ভ্যাট ফাঁকিতে স্বনামধন্য ‘মুসলিম সুইটস’

রহমত রহমান: দেশের স্বনামধন্য মিষ্টি ও বেকারি পণ্য উৎপাদনকারী এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মুসলিম সুইটস অ্যান্ড বেকারি। প্রাচীন এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটি বিক্রয় তথ্য গোপন করে দীর্ঘদিন ধরে ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে আসছে। প্রতিষ্ঠানের মিরপুর শাখায় অভিযানের পর ভ্যাট তথ্য উদ্ঘাটন করেছে ভ্যাট পশ্চিম কমিশনারেট। প্রায় কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি দেয়ায় মুসলিম সুইটসের মিরপুর শাখার বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করা হয়েছে। মুসলিম সুইটসের ওই শাখা প্রযোজ্য ভ্যাটের ওপর পৃথকভাবে ৮৮ ও ৮৫ শতাংশ হারে ফাঁকি দিয়েছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্রমতে, মুসলিম সুইটস অ্যান্ড বেকারির মিরপুর সেনপাড়া পর্বতা শাখার বিরুদ্ধে বিক্রয় তথ্য গোপনের মাধ্যমে ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ পায় ভ্যাট পশ্চিম কমিশনারেট। অভিযোগ খতিয়ে দেখতে নিবারক দল গঠন করে পশ্চিম কমিশনারেট। চলতি বছর ১৩ ফেব্রæয়ারি মুসলিম সুইটস অ্যান্ড বেকারির সেনপাড়া পর্বতা শাখায় অভিযান ও তল্লাশি চালায় নিবারক দল। সে সময় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা ভ্যাট-সংক্রান্ত দলিলাদি দেখাতে ব্যর্থ হন। পরে নিবারক দল তল্লাশি চালিয়ে কিছু বাণিজ্যিক দলিলাদি জব্দ করেন। এ সময় প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক সমীর ঘোষ ও সুপারভাইজার আবুল হোসেন টুলু একটি বিবৃতি দেন।

বিবৃতিতে বলা হয়, ক্রয় হিসাব টালি খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয় এবং নিজস্ব বিল বইয়ে প্রতিদিনের বিক্রির হিসাব লিখে রাখা হয়, কিন্তু সংরক্ষণ করা হয় না। ক্রয় করা মিষ্টি, বেকারি ও অন্যান্য আইটেমের আনুপাতিক হিসাব জানতে চাইলে জানানো হয়, এক লাখ টাকার মালামাল কেনা হলে আনুমানিক ৬০ হাজার টাকার মিষ্টি ও ৪০ হাজার টাকার বেকারি এবং অন্যান্য আইটেম থাকে। প্রতিষ্ঠানের দেয়া বিবৃতি ও জব্দ করা দলিলাদি পর্যালোচনা এবং আড়াআড়ি যাচাই করে বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছেন নিবারক দলের কর্মকর্তারা। পরে চলতি বছর মার্চে দুটি পৃথক মামলা করা হয়েছে। মামলা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানকে পৃথক দাবিনামা-সংবলিত কারণ দর্শানো নোটিস করেছে পশ্চিম ভ্যাট কমিশনারেট।

একটি মামলার প্রতিবেদনে বলা হয়, আটক ক্যাশ মেমোগুলো বিক্রয় ক্যাশ মেমো নয়। এগুলো বিভিন্ন ক্রেতার বাকির হিসাব বিল পেপারে লিখে রাখা হয়েছে। এসব বিল পেপার থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যায় না। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়মূল্যের চেয়ে ক্রয়মূল্য অধিক হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ পণ্য ক্রয় করার পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন খরচ যুক্ত হয়ে বিক্রয়যোগ্য পণ্যের বিক্রয়মূল্য নির্ধারিত হয়। প্রতিষ্ঠানের সঠিক বিক্রয়ের তথ্য না পাওয়ায় ক্রয়মূল্যকেই বিক্রয়মূল্য হিসেবে গণ্য করে ভ্যাটের হিসাব করা হয়েছে। সে অনুযায়ী ২০১৯ সালের জুলাই থেকে চলতি বছর জানুয়ারি পর্যন্ত ওই শাখায় বিক্রি হয়েছে চার কোটি ১৮ লাখ ৮৭ হাজার ৩১০ টাকার পণ্য।

