Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 4:07 am

ভ্যাট ব্যবস্থা সংস্কারে ‘অটোমেটেড’ সিস্টেম

রহমত রহমান: দেশকে ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয় ও ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত করার জন্য সরকার বদ্ধপরিকর। এই অভিষ্ট লক্ষ্য পূরণে অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে এনবিআরের ভূমিকা অপরিসীম। এনবিআরে রাজস্ব আহরণের অন্যতম প্রধান খাত ভ্যাট। এনবিআর বাজেটে মোট রাজস্বের প্রায় ৮৫ শতাংশ আহরণ করে, যার মধ্যে প্রায় ৩৯ শতাংশ আহরিত হয় ভ্যাট থেকে। এছাড়া দেশের কর জিডিপি অনুপাত গত ১০ বছর ধরে ৯-১০-এর কাছাকাছি ঘুরপাক খাচ্ছে। দ্বিতীয় পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-৪১) অনুসারে, ২০৪১ সালের মধ্যে কর জিডিপি অনুপাত ১৬-তে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, যা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

বর্তমানে কর জিডিপি অনুপাত মাত্র ৭ দশমিক ৯ শতাংশ, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম। কর জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধির ক্ষেত্রে রাজস্ব আয়ের সর্বোচ্চ খাত ভ্যাটের আওতা বাড়াতে ভ্যাট ব্যবস্থার অবকাঠামোগত সংস্কারের বিকল্প নেই। অটোমেটেড সিস্টেম নির্মাণ বা তথ্যপ্রযুক্তিগত অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে দেশের বর্তমান ভ্যাট ব্যবস্থা সংস্কার সম্ভব বলে ‘বাংলাদেশের ভ্যাট ব্যবস্থায় সংস্কারের উদ্দেশ্যে প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন’-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।

এনবিআর গঠিত কমিটি সম্প্রতি এনবিআরে এই খসড়া প্রতিবেদন দাখিল করে। কমিটির আহ্বায়ক হলেন কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আব্দুর রউফ। প্রতিবেদনে অটোমেটেড সিস্টেম নির্মাণ ছাড়াও আইন সহজীকরণ, সংশোধন, ভ্যাট সচেতনতা বৃদ্ধি ও সুশাসন নিশ্চিতসহ ১২টি প্রস্তাব এবং তিনটি সুপারিশ করা হয়েছে।

এনবিআর সূত্রমতে, দেশের ভ্যাট ব্যবস্থায় সংস্কারের উদ্দেশ্যে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ-সংবলিত একটি পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য এনবিআর পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। ২৬ জানুয়ারি কমিটি গঠন-সংক্রান্ত আদেশ জারি করে। কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আব্দুর রউফকে আহ্বায়ক করে এই কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেনÑন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো প্রকল্পের উপ প্রকল্প পরিচালক মো. মশিউর রহমান, এনবিআরের দ্বিতীয় সচিব মো. বদরুজ্জামান মুন্সী, ভ্যাট পূর্ব কমিশনারেটের উপ-কমিশনার মো. ইফতেখার আলম ভূঁইয়া ও কাস্টমস গোয়েন্দার উপ-পরিচালক নাজমা জ্যাবিন।

কমিটিকে ভ্যাটের পাঁচটি বিষয়ের ওপর কাজ করতে বলা হয়। বিষয়গুলো হলো বাংলাদেশের ভ্যাট ব্যবস্থার অবকাঠামোগত সংস্কার, ভ্যাট নেট বৃদ্ধি, ভ্যাটের প্রবৃদ্ধির সম্ভাব্যতা যাচাই, রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে ভ্যাট হার কমানো বা বাড়ানোর প্রভাব ও ভ্যাট আদায় বৃদ্ধির জন্য করণীয়। কমিটিকে প্রতিবেদন প্রস্তুতের ক্ষেত্রে ২০২৬ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের ফলে বাংলাদেশের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় কমিটি এবং এ-সংক্রান্ত সাব কমিটিগুলোর প্রস্তাবগুলো প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়। প্রয়োজনে বিভিন্ন অংশীজন, বিশেষজ্ঞ ও ভ্যাট কর্মকর্তাদের মতামত নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়। প্রতিবেদন দাখিলে এক মাস সময় দেয়া হয়। কমিটি ভ্যাট ব্যবস্থার বিষয়ে কমিটি তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে। এছাড়া অংশীজন, ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়া হয়। সব পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন দেয়া হয়।

