মদিনা সিমেন্টের ১৪১ কোটি টাকার বিক্রি তথ্য গোপন

রহমত রহমান: সিমেন্ট বিক্রি হলেও বিক্রির তথ্য গোপন করা হয়েছে। প্রকৃত বিক্রি গোপন করতে তৈরি করা হয়েছে জাল বা নকল বিক্রয় রেজিস্টার (বিক্রয় হিসাব পুস্তক)। একটি-দুটি নয়, সাতটি জাল বিক্রয় রেজিস্টার তৈরি করা হয়েছে। জাল বিক্রয় হিসাবের সেই বিক্রির হিসাব দেখানো হয়নি মাসিক ভ্যাট রিটার্নে (দাখিলপত্র)। এভাবে জাল রেজিস্টারে ১৮ মাসে প্রায় ১৪১ কোটি টাকার বিক্রি গোপন করেছে মদিনা সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।

মদিনা গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানটি বিরুদ্ধে এভাবে বিক্রয় রেজিস্টার জাল করে ভ্যাট ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে জাল রেজিস্টার ব্যবহার করে প্রায় ২১ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ)। ফাঁকি দেয়া ভ্যাট পরিশোধ ও জালিয়াতির বিষয়ে বক্তব্য জানাতে কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করা হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। তবে এ প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় রেজিস্টার জালিয়াতিতে নড়েচড়ে বসেছেন এলটিইউ কর্মকর্তারা।

এনবিআর সূত্রমতে, মদিনা সিমেন্টের বিরুদ্ধে বিক্রয় তথ্য গোপনের অভিযোগ পায় এলটিইউ। বিষয়টি খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০২১ সালের ১ ডিসেম্বের এলটিইউর ৯ সদস্যের একটি পরিদর্শক দল সোনারগাঁও মেঘনাঘাট এলাকায় মদিনা সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে অভিযান পরিচালনা করেন। সেখান থেকে পরিদর্শক দল ক্রয় হিসাব পুস্তক, বিক্রয় হিসাব পুস্তক, বোট রেজিস্টার, ট্রলার ডেলিভারি রেজিস্টার, উৎপাদন ও সরবরাহ রেজিস্টার, কর চালানপত্র, একটি নকল বা জাল চালান বই, অব্যবহৃত চালান বইসহ বেশ কিছু বাণিজ্যিক দলিলাদি জব্দ করেন। এছাড়া পরিদর্শনের সময় পরিদর্শক দল আরও দুটি জাল বা নকল বিক্রয় রেজিস্টার বা বই (মূসক-৬.২) খুঁজে পায়। জব্দ করা ও খুঁজে পাওয়া বিক্রয় হিসাব যাচাই করে পরিদর্শক দল দেখতে পায়, প্রতিষ্ঠানটি দুটি জাল বা নকল বিক্রয় হিসাব বা রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করা বিক্রয় দাখিলপত্রে দেখাননি। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি ভ্যাট ফাঁকি দিতে জাল বিক্রয় হিসাব পুস্তক বা জাল বিক্রয় রেজিস্টার তৈরি করেছে। ফাঁকি উদ্ঘাটিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ‘মূসক আইন, ২০১২’ অনুযায়ী মামলা করা হয়।

সূত্র আরও জানায়, প্রতিষ্ঠানটির জালিয়াতিতে হতবাক এলটিইউ কর্মকর্তারা। আরও জালিয়াতি উদ্ঘাটনে প্রতিষ্ঠানটি নিরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয় এলটিইউ। সে অনুযায়ী ৯ ডিসেম্বর বিশেষ নিরীক্ষা আদেশ জারি করা হয়। নিরীক্ষা শেষ করতে জব্দ করা দলিলাদি ব্যতীত মূসক-সংক্রান্ত আর কোনো দলিলাদি থাকলে তা এলটিইউকে দিতে প্রতিষ্ঠানটিকে নির্দেশ দেয়া হয়।

