রহমত রহমান: বহুজাতিক নির্মাণ প্রতিষ্ঠান পসকো ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড। কোরিয়ান এই প্রতিষ্ঠানটি গত পাঁচ বছরে ব্যয় বা কেনাকাটার ওপর বিপুল পরিমাণ উৎসে ভ্যাট পরিশোধ করেনি। প্রতিষ্ঠানটি ভাড়ার ওপর নামমাত্র উৎসে ভ্যাট পরিশোধ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির উৎসে মূসক পরিহার উদ্ঘাটিত হওয়ার পরও কোনো ভ্যাট পরিশোধ করেনি। যদিও পসকোর মতো সমজাতীয় বহুজাতিক কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ব্যয়ের ওপর উৎসে ভ্যাট পরিহারের বিষয়টি উদ্ঘাটিত হওয়ার পর তারা তা পরিশোধ করেছে। পসকো পাঁচ বছরে প্রায় ২৯ কোটি ৭২ লাখ টাকা ভ্যাট পরিশোধ করেনি। মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের (ভ্যাট গোয়েন্দা) নিরীক্ষায় পসকোর ভ্যাট পরিহারের বিষয়টি উঠে এসেছে। পসকোর এই বিপুল ভ্যাট পরিহারের দুটি পৃথক প্রতিবেদন তৈরি করে ভ্যাট গোয়েন্দা। এই ভ্যাট আদায়ে সম্প্রতি ভ্যাট ঢাকা দক্ষিণ কমিশনারেটে এসব প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ীতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকাজে নিয়োজিত রয়েছে কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান পসকো। প্রতিষ্ঠানটি কনস্ট্রাকশন এবং এ-সম্পর্কিত কনসালটেন্সিসহ বিভিন্ন সেবা দিয়ে থাকে। পসকো ভ্যাট ঢাকা দক্ষিণ কমিশনারেটের আওতাধীন তেজগাঁও বিভাগের কারওয়ান বাজার সার্কেল থেকে মূসক নিবন্ধিত একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির নিরীক্ষার উদ্যোগ নেয় ভ্যাট গোয়েন্দা। বিশেষ করে ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন এবং ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত নিরীক্ষা করা হয়। নিরীক্ষার জন্য কাগজপত্র চাওয়া হলে প্রতিষ্ঠান থেকে ভ্যাট-সংক্রান্ত দলিলাদি দিয়ে ভ্যাট গোয়েন্দাকে সহযোগিতা করা হয়। ওই দলিলাদি যাচাই করে ভ্যাট গোয়েন্দা বিপুল পরিমাণ উৎসে ভ্যাট পরিহারের তথ্য পায়। পরে পৃথক দুটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
ভ্যাট গোয়েন্দার সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ফাতেমা খানম, রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মাজেদুল ইসলাম ও সহকারী পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. আবদুল হাকিম হাওলাদার এই প্রতিবেদন তৈরি করেন। প্রথম প্রতিবেদনে ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত সুদসহ ৯ কোটি ৮৩ লাখ ২৪ হাজার চার টাকা এবং দ্বিতীয় প্রতিবেদনে সুদসহ ১৯ কোটি ৮৯ লাখ দুই হাজার ৭৪৭ টাকা ভ্যাট পরিহারের বিষয়টি উঠে এসেছে। অর্থাৎ পাঁচ বছরে ২৯ কোটি ৭২ লাখ ২৬ হাজার ৭৫১ টাকা ভ্যাট পরিহার বা ফাঁকি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
প্রথম প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পসকো একটি লিমিটেড কোম্পানি। মূল্য সংযোজন কর আইন, ১৯৯১-এর ধারা ৬ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ বা ব্যয়ের ওপর উৎসে মূসক কর্তনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিভিন্ন খাতে উৎসে মূসক কর্তন করে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি। এর মধ্যে রয়েছে কনস্ট্রাকশন কস্ট বা নির্মাণ খরচের মধ্যে বিমান টিকিট, অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া, ইট, সিমেন্ট, রড, কাঠ ক্রয়, সিভিল ওয়ার্ক, কম্পিউটার সামগ্রী, কুরিয়ার খরচ, কনটেইনার, ডিজাইন ড্রয়িং, বৈদ্যুতিক সামগ্রী, বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ, ফুড ও কিচেন আইটেম, হার্ডওয়্যার সামগ্রী, হোটেল বিল, ল্যাবরেটরি টেস্ট, লজিস্টিক সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, কানেকটিং রোড কনস্ট্রাকশন, মাটি পরীক্ষা, স্পিড বোট ভাড়া ও তেল, সার্ভে ওয়ার্ক, ইউনিফর্ম প্রভৃতি।
