রহমত রহমান: দেশে নির্বাচনী হাওয়া বইছে। অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই হাওয়া থাকবে জানুয়ারি পর্যন্ত। ভোটকে কেন্দ্র করে শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত এখন ২৪ ঘণ্টা সরগরম। চলছে প্রচার-প্রচারণা। পাঁচ বছর হওয়া এই ভোটকে কেন্দ্র করে প্রার্থী, সমর্থক ও ভোটারদের মাঝে বইছে উৎসবের আমেজ। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মানুষের জমজমাট আড্ডা। প্রার্থী আর সমর্থকরা ভোটারদের মন জয় করতে বাড়তি টাকা খরচ করবেন। আর প্রার্থীদের দেয়া টাকার বেশিরভাগ খরচ হবে ভোটের আড্ডায়। এছাড়া ভোটারদের মন জয়ে দেয়া হয় বিভিন্ন পণ্য।
ফলে ভোটকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু পণ্যের বিক্রি বাড়বে। যেমন-বিড়ি, সিগারেট, এনার্জি ড্রিংকস, চিপস, চানাচুর, বিস্কুট ও বেকারি পণ্য। আবার ভোটার আকৃষ্ট করতে প্রার্থীরা ভোটার-সমর্থকদের মিষ্টি ও রেস্টুরেন্টের খাবার দিয়ে অ্যাপায়ন করবেন। ফলে বিড়ি-সিগারেট থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্টে তৈরি পণ্যের চাহিদা ও বিক্রি বাড়বে, বাড়বে উৎপাদন। বিক্রি বাড়লে ভ্যাট আদায়ও বাড়বে। আর শীতাকালীন নির্বাচন হওয়ায় বিড়ি ও সিগারেটের চাহিদা একটু বেশি হবে। ফলে এসব পণ্যের বিক্রি অন্য সময়ের তুলনায় বেশ বাড়বে, যার থেকে বাড়তি ভ্যাট আদায় হবে বলে মনে করছে এনবিআর।
অন্যদিকে বর্তমানে মানুষের সহজে যোগাযোগের মাধ্যম হলো মোবাইল ফোন, যাতে মানুষ সিমে কথা বলার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, মেসেঞ্জার ও টেলিগ্রামে কথা বলেন। নির্বাচন উপলক্ষে দ্রুত যোগাযোগের জন্য ভোটার, সমর্থক ও প্রার্থীরা মোবাইল ও সামাজিক যোগাযোগ বেশি ব্যবহার করছেন। এতে নির্বাচন উপলক্ষে ফোন কল যেমন বাড়বে, তেমনি ডেটার ব্যবহারও বাড়বে। এতে বাড়বে ভ্যাট আদায় হবে। আবার নির্বাচনী প্রচারণায় প্রার্থীরা পোস্টার, ব্যানার, হান্ডবিল ও ফেস্টুন ব্যবহার করছেন। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগ থেকেই এর মাধ্যমে প্রচারণা চলছে। নির্বাচনের দিন ও নির্বাচনের আগে ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টার দিয়ে সাজানো হবে ভোটকেন্দ্র। ফলে নির্বাচন উপলক্ষে ব্যানার, ফেস্টুন, হ্যান্ডবিল ও পোস্টারের চাহিদা বেড়েছে, বেড়েছে প্রিন্টিং প্রেসের কাজ। প্রিন্টিং এসব পণ্যের বাড়তি ছাপার কারণে নির্বাচনী সময়ে এসব পণ্য থেকে বাড়তি ভ্যাট আদায় হবে বলে মনে করে এনবিআর।
এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের হিসাবমতে, নভেম্বর মাসে সিগারেট খাতে বাড়তি ছয় শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে নির্বাচন উপলক্ষে সিগারেটের বিক্রি আরও বাড়বে। ফলে সিগারেট খাতে প্রবৃদ্ধি কিছুটা বাড়বে। এছাড়া রাজস্ব সভায় সিগারেটের নজরদারি ও মূল্য ঘোষণা যাচাই করতে ভ্যাট অফিসগুলোকে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ফলে সিগারেট উৎপাদন ও বিক্রিতে তদারকি বাড়িয়েছে ভ্যাট অফিস। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত রেস্টুরেন্টগুলোয় বিক্রি বেড়েছে। ফলে রেস্টুরেন্ট থেকে ভ্যাট আদায়ে ভ্যাট অফিস কাজ করছে। প্রিন্টিং প্রেসে ব্যানার, ফেস্টুন, হ্যান্ডবিল ও পোস্টার ছাপা বেড়েছে। প্রিন্টিং প্রেস থেকে বাড়তি ভ্যাট আদায় করা হচ্ছে। বিস্কুট ও বেকারি পণ্যের চাহিদা বাড়ায় উৎপাদনও বেড়েছে। মোবাইল কল ও ইন্টারনেট সেবার ওপর ভ্যাট আদায় মোবাইল অপারেটরগুলোর আয় মনিটরিং করছে এলটিইউ। সব মিলিয়ে নির্বাচন উপলক্ষে যেসব পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রি বেড়েছে। এসব পণ্য থেকে এনবিআর নির্বাচন উপলক্ষে অন্তত শত কোটি টাকার বাড়তি ভ্যাট আদায় করতে পারবে বলে মনে করেন কর্মকর্তারা। তবে কাঁচামাল সংকটে অনেক পণ্য চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ডলার সংকট, দেশের ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে কাঁচামাল আমদানি প্রায় ৩০ শতাংশ কমে গেছে।
সম্প্রতি এনবিআরে ভ্যাট দিবসের সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের জবাবে এনবিআর সদস্য (মূসক বাস্তবায়ন ও আইটি) ড. মইনুল খান বলেছেন, কাঁচামাল আমদানি কমে গেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এরপরও গত পাঁচ মাসে ভ্যাট আদায়ের প্রবৃদ্ধি ১৭ শতাংশের বেশি রয়েছে। মনিটরিং ও নেট বাড়ানোর কারণে এ অগ্রগতি হয়েছে। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে রাজস্ব আদায়ে কোনো ঝুঁকি রয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কিছু পজিটিভ ইমপ্যাক্টও আছে, যেমন সিগারেট, সফট ড্রিঙ্কসসহ বেশ কিছু পণ্যের বিক্রি বেড়েছে।