প্রতিষ্ঠানের বিবৃতি অনুযায়ী, মুসলিম সুইটসের বিক্রয় বা ক্রয়মূল্যের ৬০ শতাংশ মিষ্টি, ৪০ শতাংশ বেকারি ও অন্যান্য পণ্যের ক্রয় হিসাবে হিসাব করা হয়েছে। নতুন মূসক আইন অনুযায়ী মিষ্টি বিক্রির ওপর ভ্যাট হার ১৫ শতাংশ। এ ছাড়া অন্যান্য পণ্যের ব্যবসায়ী পর্যায়ে সরবরাহের ক্ষেত্রে ভ্যাট হার পাঁচ শতাংশ। সে অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জুলাই থেকে চলতি বছর জানুয়ারি পর্যন্ত বিক্রয় ও ব্যবসায়ী পর্যায়ের ওপর প্রযোজ্য ভ্যাট ৪৬ লাখ সাত হাজার ৬০৪ টাকা, যার মধ্যে প্রতিষ্ঠান সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে পাঁচ কোটি ৭৮ হাজার ৫৭৬ টাকা। বাকি ৪০ লাখ ২৯ হাজার ২৮ টাকার ভ্যাট পরিশোধ না করে প্রতিষ্ঠান ফাঁকি দিয়েছে। অর্থাৎ প্রযোজ্য ভ্যাটের প্রায় ৮৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান ফাঁকি দিয়েছে। সুদসহ এই ভ্যাটের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৬০ লাখ টাকা।

অন্য প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের ২০১৭ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত বিক্রয় হিসাব করা হয়েছে। এ সময় প্রতিষ্ঠান মিষ্টি ও বেকারি পণ্য বিক্রয় করেছে দুই কোটি ৮২ লাখ ৯৯ হাজার ১৫৮ টাকা। সে অনুযায়ী মিষ্টি ও বেকারি পণ্য বিক্রয় (১৫ শতাংশ ভ্যাট) ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে (পুরোনো ভ্যাট আইন অনুযায়ী চার শতাংশ ভ্যাট) প্রযোজ্য ভ্যাট ২৯ লাখ ৯৯ হাজার ৭১১ টাকা, যার মধ্যে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ তিন লাখ ৮৪ হাজার টাকা পরিশোধ করেছে। বাকি ২৬ লাখ ১৫ হাজার ৭১১ টাকা ফাঁকি দিয়েছে। অর্থাৎ প্রযোজ্য ভ্যাটের প্রায় ৮৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান ফাঁকি দিয়েছে। সুদসহ ফাঁকির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা হবে। সূত্রমতে, দুটি মামলায় প্রতিষ্ঠানকে দাবিনামা-সংবলিত কারণ দর্শানো নোটিস জারি করা হয়েছে। ব্যাখ্যা দিতে সময় দেয়া হয়েছে।

নিবারক দলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মুসলিম সুইটস স্বনামধন্য হলেও ভ্যাট ফাঁকি দিতে প্রকৃত বিক্রয় হিসাব লুকিয়ে ফেলে। দীর্ঘদিন ধরে ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে এলেও ধরা সম্ভব হয়নি। মামলার পর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। মুসলিম সুইটসের সব শোরুমে নজরদারি বাড়ানো হলে ফাঁকি বন্ধ হবে বলে মত দেন কর্মকর্তারা।

এ বিষয়ে বক্তব্য নিতে মুসলিম সুইটসের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এর মধ্যে পরিচালক মো. আসাদুজ্জামান শেয়ার বিজকে বলেন, একেক শাখা আমাদের একেক জন দেখেন। মিরপুর শাখা আমার এক আত্মীয় দেখেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি বা ওই শাখার কর্মকর্তারা কথা বলবেন। পরে বক্তব্য জানতে মিরপুর শাখার ব্যবস্থাপক সমীর ঘোষের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে মুসলিম সুইটসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, ভ্যাট ফাঁকির মামলা তাদের প্রধান কার্যালয় থেকে দেখা হচ্ছে। ভ্যাট কমিশনারেটের সঙ্গে আমাদের কর্মকর্তা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।

উল্লেখ্য, ১৯৮৯ সালে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে ৪০ প্রকারের মিষ্টি ও ১২ প্রকারের বিস্কুট নিয়ে যাত্রা করে মুসলিম সুইটস অ্যান্ড বেকারি। বর্তমানে মুসলিম সুইটস অ্যান্ড বেকারিতে প্রায় ৭০ প্রকারের মিষ্টি ও ফাস্টফুড আইটেমসহ ৪০ প্রকারের বেকারি খাদ্যসামগ্রী পাওয়া যায়। বাংলাদেশে মিষ্টির সঙ্গে বেকারি পণ্যের সমন্বয় করেন ‘সুইটস অ্যান্ড বেকারি’র মিজানুর রহমান আক্কাছ। বর্তমানে মুসলিমের সাতটি সুইটস অ্যান্ড বেকারি, তিনটি রেস্তোরাঁ (মুসলিম রেস্টুরেন্ট, মুসলিম কারি হাউস ও ক্যাফে মিরপুর অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট) ও একটি চাইনিজ রেস্তোরাঁ (বে লীফ) রয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০