জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক : দেশের ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় বিদায় নিয়েছে ২০২৩-২৪ অর্থবছর। দেশে জাতীয় নির্বাচন ঘিরে হানাহানি আর ডলার সংকট ছিল প্রকট। সেই সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন ঘিরে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা এখনও চলমান। এর মধ্যেও বিদায়ী অর্থবছর রাজস্ব আহরণ প্রত্যাশার চেয়ে বেশি হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছর প্রায় ৩ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে। যেখানে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক ৪০ শতাংশ।
যদিও এনবিআরের আশা ছিল, রাজস্ব আদায় ৩ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি থাকবে। তবে ভ্যাট আর আয়করে ভর করেই রাজস্ব আদায়ে উল্লম্ফন হয়েছে বলে মনে করেন এনবিআর কর্মকর্তারা। ভ্যাট ও আয়করÑএই দুই খাতে আদায় প্রবৃদ্ধি দুই ঘর ছুঁয়েছে। আয়কর খাতে প্রবৃদ্ধি ১৫ দশমিক ৬০ শতাংশ হলেও ভ্যাট খাতে প্রবৃদ্ধি ২০ দশমিক ১৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
আয়কর ও ভ্যাট খাতে প্রবৃদ্ধি দুই ঘর ছুঁতে পারলেও কাস্টমস খাত প্রবৃদ্ধি একক ঘরেই রয়েছে। আর রাজস্ব আদায় ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকা বেশি আদায় হয়েছে। এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পাশাপাশি অতিরিক্ত আদায় সম্ভব হতো। তবে এমন পরিস্থিতিতে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি আদায় হওয়ায় ভ্যাট, আয়কর ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান।
এনবিআরের গবেষণা ও পরিসংখ্যান অনুবিভাগের হিসাব অনুযায়ী, বিদায়ী অর্থবছরে সংশোধিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ভ্যাট এক লাখ ৫১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, আয়কর ১ লাখ ৪৭ হাজার ৬০০ টাকা, আমদানি ও রপ্তানি পর্যায়ে শুল্ক (কাস্টমস) ১ লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে এনবিআর ৩ লাখ ৮২ হাজার ৫৬২ কোটি ৯ লাখ টাকা আদায় করেছে। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বিদায়ী অর্থবছর ২৭ হাজার ৪৩৭ কোটি ৯১ লাখ টাকা কম আদায় হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের হার ৯৩ দশমিক ৩১ শতাংশ। যেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছর মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩ লাখ ৩১ হাজার ৫০২ কোটি ১৮ লাখ টাকা।
বিদায়ী অর্থবছর রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের হার ১৫ দশমিক ৪০ শতাংশ। তবে বিদায়ী অর্থবছর জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ডলার সংকট ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও রাজস্ব আদায়ে চমক দেখিয়েছে এনবিআর।
এনবিআরের ধারণা ছিল, অস্থিরতা আর ব্যবসায় মন্দার মধ্যে রাজস্ব আদায় ৩ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা হবে। কিন্তু আদায় হয়েছে প্রায় ৩ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। তবে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বেশি অবদান রেখেছে ভ্যাট। বিদায়ী অর্থবছর ভ্যাট আদায় হয়েছে এক লাখ ৫০ হাজার ৭১৭ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। ভ্যাট খাতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের হার ৯৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। যেখানে গত ২০২২-২৩ অর্থবছর আদায় হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ৪২৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা। ভ্যাট আদায় প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ১৭ শতাংশে। এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, বিদায়ী অর্থবছরে ভ্যাট খাতে আইএমএফ প্রত্যাশা ছিল প্রায় এক লাখ ৪৩ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা। আইএমএফের প্রত্যাশার চেয়েও ভ্যাট খাতে বেশি আদায় হয়েছে।
ভ্যাট অনুবিভাগের হিসাবমতে, বিদায়ী অর্থবছরের জুনে সবচেয়ে বেশি ভ্যাট আদায় হয়েছে। এ মাসে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৮ হাজার ৯৪৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এর মধ্যে আদায় হয়েছে ২২ হাজার ৯৫৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় জুনে বাড়তি আদায় হয়েছে ৪ হাজার ১০ কোটি ২৩ লাখ টাকা। ২০২৩ সালের এই মাসে ভ্যাট খাতে আদায় হয়েছে ১৫ হাজার ৬১৩ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। সে হিসাবে বিদায়ী অর্থবছর জুনে বেশি আদায় হয়েছে ৭ হাজার ৩৪০ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। কেবল জুনে ভ্যাট খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২১ শতাংশ। আবার বিদায়ী অর্থবছর ভ্যাট খাতে মোট আদায় হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার ৭১৯ কোটি ২৮ লাখ টাকা। যেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছর আদায় হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ৪২২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ বিদায়ী অর্থবছরে ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় বেশি আদায় হয়েছে ২৫ হাজার ২৯৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
অন্যদিকে, বিদায়ী অর্থবছরে আয়কর আদায় হয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ২৫ কোটি ২ লাখ টাকা। আয়কর খাতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের হার ৮৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। যেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছর আয়কর আদায় হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৩৪৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। আয়কর খাতে প্রবৃদ্ধি ১৫ দশমিক ৬০ শতাংশ। আয়কর অনুবিভাগের হিসাব অনুযায়ী, বিদায়ী অর্থবছরের জুন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৪৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। যার বিপরীতে আদায় হয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ২৫ কোটি ২ লাখ টাকা। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের হার ৮৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আবার ২০২২-২৩ অর্থবছর আয়কর আদায় হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৩৪৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় বিদায়ী অর্থবছর আয়কর আদায় বেশি হয়েছে ১৭ হাজার ৬৭৮ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। আদায় করা ১ লাখ ৩১ হাজার ২৫ কোটি ২ লাখ টাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৮৮ হাজার ৩৪৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা আদায় হয়েছে উৎসে কর থেকে।
অর্থাৎ মোট আদায় করা আয়করের ৬৭ শতাংশ উৎসে কর থেকে আদায় হয়েছে। এছাড়া ১৭৩ ধারায় ৮ হাজার ১৬৬ কোটি ৮৫ লাখ, বকেয়া কর থেকে ৪ হাজার ৭৭৪ কোটি ৯ লাখ টাকা, অগ্রিম কর থেকে ২৩ হাজার ৭১৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকা, চলতি দাবি থেকে ৩ হাজার ৮৫৯ কোটি ৫২ লাখ টাকা, ভ্রমণ কর ২ হাজার ১৬৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।
অন্যদিকে, কাস্টমস খাতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ৮১৯ কোটি ৮ লাখ টাকা। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের হার ৯১ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। যেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছর কাস্টমস খাতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৯২ হাজার ৭৩২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ বিদায়ী অর্থবছরে কাস্টমস খাতে আহরণ প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৭২ শতাংশ।