অপরদিকে ভ্যাট বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে জানিয়েছেন, শীতের মধ্যে নির্বাচন হচ্ছে। গ্রামগঞ্জ ও শহরে নির্বাচনী আড্ডা বাড়বে। এতে বিড়ি-সিগারেট বাড়তি বিক্রি হবে। বিড়ি-সিগারেট থেকে নির্বাচন পর্যন্ত আগের চেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হবে। এছাড়া শীতে অন্য কোমল পানীয়ের চেয়ে এনার্জি ড্রিংকস বেশি বিক্রি হবে। ভোটারদের আকৃষ্ট করতে মিষ্টি ও খাবার দিয়ে বেশি অ্যাপায়ন করা হবে। মানুষের আড্ডা বাড়বে এবং বিক্রি বাড়বে বিস্কুট, চানাচুর, চিপস ও বেকারি পণ্যের। ব্যানার, ফেস্টুন, হ্যান্ডবিল ও পোস্টার ছাপানো হচ্ছে। এতে প্রিন্টিং খাতে খরচ বাড়বে। ভোটকে কেন্দ্র করে মোবাইল কল ও ইন্টারনেট ব্যবহার বাড়বে। এসব সেবা ও পণ্যের বিক্রি বাড়ার সঙ্গে আমরা বাড়তি রাজস্ব পাব। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচনকেন্দ্রিক যেসব পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রি বেড়েছে এবং বাড়বেÑসেসব পণ্য ও সেবার তদারকি জোরদার এবং ভ্যাট আদায়ের জন্য কমিশনারেটগুলোকে বলা হয়েছে।
অপরদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় ভোটারপ্রতি ১০ টাকা ব্যয় করতে পারবেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। নির্বাচনী ব্যয় নির্ধারণ করে দিয়ে জারি করা প্রজ্ঞাপনে এই ব্যয়সীমা ঠিক করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইসির প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়া রাজনৈতিক দল থেকে নেয়া খরচসহ একজন প্রার্থীর নির্বাচনী খরচ ২৫ লাখ টাকার বেশি হবে না। নির্বাচন কমিশন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় ভোটারপ্রতি নির্বাচনী ব্যয় ১০ টাকা নির্ধারণ করেছে। তবে নির্বাচনী এলাকার ব্যয় সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকার বেশি হবে না। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ভোটারপ্রতি ব্যয় ১০ টাকা নির্ধারণ করেছিল ইসি। আইনে সর্বোচ্চ নির্বাচনী ব্যয়ের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয়া থাকলেও বাস্তবে এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি খরচ হবে বলে মনে করেন নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা। আর প্রার্থীরা বাড়তি এই টাকা ভোটারদের পেছনে ব্যয় করবেন। পণ্য কেনার ক্ষেত্রে ব্যয় করা এই টাকার ওপর সরকার বিপুল ভ্যাট পাবে বলে মনে করে এনবিআর।
এনবিআরের গবেষণা ও পরিসংখ্যান অনুবিভাগের হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর ভ্যাট খাতের আয়ের লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ ৫৯ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অক্টোবরে আদায় হয়েছে ১১ হাজার ৬৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা, যেখানে গত অর্থবছর একই মাসে আদায় হয়েছিল ৯ হাজার ৬৫০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। অক্টোবর মাসে ভ্যাট আদায়ের প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অপরদিকে চলতি অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত (জুলাই-অক্টোবর) ভ্যাট আদায় হয়েছে ৪০ হাজার ৪৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা। যেখানে গত অর্থবছর একই সময় আদায় হয়েছিল ৩৪ হাজার ১৯৭ কোটি ১১ লাখ টাকা। অক্টোবর পর্যন্ত ভ্যাট আদায় প্রবৃদ্ধি ১৭ দশমিক ১১ শতাংশ।
সূত্রমতে, আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ করা হবে। ১৬ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর ছিল মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন। মনোনয়নপত্র বাছাই হয় ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ আগামী ১৭ ডিসেম্বর। প্রতীক বরাদ্দ ১৮ ডিসেম্বর। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারাদেশে মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন। এবার মধ্যে পুরুষ ভোটার ছয় কোটি সাত লাখ ৭১ হাজার ৫৭৯ জন। নারী ভোটার পাঁচ কোটি ৮৯ লাখ ১৯ হাজার ২০২ জন। আর তৃতীয় লিঙ্গের ভোটারের সংখ্যা ৮৫২।