, গত সপ্তাহে বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কম ছিল। আর এ কারণে বেশ কিছু ব্যবসায়ী বিপুল পরিমাণ ড্রামজাত তেল মজুত করেন। তাদের নিয়ন্ত্রণে তেলের মজুত চলে যাওয়ায় ইচ্ছামতো দামে তারা বিক্রি করছেন। দুই-তিন দিন ধরে মৌলভীবাজারের অনেকের কাছেই তেলের তাৎক্ষণিক সরবরাহ ছিল না। এ কারণে দামও ঘন ঘন বদল হয়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। 

গতকাল বাংলাদেশ এডিবল অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের মালিকানাধীন রূপচাঁদা ব্র্যান্ডের পাঁচ লিটারের এক বোতল সয়াবিন তেল সর্বোচ্চ ৬৮৮ টাকায় বিক্রি হয়, যা আগে ছিল ৬৩৫ টাকা। আর সিটি গ্রুপের প্রস্তুত করা তীর ব্যান্ডের প্রতি পাঁচ লিটারের বোতল সর্বোচ্চ ৬২০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা যায়, যা আগে ছিল ৫৮০ টাকা। অন্যান্য কোম্পানির বোতলজাত তেল একই দামে বিক্রি হচ্ছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিবিসি) তথ্যমতে, গতকাল রাজধানীর খুচরা বাজারগুলোয় প্রতিলিটার খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হয় ১১২ থেকে ১১৬ টাকায়, যা এক মাস আগে ছিল ১০৮ থেকে ১১০ টাকা। প্রতি পাঁচ লিটারের বোতল গতকাল বিক্রি হয়েছে ৫৭০ থেকে ৬২০ টাকা, যা এক মাস আগে ছিল ৫৪০ থেকে ৫৮০ টাকা। আর গতকাল এক লিটারের বোতল বিক্রি হয়েছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায়, যা এক মাস আগে বিক্রি হয়েছিল ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়।

রাজধানীসহ দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত সপ্তাহে মিল মালিক, পরিশোধনকারী, পরিবেশক এবং পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের নিয়ে বৈঠক করে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে দেশের বাজারে পণ্যটির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে বলে ওই বৈঠকে জানানো হয়। তাই সরকার আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিলিয়ে একটি যৌক্তিক দাম নির্ধারণের কথা ভাবছে বলে বৈঠকে জানানো হয়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ভোজ্যতেলের মোট চাহিদা রয়েছে ১৮ লাখ টনের মতো। আর রমজান মাসেই প্রয়োজন পড়ে চার লাখ টন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে মোট ভোজ্যতেলের সিংহভাগই আমদানিনির্ভর। বাজারে বর্তমানে সিটি, মেঘনা, গ্লোব, এস আলম, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল কোম্পানি লিমিটেড ও সেনা কোম্পানি আমদানি করে চাহিদা পূরণ করছে। এসব কোম্পানির মধ্যে সিটি ও মেঘনা গ্রুপের মার্কেট শেয়ার বেশি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০