রহমত রহমান: থাইল্যান্ডভিত্তিক বহুজাতিক অনিক্স হসপিটালিটি গ্রুপের ব্র্যান্ড চেইন ‘আমারি ঢাকা’ (৪৭, রোড-৪১, গুলশান-২, ঢাকা-১২১২)। রাজধানীর ব্যবসায়িক ও কূটনৈতিক এলাকা গুলশানে অবস্থিত অভিজাত তিন তারকা হোটেলটির বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে। আন্তর্জাতিক মানের সেবা প্রদানকারী হোটেলটির ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।
প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন আয় ও ব্যয়ের বিপরীতে সুদসহ প্রায় ২০ কোটি টাকার ফাঁকি উদ্ঘাটন করে তা আদায় করতে ও ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি ঢাকা ভ্যাট উত্তর কমিশনারেটকে নিরীক্ষা প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।
এনবিআর সূত্র জানায়, তিনতারকা হোটেল আমারি ঢাকার (কারিশমা সার্ভিসেস লিমিটেড) বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ পায় এনবিআর। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআরের নির্দেশে মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (সাবেক মহাপরিচালক সৈয়দ মুসফিকুর রহমান, বর্তমানে ভ্যাট ঢাকা পশ্চিম কমিশনার) ২০১৯ সালের ২০ মে নিরীক্ষা দল গঠন করে। পরে ২৯ মে ভ্যাট ও ব্যবসা-সংক্রান্ত দলিলাদি চেয়ে ভ্যাট গোয়েন্দা থেকে আমারি ঢাকা কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়।

প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত বার্ষিক প্রতিবেদন, ভ্যাট পরিশোধের ট্রেজারি চালানের কপি, উৎসে ভ্যাট পরিশোধের চালানপত্র, দাখিলপত্র (ভ্যাট রিটার্ন) দাখিল করা হয়। নিরীক্ষা দলের কর্মকর্তারা এসব দলিলাদি আড়াআড়িভাবে যাচাই করে প্রায় ২০ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করেন। আন্তর্জাতিক এ অভিজাত হোটেলের ভ্যাট ফাঁকিতে বিস্ময় প্রকাশ করেন ভ্যাট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। পরে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বক্তব্য নিয়ে চূড়ান্ত নিরীক্ষা প্রতিবেদন দেন।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন থেকে আয়ের বিপরীতে অর্থবছরভিত্তিক ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক হিসাব করা হয়, যাতে দেখা যায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছর প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন আয়ের বিপরীতে প্রযোজ্য অপরিশোধিত ভ্যাট এক কোটি ৮৩ লাখ ৬২ হাজার ৯২ টাকা। এছাড়া ২০১৫-১৬ অর্থবছর তিন কোটি ৬২ লাখ ৮৪ হাজার ৩১০ টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছর তিন কোটি ৩৮ লাখ ৩৪ হাজার ২৫২ টাকা ও ২০১৭-১৮ অর্থবছর অপরিশোধিত ভ্যাট দুই কোটি ৮৭ লাখ চার হাজার ১৮০ টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত চার অর্থবছর মোট পরিহার বা ফাঁকি দেওয়া ভ্যাট ১০ কোটি ৭১ লাখ ৮৪ হাজার ৮৩৫ টাকা।
অপরদিকে ‘আমারি ঢাকা’র ব্যয় বা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন জিনিস ক্রয়, খরচের ওপর উৎসে ভ্যাট প্রযোজ্য। প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রতিবেদন যাচাই করে বিভিন্ন খরচের ওপর উৎসে ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করা হয়, যাতে দেখা যায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছর বিভিন্ন খরচের ওপর প্রযোজ্য এক কোটি দুই লাখ ৯৩ হাজার ১৭৮ টাকার উৎসে ভ্যাট পরিশোধ করা হয়নি। এছাড়া ২০১৫-১৬ অর্থবছর ৮৫ লাখ ৫০ হাজার ৮৭৫ টাকা এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছর ৩৭ লাখ ৪১ হাজার ২৬১ টাকার উৎসে ভ্যাট পরিশোধ করা হয়নি।