প্রতিবেদনে অটোমেটেড সিস্টেম নির্মাণ বিষয়ে বলা হয়, দেশের ভ্যাট ব্যবস্থায় সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রথম কাজ হতে হবে অটোমেটেড সিস্টেম নির্মাণ। সব ভ্যাটযোগ্য ইনভয়েস রিয়েল টাইমে অটোমেটেড সিস্টেমে নিয়ে আসা ও স্টোর করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে ভ্যাটযুক্ত ও ভ্যাটমুক্ত উভয় প্রকারের ইনভয়েস নিয়ে আসতে পারলে আরও ভালো হয়। এই তথ্য দেশের নানা কাজে ব্যবহার হবে। শিগগির এই কাজ শেষ করতে হবে। কারণ ২০২২ সালে কর জিডিপির অনুপাত হলো ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০৩১ সালে কর জিডিপি ১৭-তে নিতে হবে। অর্থাৎ ৯ বছরে ৯ দশমিক ১ শতাংশ বাড়াতে হবে। প্রতি বছর এক শতাংশের বেশি, যা সহজ নয়। স্বাভাবিক গতিতে এই অর্জন সম্ভব নয়। অটোমেটেড সিস্টেম নির্মাণের মধ্যে ই-ইনভয়েসিংয়ের ওপর জোর দেয়া হয়।

প্রতিবেদনে ভ্যাট আইন ও বিধিবিধানের বিষয়গুলো সহজীকরণের বিষয়ে বলা হয়, জনগণ ও পাঠকের কাছে ভ্যাট আইন ও বিধিবিধান সহজে বোধগম্য নয়। সহজে বোধগম্য হলে সহজে পরিপালন করা যাবে। এছাড়া আইনে জটিলতা ও অসামঞ্জস্য রয়েছে, যা দূর করতে হবে। নতুন ভ্যাট আইন সংশোধনে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া আংশিক উপকরণ কর রেয়াত গ্রহণের ধারাটি বর্তমান আইনে অর্থহীন ও নিষ্প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এছাড়া ভ্যাট সচেতনতা বাড়ানোর জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। সুশাসন নিশ্চিত করার বিষয়ে বলা হয়, ২০৩১ সালের মধ্যে কর জিডিপি ১৭ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ২২-এ উন্নীত করতে হলে দক্ষ কর প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। সেক্ষেত্রে মোটিভেশন, ইনসেনটিভ দেয়া এবং প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

অটোমেটেড সিস্টেম নির্মাণের সুপারিশে বলা হয়, দেশের ভ্যাট ব্যবস্থায় বর্তমানে সবার আগে প্রয়োজন ভ্যাট চালানপত্র (মূসক-৬.৩) অটোমেশন করা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ও প্রতিবেশী ভারত ভ্যাট বাস্তবায়ন শুরু করেছে ভ্যাট চালানপত্র অটোমেশন দিয়ে। বাংলাদেশ ৩১ বছর ভ্যাট বাস্তবায়ন হলেও ভ্যাট চালান অটোমেশন হয়নি। দ্রুত ভ্যাট চালান অটোমেশন করার সুপারিশ করা হয়। এছাড়া আইভাস সম্প্রসারণ করে ভ্যাট চালানপত্র অটোমেশন, আইভাসে এপিআই করে ডেটা আনয়ন, কমন সফটওয়্যার প্রস্তুত, মোবাইল ও ট্যাব রেসপনসিভ সিস্টেম, ডিস্ট্রিবিউটেড ডেটা সিস্টেম নির্মাণ এবং ই-ভিডিএস সিস্টেম প্রস্তুত করার বিষয়ে বলা হয়। প্রথমে এলটিইউভুক্ত ১১১টি প্রতিষ্ঠানে, তারপর ক্রমান্বয়ে বড়, মাঝারি, ছোটো প্রতিষ্ঠানে স্বল্প ও মধ্যম-মেয়াদে চালান অটোমেশন চালু করার সুপারিশ করা হয়েছে। অন্যদিকে প্রতিবেদনে ২০২২-২৩ অর্থবছর বাজেটে ভ্যাট ব্যবস্থায় বাস্তবায়নযোগ্য ১০টি সুপারিশ করা হয়।