রহমত রহমান: ই-কমার্স ভেঞ্চার আলেশা মার্টের বিরুদ্ধে গ্রাহক হয়রানির পর ভ্যাট ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। বিক্রয় তথ্য গোপন আর প্রতিষ্ঠানের ব্যয় বা কেনাকাটায় প্রায় ৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা (সুদ ছাড়া) ফাঁকি দিয়েছে। ফাঁকি দেয়া ভ্যাট পরিশোধে প্রতিষ্ঠানকে দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিস দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেট এই নোটিস দিয়েছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। তবে প্রতিষ্ঠান এই অভিযোগকে ‘ভোগাস’ বলছে।
এনবিআর সূত্রমতে, আলেশা মার্টের বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ পায় এনবিআর। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে এনবিআর থেকে ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারকে নির্দেশ দেয়া হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভ্যাট গুলশান বিভাগের কর্মকর্তারা চলতি বছরের ২১ এপ্রিল আলেশা মার্টের করপোরেট অফিসে (প্রাসাদ প্যারাডাইস, লেভেল-৪, কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ, বনানী) অভিযান চালায়। সেখান থেকে প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় তথ্য, বাণিজ্যিক দলিল জব্দ করে। এসব দলিলাদি ও দাখিলপত্র (মাসিক ভ্যাট রিটার্ন) পর্যালোচনা করে বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করা হয়। পরে ১১ মে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।
মামলার প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আলেশা মার্ট অনলাইনে পণ্য বিক্রি করে। সেই পণ্য কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেয়। আর প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করা সেই পণ্যের ওপর কমিশন নেয়, যার ওপর ভ্যাট প্রযোজ্য। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি প্রাপ্ত কমিশনের ওপর কোনো ভ্যাট দেয়নি। দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি চলতি বছরের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে পণ্য বিক্রি করেছে ৮৬ কোটি ২৪ লাখ ৪৮ হাজার ৭২৩ টাকা। যাতে গ্রস কমিশন পেয়েছে দুই কোটি ১৭ লাখ ১৭ হাজার ২৪৯ টাকা। এই কমিশনের ওপর ৫ শতাংশ হারে প্রযোজ্য ভ্যাট ১০ লাখ ৮৫ হাজার ৮৬২ টাকা। বিক্রয়ের ওপর কমিশন ও এর ওপর ভ্যাট প্রতিষ্ঠানটি দাখিলপত্রে গোপন করেছে।
আরও দেখা গেছে, আলেশা মার্ট একটি লিমিটেড কোম্পানি। ভ্যাট আইন অনুযায়ী, লিমিটেড কোম্পানির ব্যয় বা কেনাকাটার ওপর উৎসে ভ্যাট কর্তন করে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয়। বিজ্ঞাপন খাতে ২০২০ সালের ডিসেম্বর, চলতি বছরের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে ব্যয় করেছে ১১ কোটি ২৬ লাখ ২৪ হাজার ৯৮৮ টাকা। এর ওপর ১৫ শতাংশ হারে প্রযোজ্য ভ্যাট এক কোটি ৪৬ লাখ ৯০ হাজার ২১৫ টাকা। প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিং খাতে ব্যয় ১৬ কোটি ৯১ লাখ ২৮ হাজার ৫২৫ টাকা। এর ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দুই কোটি ২০ লাখ ৬০ হাজার ২৪২ টাকা। পারচেজ ক্যাম্পেইন খাতে মার্চ মাসে ব্যয় চার কোটি ৬২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৮১ টাকা। এর ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ হারে প্রযোজ্য ভ্যাট ৩২ লাখ ২৯ হাজার ৮৭ টাকা। কস্ট অব গুডস খাতে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে ব্যয় তিন কোটি ২৭ লাখ ৫ হাজার ৭৩২ টাকা। এর ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ হারে ভ্যাট ২২ লাখ ৮১ হাজার ৭৯৫ টাকা।
ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে প্রতিষ্ঠানটির বিজ্ঞাপন, ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিং, পারচেজ ক্যাম্পেইন, কস্ট অব গুডস খাতে মোট ব্যয় হয়েছে ৩৬ কোটি ৭ লাখ ৪২ হাজার ৮২৬ টাকা। যার ওপর প্রযোজ্য মোট ভ্যাট চার কোটি ২২ লাখ ৬১ হাজার ২৪০ টাকা। অন্যদিকে কমিশনের ওপর প্রযোজ্য ভ্যাট ১০ লাখ ৮৫ হাজার ৮৬২। আলেশা মার্ট মোট ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে চার কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ২০৩ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি এই ভ্যাট পরিশোধ না করে ফাঁকি দিয়েছে। ভ্যাট আইন অনুযায়ী, ফাঁকি দেয়া এই ভ্যাটের ওপর ২ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রযোজ্য। সুদসহ ফাঁকির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৫ কোটি টাকা।
এনবিআর সূত্রমতে, ফাঁকি দেয়া ভ্যাট (সুদ বাদে) পরিশোধে আলেশা মার্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর সম্প্রতি ভ্যাট উত্তর কমিশনার ফারজানা আফরোজ সই করা দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠানো হয়। তাতে লিখিত জবাব দিতে প্রতিষ্ঠানকে ১৫ দিন সময় দেয়া হয়। এছাড়া ২৯ আগস্ট শুনানিতে অংশ নিতে বলা হয়। অন্যথায় ভ্যাট আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে নোটিসে উল্লেখ করা হয়।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে আলেশা মার্টের হেড অব পিআর কাজী তানজিলুর রহমানের ব্যক্তিগত মোবাইল নাম্বারে ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। আলেশা মার্টের কর্মকর্তা নাদিম রানা শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা শুনানিতে অংশ নিয়েছে। কমিশনারকে বলেছি, তিনি খালাস দেবেন বলেছেন। না হয় আমরা উচ্চ আদালতে যাব। আমাদের আরও ভ্যাট অতিরিক্ত দেয়া আছে।’ তিনি বলেন, ‘এক ইয়ারে কি দুইবার ভ্যাট হয়? এটি ভোগাস অভিযোগ।’
উল্লেখ্য, ভ্যাট গোয়েন্দা চলতি বছরের জুন মাসে আলেশা মার্টে অভিযান পরিচালনা করে কাগজপত্র জব্দ করে। পরে কাগজপত্র পর্যালোচনা করে প্রায় ৫২ লাখ টাকা ফাঁকি উদ্ঘাটন ও মামলা করে। প্রতিষ্ঠানটি ফাঁকি দেয়া সেই ভ্যাট ইতোমধ্যে পরিশোধ করেছে বলে ভ্যাট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ভ্যাট ফাঁকির সঙ্গে জড়িত থাকায় আলেশা মার্টের বিরুদ্ধে আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণের জন্য মামলার প্রতিবেদন ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেটে পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের সার্বিক কার্যক্রম আরও মনিটরিং করা ও অন্যান্য আর্থিক অনিয়ম আছে কি না, তা খতিয়ে দেখার অনুরোধ করা হয়েছে।