২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত মোট তিন অর্থবছর মোট দুই কোটি ২৫ লাখ ৮৫ হাজার ৩১৫ টাকার উৎসে ভ্যাট প্রতিষ্ঠানটি পরিশোধ না করে ফাঁকি দিয়েছে। আয়ের বিপরীতে চার অর্থবছর ও খরচের বিপরীতে তিন অর্থবছর প্রতিষ্ঠানটি মোট ১২ কোটি ৯৭ লাখ ৭০ হাজার ১৫১ টাকার ভ্যাট পরিশোধ না করে ফাঁকি দিয়েছে, যা মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ১৯৯১-এর ধারা ৬, ৭, ৩১, ৩২ ও ৩৫ এবং একই আইনের অধীনে বিধিমালার বিধি ১৭, ১৮ক, ২২, ২৩ ও ২৪-এর লঙ্ঘন এবং মূসক আইন, ১৯৯১ এর ধারা ৩৭(২) অনুযায়ী দণ্ডযোগ্য।

ধারা ৩৭(৩) অনুযায়ী পরিহারকৃত ভ্যাটের ওপর দুই শতাংশ হারে সুদ প্রযোজ্য। আয়ের বিপরীতে ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত অপরিশোধিত বা পরিহার করা ভ্যাট ১০ কোটি ৭১ লাখ ৮৪ হাজার ৮৩৫ টাকার ওপর ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত দুই শতাংশ হারে সুদ ছয় কোটি ২০ লাখ ৮১ হাজার ৭৫৬ টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত খরচের ওপর পরিহার করা ভ্যাট দুই কোটি ২৫ লাখ ৮৫ হাজার ৩১৫ টাকার ওপর ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত দুই শতাংশ হারে সুদ এক কোটি ৭৮ লাখ ৩৩ হাজার ৮৮৭ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির মোট পরিহার করা ভ্যাট ১২ কোটি ৯৭ লাখ ৯০ হাজার ১৫১ টাকা, আর সুদ সাত কোটি ৯৯ লাখ ১৫ হাজার ৬৪৩ টাকা। সুদসহ ফাঁকি দেওয়া ভ্যাট মোট ২০ কোটি ৯৬ লাখ ৮৫ হাজার ৭৯৫ টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানের আরও বক্তব্য জানতে চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি চিঠি দেওয়া হয়। পরে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মো. আবদুল্লাহ আল আমিন এফসিএ উপস্থিত হয়ে বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ নির্মাণ পর্যায়ে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কিছু নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেছে। ফলে নির্মাণ সংস্থা হিসেবে হিসাব করা ভ্যাট বাদ দেওয়ার অনুরোধ জানান। এর পক্ষে কিছু দলিলাদি দাখিল করবেন বলেও জানান। পরে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো দলিলাদি দেখাতে পারেননি। ফাঁকি দেওয়া ভ্যাট পরিশোধ ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চলতি বছরের ৬ জুলাই ভ্যাট গোয়েন্দার মহাপরিচালক (সাবেক) সৈয়দ মুসফিকুর রহমান ঢাকা ভ্যাট উত্তর কমিশনারেটে নিরীক্ষা প্রতিবেদন দাখিল করেন।
এ বিষয়ে সৈয়দ মুসফিকুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের দেওয়া বার্ষিক প্রতিবেদন, দাখিলপত্র ও দলিলাদি যাচাই করা হয়েছে। বক্তব্য নেওয়া হয়েছে। এরপর নিরীক্ষা প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়েছে। এতে যে ফাঁকি পাওয়া গেছে তাতে ব্যবস্থা নিতে আমরা ঢাকা ভ্যাট উত্তর কমিশনারেটকে নিরীক্ষা প্রতিবেদন দিয়েছি। এরপরও প্রতিষ্ঠানের কোনো বক্তব্য থাকলে সেখানে দিতে পারবে। আমাদের দিক থেকে সব নিয়ম পরিপালন ও যাচাই করে ফাঁকি উদ্ঘাটন করা হয়েছে।’
‘আমারি ঢাকা’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক অশোক কেজরিওয়াল। তিনি দোয়েল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজেরও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ভ্যাট ফাঁকির বিষয়ে শেয়ার বিজকে তিনি বলেন, ‘ভ্যাট গোয়েন্দা আমাদের চিঠি দিয়েছে, আমরা জবাব দিয়েছি। ভ্যাট গোয়েন্দা প্রতিবেদন দিয়েছে। ভ্যাট ফাঁকি তো হবে না। ভ্যাট ফাঁকি তারা প্রমাণ করুক।’ ভ্যাট গোয়েন্দা ভ্যাট ফাঁকির বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ঢাকা ভ্যাট উত্তর কমিশনারেটকে নিরীক্ষা প্রতিবেদন দিয়েছে। তাতে ভ্যাট পরিহার বা ফাঁকির কথা বলা হয়েছে এ বিষয়ে অশোক কেজরিওয়াল বলেন, ‘ভ্যাট উত্তর আমাদের চিঠি দেবে, আমরা জবাব দেব। আমাদের ডাকবে আমরা যাব।’