প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে চলতি বছরের ২৩ মার্চ মূসক-সংক্রান্ত কিছু দলিলাদি জমা দেয়া হয়, যার মধ্যে ছিল ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৬টি বিক্রয় হিসাব পুস্তক। নিরীক্ষা কর্মকর্তারা জব্দ করা দলিলাদি ও প্রতিষ্ঠানের জমা দেয়া মূসক-সংক্রান্ত দলিলাদি যাচাই করেন। তাতে দেখা গেছে, জব্দ করা সাতটি বিক্রয় রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ বিক্রয়ের তথ্য প্রতিষ্ঠানটি দাখিলপত্রে প্রদর্শন করেননি। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি ভ্যাট ফাঁকি দিতে সাতটি বিক্রয় রেজিস্টার জাল করেছে। এই রেজিস্টারে থাকা বিক্রয় প্রতিষ্ঠানটি জেনেশুনে গোপন করেছে। জাল রেজিস্টার ব্যবহার করে ফাঁকি দেয়া রাজস্ব হিসাব করা হয়েছে। যাতে দেখা গেছে,  প্রতিষ্ঠানটি দাখিলপত্রে ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৮ মাসে বিক্রয় মূল্য দেখিয়েছে (রপ্তানিসহ) ৫৪৮ কোটি আট লাখ ১২ হাজার ৬৩৭ টাকা। যাতে মূসক দেখিয়েছে ৮১ কোটি ১৯ লাখ ৬০ হাজার ৭৭৩ টাকা। আর সাতটি জাল বিক্রয় রেজিস্টার অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি বিক্রয় গোপন করেছে ১৪০ কোটি ৯২ লাখ ৬৬ হাজার ৪৮২ টাকা। যাতে প্রযোজ্য মূসক ২১ কোটি ১৩ লাখ ৮৯ হাজার ৯৭২ টাকা, যা প্রতিষ্ঠানটি পরিশোধ না করে ফাঁকি দিয়েছে। জালিয়াতি ও ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ এবং বিধিমালা, ২০১৬ লঙ্ঘন করেছে।

এলটিইউ সূত্রে জানা গেছে, নিরীক্ষা দলের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের একাধিকবার আলোচনা হয়েছে। যাতে মদিনা সিমেন্টের কর্মকর্তারা সমান্তরালভাবে একাধিক জাল বা নকল বিক্রয় রেজিস্টার তৈরির বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবে প্রতিষ্ঠানটি একই কায়দায় আগেও ফাঁকি দিয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। নকল বা জাল রেজিস্টার তৈরি করায় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকির পাশাপাশি ফৌজদারি মামলা করার কথা ভাবছে এলটিইউ। অপরদিকে, দরপত্র, কার্যাদেশ বা অন্যভাবে চুক্তির মাধ্যমে সরবরাহ করা সিমেন্টে প্রতিষ্ঠানটির ভ্যাট ফাঁকি তদন্ত করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে মদিনা সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মোহাম্মদ সোলায়মান সেলিমের ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। বক্তব্যের বিষয় লিখে খুদে বার্তা দেয়া হলেও জবাব দেননি। একই নাম্বারের হোয়াইটস অ্যাপে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। বক্তব্যের বিষয়বস্তু লিখে ম্যাসেজ দেয়া হলে তিনি সিন করেন। তবে জবাব দেননি।

পরে ডিএমডিকে পাঠানো বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করতে এই প্রতিবেদককে ফোন করেন মদিনা গ্রুপের চেয়ারম্যান হাজী মোহাম্মদ সেলিমের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) মহিউদ্দিন মাহমুদ বেলাল। তিনি নিউজ না করার জন্য অনুরোধ করে বলেন, ‘সামনে এমডি সাহেবের জামিন শুনানি রয়েছে। এখন নিউজটি করা হলে আমাদের সমস্যা হতে পারে।’ সামনাসামনি বসে আলোচনা করার জন্য প্রস্তাব দেন তিনি।

এ বিষয়ে মদিনা গ্রুপের কনসালটেন্ট (ভ্যাট ও ট্যাক্স) জাহিদুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এখনো মদিনা সিমেন্টের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি।’ সাতটি বিক্রয় রেজিস্টার জালিয়াতি করে ভ্যাট ফাঁকির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান কোনো বিক্রয় গোপন করেনি এবং কোনো ফাঁকি দেয়নি। এখনো কিছু চূড়ান্ত হয়নি।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০