ভ্যাট ব্যবস্থাপনা ও প্রয়োগের দায়বদ্ধতা

আলীমুজ্জামান: একটা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সবচেয়ে প্রধান আয়ের উৎস হলো সে দেশের রাজস্ব ব্যবস্থপনা। তবে নাগরিকরা সব সময় কথা বলেন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) নিয়ে। কারণ এর প্রভাব সরাসরি পণ্যমূল্যের ওপর পড়ে। আসলে পণ্যের প্রতিবার হাত বদলের সঙ্গে মূল্য সংযোজনের বিষয় থাকলে সেখানে মূসক থাকবে এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকলে তা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে। অর্থাৎ ভ্যাট যদি সংযোজিত মূল্যের না হয়ে মোট মূল্যের ওপর ধরা হয় তাহলে সেটাকে কোনোভাবে মূসক বলা যায় না। সেই বারোয়ারি ভ্যাট হার নিয়ে এ দেশের ভ্যাট আইন, যা বিশ্বের কোনো দেশের ভ্যাট আইনে পাওয়া যায় না।

মূসক আইন অনুসারে ভ্যাট দিতে হয় ভোক্তার বা শেষ ব্যবহারকারীর। তাই এর মধ্যে যতবার হাত বদল হবে ততবার ভ্যাট যোগ হলো, না অগ্রিম হলো তাতে কারও কিছু যায় আসে না। আসলে কি তা-ই? অবশ্যই নয়। আমরা কেউ এই নিয়মের বাইরে নয়। আগে বিভিন্ন বিপণিবিতানে বা তারকা হোটেলে পণ্যমূল্যের সঙ্গে ভ্যাট প্লাস থাকত যাতে সাধারণ ভোক্তার মনে উদয় হতো, এখানেও ভ্যাট? তবে বর্তমানে পণ্যমূল্যের সঙ্গে ভ্যাট প্লাস লেখা থাকে না এর অর্থ এই নয় যে, এগুলোর ওপর ভ্যাট নেই। আসলে সেটা আর আউটে নেই, তিনি অতিথিশালায় (ইন) রেস্ট নিচ্ছেন যাতে অহেতুক ঝামেলা পোহাতে না হয়।

কালজয়ী সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের মতো বলতে হয় ‘ভগবান থাকেন ভদ্রপল্লীতে’। আমাদের মতো লোকের কথায় তো আসলে ভ্যাট সিস্টেমের পরিবর্তন হবে না। বর্তমানে আমাদের দেশে দুই খাতে ভ্যাট আদায় করা হয়: ১. উৎপাদন খাত আর ২. সেবা খাত। বর্তমানে ভ্যাটযোগ্য পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ভ্যাট আদায় ও প্রদানে কিছুটা স্বচ্ছতা এসেছে। কারণ এতদিন সরকার এ খাত ও আমদানি থেকে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা গেলেও গত তিন বছর সেটার ধারেকাছে যাওয়া যাচ্ছে না। কভিড মহামারির অজুহাতে দুই বছর পার পেলেও এ বছর তো সে অজুহাত দেয়া যাবে না। ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য মরিয়া হয়ে ভ্যাট কর্মকর্তারা বেছে নিয়েছেন রপ্তানিমুখী শিল্প খাত ও সেবা খাতগুলো। আমাদের দেশে ভ্যাটযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে ভ্যাট বোঝে না আর রপ্তানি খাতের শিল্প খাতগুলো তো নিজেদের ভ্যাট আইনের ঊর্ধ্বে মনে করেন। শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকার বিদ্যুৎ, গ্যাস, পরিবহনসহ আরও অনেকগুলো সেবার ওপর ভ্যাট মওকুফ করেছেন, তবে অবশ্যই কিছু শর্ত প্রতিপালন সাপেক্ষে।

রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো রপ্তানি নীতিমালা, ২০১৮-২১ অনুযায়ী মোট উৎপাদনের ৮০ শতাংশ রপ্তানি করলে শতভাগ রপ্তানিকারক হিসেবে বিবেচিত হবে আর বাকি ২০ শতাংশ পণ্য সমস্ত কর ও শুল্ক পরিশোধ করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা যাবে। অন্যদিকে মূসক আইনে শতভাগ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার উৎপাদিত পণ্যের শতভাগ রপ্তানি করাকে বোঝাবে, স্থানীয় ভোগের উদ্দেশ্যে কোনো পণ্য বিক্রয় করা যাবে না। বর্তমানে বেশির ভাগ রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিলের ওপর কোনো না কোনোভাবে কমিশনারের কাছ থেকে মূসক মওকুফ করিয়েছেন কিন্তু তিনি উনার বিভিন্ন পর্যায়ের অফিসগুলো বলেননি, এই ভ্যাট মওকুফ সুবিধা বহাল রাখতে মূসক আইনের কী কী কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে বা কীভাবে দলিলাদি সংরক্ষণ করে সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠানগুলো নির্ধারিত ছকে প্রতি কর মেয়াদের তথ্য-পরবর্তী মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে সার্কেল অফিসে জমা দেবেন। সার্কেল অফিস সেগুলো পরীক্ষা করার পর অন্য আর একটা নির্ধারিত ফরমে বিভাগীয় কর্মকর্তার কাছে পাঠাবেন ।

গত দুই-তিন বছর এ ধরনের সুবিধাগুলো শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্পগুলো ভোগ করছিলেন। এত দিন এগুলো নিয়ে কোনো ঝামেলা না হলেও বর্তমানে সব ধরনের লিমিটেড কোম্পানির বার্ষিক হিসাব বিবরণী দাখিল করা মূসক আইনে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ভ্যাট অফিসগুলো সেগুলো নিরীক্ষা করতে গিয়ে বলেছে ভ্যাট মওকুফের সুবিধা বহাল রাখতে, প্রতি মাসে যেসব দলিলাদি দাখিল করার বিধান ছিল, সেগুলো না করায় আপনার গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিলসহ বাকি সব সুবিধার ওপর এসআরও অনুযায়ী যে ভ্যাট মওকুফের সুবিধা নিয়েছিলেন সেগুলো বাতিল বা আপনার সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানের কাছে কিছু পণ্য বিক্রি করলেন নগদ টাকায় এবং সে প্রতিষ্ঠানও সেটা দিয়ে তৈরিপণ্য রপ্তানি করবেন। রপ্তানি নীতিমালা অনুযায়ী সেটা ২০ শতাংশের বেশি হলো না এবং করদাতা প্রযোজ্য কর ও শুল্ক পরিশোধ করলেন। এখানেও ভ্যাট মওকুফ করা সেবাগুলোর সুবিধা বাতিল হবে। কারণ মূসক আইনে শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্প বলতে দেশে কোনো পণ্য বিক্রি করা যাবে না। যদিও আইনে বলা আছে দেশের অভ্যন্তরে ভোগের জন্য বিক্রি করা যাবে না।

বর্তমানে রপ্তানিমুখী অনেক শিল্পকারখানা এ ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তবে এ ধরনের জটিলতা শুরুতেই সমাধান করা যেত, যদি শিল্পকারখানার মালিক বা কর্মকর্তারা এসআরও তে বলা দলিলাদি সংরক্ষণ করে সঠিক সময়ে ভ্যাট অফিসে দাখিল করতেন আবার অন্যদিকে ভ্যাট সার্কেল অফিসগুলো দুই বছর পরে খবর না নিয়ে আইনে বলা দ্বিতীয় মাসের মধ্যে সে অফিসে গিয়ে বলতেন, আপনার তো এগুলো দাখিল করার কথা সেটা কেন করছেন না। বিভিন্ন সেবা খাতগুলোর ভ্যাট মওকুফের জন্য আইন অনুযায়ী উভয়পক্ষের দোষ সমান কিন্ত ভিকটিম সেই কেষ্ট বেটা। আসলে কোনো আইনে সেটার প্রয়োগকারীর ওপর কোনো দায় থাকে না। সেটা করা না গেলে রাজস্ব আদায়ের মতো আইনে ব্যবসায়ীদের হয়রানিমুক্ত রাখা যাবে না। এ লক্ষ্যে সবার সচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ।      

কনসালট্যান্ট

দ্য রিয়েল কনসালটেশন

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০