‘কোল পাওয়ার সাপোর্ট এক্সপেন্স’-এর ক্ষেত্রে কার ইন্সুরেন্স রিনিউয়াল অ্যান্ড ফিটনেস, কার পার্কিং অ্যান্ড হোটেল ফুড এক্সপেন্স, কম্পিউটার অ্যাকসেসরিজ, ইলেকট্রিক্যাল বিল ও গ্যাস, ফুয়েল, জেনারেটর, ইন্টারনেট চার্জ, রিপেয়ার অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স, পানি বিল প্রভৃতি। প্রশাসনিক ব্যয়ের মধ্যে রয়েছে বিজ্ঞাপন ও বিজনেস প্রমোশন, কার ও সিএনজি ভাড়া, কার ইন্স্যুরেন্স রিনিউয়াল, ডিজেল ও অকটেন, ইলেকট্রিক্যাল বিল ও গ্যাস, বাড়িভাড়া ভাতা, ইন্টারনেট বিল, জেটি ও পোর্ট ফ্যাসিলিটিজ, লিগ্যাল ফি, মেডিকেল এক্সপেন্স, মোবাইল ফোন রিচার্জ, অফিস ভাড়া, অফিস রিপেয়ার অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স, কুরিয়ার, প্রিন্টিং অ্যান্ড স্টেশনারি, রাবিশ ক্যারিং, স্যালারি ও বোনাস, সিকিউরিটি এক্সপেন্স প্রভৃতি। এছাড়া রয়েছে ফিক্সড অ্যাসেট-প্রোপার্টি, প্লান্ট ও ইকুইপমেন্টের ক্ষেত্রে ফার্নিচার, কম্পিউটার ও অ্যাকসেসরিজ, ভিডিও ইকুইপমেন্ট।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে এসব খাতে প্রতিষ্ঠানটি ৪১ লাখ ১৯ হাজার ৪৮ টাকা উৎসে ভ্যাট কর্তন করেনি, যার ওপর ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই শতাংশ হারে সুদসহ পরিশোধ করেনি ৯৫ লাখ ৪৮ হাজার ৮৮ টাকা। একইভাবে পসকো ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এসব খাতে সুদসহ আট কোটি ৮৭ লাখ ৭৫ হাজার ৯১৭ টাকা পরিশোধ করেনি। এই দুই অর্থবছর প্রতিষ্ঠানটি উৎসে মূসক পরিহার করেছে সুদসহ ৯ কোটি ৮৩ লাখ ২৪ হাজার চার টাকা। তবে প্রতিষ্ঠানটি এই অর্থবছর ভাড়ার ওপর ৭৭ লাখ ৩৪ হাজার ৪৭ টাকা মূসক পরিশোধ করেছে। অন্যদিকে ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত পসকো ব্যয়ের ওপর সুদসহ ১৯ কোটি ৮৯ লাখ দুই হাজার ৭৪৭ টাকা উৎসে ভ্যাট পরিশোধ করেনি। ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মতো ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছর একই খাতগুলোয় প্রতিষ্ঠানটি এসব ভ্যাট কর্তন করে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি বলে দ্বিতীয় প্রতিবেদনে তা উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাতারবাড়ী ১২০০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সরকারি মালিকানাধীন কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিপিজিসিবিএল) সঙ্গে জাপানের জাপানের সুমিতোমোর চুক্তি (কন্ট্রাক্ট) হয়। প্রকল্প নির্মাণকাজ শেষ করতে সুমিতোমো কোরিয়ান পসকো ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশনকে সাব-কন্ট্রাক্ট দেয়। মূসক আইন অনুযায়ী, সিপিজিসিবিএল কর্তৃক সুমিতোমো করপোরেশনকে বিল পরিশোধের সময় উৎসে মূসক কর্তন করবে। তবে সুমিতোমো করপোরেশন কর্তৃক পসকো ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশনের বিল থেকে উৎসে মূসক কর্তন করতে হবে না। ফলে পসকোর আয় খাতে মূসক প্রযোজ্য হবে না। তবে পসকো যেহেতু একটি লিমিটেড প্রতিষ্ঠান, ফলে তাদের ব্যয় বা সরবরাহের ওপর উৎসে মূসক কর্তন করতে হবে।
আরও বলা হয়েছে, সাব-কন্ট্রাক্ট প্রতিষ্ঠান তথা পসকোর ওপর উৎসে মূসক প্রযোজ্য হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে পসকো কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে মূসক গোয়েন্দার সঙ্গে পসকোর একটি সভা হয়েছে। তাতে পসকো জানায়, মূসক আইন, ১৯৯১-এর ধারা ৬(৪কক) অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির আয় খাতে মূসক প্রযোজ্য হবে না। কিন্তু ব্যয় খাতে উৎসে মূসক কর্তন বাধ্যতামূলক। সমজাতীয় বহুজাতিক কয়েকটি প্রতিষ্ঠান, যারা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের উৎসে মূসক উদ্ঘাটন হওয়ার পর তা পরিশোধ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে লার্সেন অ্যান্ড টুর্বো লিমিটেড, সিমপ্লেক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার, মারুবেনি করপোরেশন, চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি বাংলাদেশ, কেলের গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বাংলাদেশ, পাওয়ারম্যাচ প্রোজেক্ট বাংলাদেশ প্রভৃতি। তবে প্রতিষ্ঠানটি এই ভ্যাট পরিহারের বিষয়টি স্বীকার করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।
ভ্যাট পরিহারের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহজাহান তা স্বীকার করেন। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, বিষয়টি চলমান। ভ্যাট ঢাকা দক্ষিণ কোনো ডিমান্ড নোটিশ জারি করা হয়েছে কি নাÑপ্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, নোটিশ জারি হয়েছে। জবাব দেয়া হয়েছে। আপিল করা হয়েছে। আমি আপডেট বলতে পারব না। সহকারী ব্যবস্থাপক মুসফিকুর রহমান রিমন বিষয়টি জানেন।
মুসফিকুর রহমান রিমনকে প্রশ্ন করা হলে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, আমি আপডেট বলতে পারব না। বিষয়টি আমাদের হেড অফিস দেখে।