Print Date & Time : 23 June 2025 Monday 3:10 am

ভ্যাট ফাঁকিতে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারটেক

রহমত রহমান: যুক্তরাজ্যভিত্তিক মান নির্ণয়কারী বহুজাতিক কোম্পানি ইন্টারটেকের বিরুদ্ধে সেবাকে রফতানি দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। পাঁচ বছরে প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৪৩ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
সম্প্রতি এ ফাঁকি উদ্ঘাটন করা হয়। এ ভ্যাট পরিশোধে প্রতিষ্ঠানকে দাবিনামা-সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করা হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় ইন্টারটেকের আইটিএস ল্যাব টেস্ট বাংলাদেশ লিমিটেড নামে একটি পরীক্ষাগার রয়েছে। এ পরীক্ষাগারের মাধ্যমে তৈরি পোশাক ও পাদুকা (ফুটওয়্যার) পণ্যের মান পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া বৈদ্যুতিক, খাদ্য, খনিজ, কৃষিজ, কার্গো ও জিটিএস পরীক্ষা করা হয়। বাংলাদেশ থেকে যেসব ব্র্যান্ডের পণ্য রফতানি হয়, এ পরীক্ষাগারে তার মান পরীক্ষা করে সনদপত্র দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি এনবিআরের আওতাধীন কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, ঢাকার (দক্ষিণ) ভ্যাট নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান।
ইন্টারটেকের আইটিএস ল্যাব সঠিকভাবে ভ্যাট পরিশোধ করছে না বলে অভিযোগ পায় এনবিআর। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নিরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এনবিআরের নির্দেশে ভ্যাট দক্ষিণ নিরীক্ষা করে। সেজন্য কাগজপত্র তলব করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির দাখিলপত্র (ভ্যাট রিটার্ন) ও কাগজপত্র যাচাই করে বিপুল পরিমাণ ফাঁকি উদ্ঘাটন করা হয়।
সূত্র আরও জানায়, প্রতিষ্ঠানটি শতভাগ রফতানিকারী প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে গার্মেন্ট, টেক্সাটাইল ও ফুটওয়্যার খাতের প্রতিষ্ঠানের নমুনার মান পরীক্ষা করে। ভ্যাট আইন অনুযায়ী নমুনার পরীক্ষা সার্ভে কোম্পানি হিসেবে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে নমুনা পরীক্ষা করে ভ্যাট আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার কথা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি সঠিকভাবে তা জমা দেয় না।
২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির দাখিলপত্র পর্যালোচনা করা হয়। এতে দেখা যায়, আইটিএস ল্যাব এ সময়ে প্রায় ১৯২ কোটি টাকার সেবা প্রদান করেছে, যাতে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রায় ২৯ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটি এ ভ্যাট পরিশোধ না করায় দুই শতাংশ হারে সুদ প্রায় ১৪ কোটি টাকা। সুদসহ ভ্যাট ফাঁকি প্রায় ৪২ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে বক্তব্য নিতে ইন্টারটেকের কান্ট্রি ম্যানেজার সন্দীপ দাসের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ইন্টারটেকের ব্যবস্থাপক তাইমুর হাসান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘রফতানির ওপর ভ্যাট হয় না, যা ভ্যাট বিভাগ দাবি করছে। টাকা তো আমাদের নয়, কাস্টমারের। আমরা ফাঁকি দেব কেন? আমরা আদালতে যাব।’ তিনি বলেন, ‘গার্মেন্ট তো শতভাগ রফতানি করে। আমরা তাদের নমুনা পরীক্ষা করি। তারা ভ্যাট দেবে কেন? বৈদেশিক মুদ্রায় পেমেন্ট হলে তাতে শূন্য ভ্যাট। আমরা রফতানির সপক্ষে কাগজপত্র দিয়েছি, তারা তা দেখেনি।’
সূত্র জানায়, আইটিএস ল্যাব দাখিলপত্রে এ সেবা মূল্যকে শূন্য হারে রফতানি দেখিয়েছে। কারণ শতভাগ রফতানির ওপর কোনো ভ্যাট নেই। কিন্তু রফতানির বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত পিআরসি (রফতানি মূল্য প্রত্যাবাসন সনদপত্র), ব্যাক টু ব্যাক এলসি ও অন্যান্য দলিলাদি দাখিল করতে পারেনি। রফতানির সপক্ষে কাগজপত্র চেয়ে গত ৬ মে ইন্টারটেক কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয় এনবিআর। পিআরসি চাওয়া হলে প্রতিষ্ঠানটি তা দেখাতে পারেনি।
কয়েকবার পিআরসি চাওয়া হলে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে এনক্যাশমেন্ট সার্টিফিকেটসহ একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, কিন্তু এনক্যাশমেন্ট সার্টিফিকেটে কোন রফতানির চালান বা এলসির বিপরীতে এ রেমিট্যান্স প্রতিষ্ঠানটি পেয়েছে, তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি ব্যাক টু ব্যাক এলসি, পিআরসিসহ পণ্য বা সেবা রফতানির বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। প্রতিষ্ঠানটি যে সেবা প্রদান করে তার মূল্য ডলারে গ্রহণ করে। কাগজপত্র না থাকায় শতভাগ রফতানির অজুহাত দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে আসছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এ ভ্যাট পরিশোধে সম্প্রতি ভ্যাট দক্ষিণ কমিশনার কাজী মোস্তাফিজুর রহমানের সই করা আইটিএস ল্যাব টেস্ট বাংলাদেশ লিমিটেডকে দাবিনামা-সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করা হয়েছে। এ ভ্যাট পরিশোধ না করলে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে নোটিসে উল্লেখ করা হয়।
এ বিষয়ে ভ্যাট দক্ষিণের একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, রফতানি হলে পিআরসি থাকবে, কিন্তু আইটিএস ল্যাব কর্তৃপক্ষ পিআরসি দেখাতে পারেনি। শতভাগ রফতানিকারী প্রতিষ্ঠানের সব তো ভ্যাট মওকুফ নয়। ল্যাবে কোয়ালিটি টেস্ট তো সার্ভে কোম্পানি অনুসারে উৎসে ভ্যাট প্রযোজ্য। প্রতিষ্ঠানটি বাঁচতে এনক্যাশমেন্ট সার্টিফিকেট দিয়েছে। এনক্যাশমেন্ট সার্টিফিকেট তো রফতানির কিছু নয়।
তিনি বলেন, আইটিএস ল্যাব ডলারে নমুনা পরীক্ষার পেমেন্ট পায়। সেজন্য ভ্যাট মওকুফ পেতে হলে পিআরসি, ব্যাক টু ব্যাক এলসি দেখাতে হবে, যা প্রতিষ্ঠানটি দেখাতে পারেনি। তবে প্রতিষ্ঠানটি যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে ভ্যাট আদায় করতে পারে, তা জমা দেয়; যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে আদায় করতে পারে না তা রফতানি দেখিয়ে ফাঁকি দেয়। আরও ফাঁকি দিয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ থেকে অনেক দেশে তৈরি পোশাক ও ফুটওয়্যার রফতানি হয়। এসব পণ্যের ক্রেতারা পণ্য নেওয়ার আগে তার মান পরীক্ষা করে নেয়। তাতে বেশ সময় লেগে যায়। রফতানি খাতে বিশেষ সম্ভাবনা থাকায় ইন্টারটেক ২০১৪ সালে ঢাকায় প্রায় এক লাখ বর্গফুটের ল্যাব স্থাপন করে, যা এশিয়ার মধ্যে বৃহত্তম।